আইন
এত বড় গণঅভ্যুত্থানের পর সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব ঘটে গেছে
জুলাই গণপরিসর আয়োজিত ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী সংবিধান বিতর্ক: উৎস ও গন্তব্য অনুসন্ধান’ শীর্ষক আলোচনা সভায় কবি ও ভাবুক ফরহাদ মজহার এই বক্তব্য প্রদান করেন গত ২৩ সেপ্টেম্বর। বাংলা একাডেমি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে, তার বক্তব্যের লিখিতরূপ প্রকাশ করা হলো ভিউজ বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য। আজ প্রকাশিত হলো আলোচনাটির প্রথম অংশ।
সুপ্রিম কোর্টের সেকশনে ঘুষ বন্ধ হতেই কাজে স্থবিরতা
সম্প্রতি সরকার পরিবর্তনের পর দেশের সব প্রতিষ্ঠানেই চলছে সংস্কার কার্যক্রম। ব্যতিক্রম হয়নি সুপ্রিম কোর্টও। এরই মধ্যে প্রধান বিচারপতিসহ বিগত সরকারের সময় আপিল বিভাগে থাকা সব বিচারপতিই পদত্যাগ করেছেন। নিয়োগ দেয়া হয়েছে নতুন প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগে আরও ৭ বিচারপতিকে। দ্রুত এই আমূল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে সুপ্রিম কোর্টের প্রতিটি সেকশনের চিত্রও। যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে সেকশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন। যে কারণে সেখানে অনেকটাই উধাও হয়ে গেছে ‘ঘুষবাণিজ্য’। আর ঘুষ বন্ধ হওয়ার পর মামলা প্রস্তুতের কাজ কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে।
দায়িত্ব হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত শিরীন শারমিনই স্পিকার: আইনজ্ঞদের অভিমত
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট দেশ ত্যাগ করার পর তার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা মামলা হচ্ছে দেশব্যাপী। এরপর রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেন; কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী স্বপদে থেকে যান জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী; কিন্তু গত ২৭ আগস্ট রংপুরে স্বর্ণশ্রমিক মুসলিম উদ্দিন (৩৮) নিহত হওয়ার ঘটনায় শিরীন শারমিন চৌধুরীসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়। এরপর গত ২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী নতুন কেউ দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত শিরীন শারমিন চৌধুরী স্পিকার পদে রয়েছেন বলে গণ্য হবে। নতুন নির্বাচন ছাড়া স্পিকার নির্বাচনের সুযোগ সংবিধানে নেই। তবে সংবিধান মেনে চলা না হলে বা বর্তমান সংবিধান বাতিল বা স্থাগিত হলে সেটা ভিন্ন বিষয়।
বিচারকশূন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমছে মামলা
কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটা হত্যা, গণহত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্তদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে একের পর এক মামলা হচ্ছে ট্রাইব্যুনালে। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ এখন সম্পূর্ণ বন্ধ। বর্তমানে বিচারকশূন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
রাজনীতিকে রাজপথ থেকে আদালতে আনা উচিত নয়
একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ববাদের অবসানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব পালন করছে। এই সরকার প্রতিহিংসার রাজনীতি করতে চাইবে, এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। কারণ এই সরকার মনে করে, মানুষের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক দল অন্যতম প্ল্যাটফর্ম। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিশ্চিতভাবে কিছু অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশে গুম, খুন, হত্যা ও অরাজকতার একটা অপরাধপ্রবণ জায়গায় জড়িয়ে পড়েছিল। তার অর্থ এই নয় যে, আওয়ামী লীগে কোনো ভালো নেতাকর্মী নেই। আওয়ামী লীগকে যারা সমর্থন করেন, তাদের রাজনৈতিক অধিকার, তাদের একটা আদর্শকে সমর্থন করার অধিকার থাকবে না, আমি তা বিশ্বাস করি না।
‘জুলাই গণহত্যার’ বিচার কি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সম্ভব?
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বুধবার (১৪ আগস্ট) বলেছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় জুলাই গণহত্যা ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীনে বিচার করা সম্ভব।
আইনের মধ্যে থেকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন সম্ভব
ছাত্র ও জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করায় তার মন্ত্রিসভার সব সদস্য পদত্যাগ করেছেন বলে ধরে নিতে হয়। এরপর গত মঙ্গলবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এখন দেশে কোনো সরকার নেই। তাই দেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হতে যাচ্ছে। শুনেছি সেই সরকারের প্রধান হিসেবে এরই মধ্যে মনোনীত করা হয়েছে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। তার নেতৃত্বে গঠিত হতে যাচ্ছে নতুন এই সরকার।
১১ বছরেও শেষ হয়নি বিচার, রানা বাদে সব আসামি জামিনে মুক্ত
সাভারে রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় হত্যা মামলার বিচার শেষ হয়নি; উপরন্তু এ মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা ছাড়া বাকি সব আসামি জামিনে আছেন। আবার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সেই ভবন নির্মাণে ত্রুটি থাকার অভিযোগে করা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা আইনের মামলাটির বিচারেও অগ্রগতি নেই। প্রতি বছর ২৪ এপ্রিল হলেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ওই ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের স্মরণ করা হয়। দেশের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, নিহত শ্রমিকদের স্বজনরা দাবি তোলেন ন্যায় বিচারের; কিন্তু দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় বিচার আর মেলে না।
থামেনি নারীর প্রতি যৌন হয়রানি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) জরিপে উঠে এসেছে, বর্তমানে ৭১ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং ৩৯ শতাংশ কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি থাকলেও কার্যকর মাত্র ৪৪ শতাংশ। তাই নারীর প্রতি যৌন নির্যাতন ও হয়রানি প্রতিরোধ-সংক্রান্ত হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
৪২ লাখ মামলার জটে জর্জরিত বিচারালয়
মামলার ভারে জর্জরিত দেশের সব আদালতে প্রতিদিনই জমা হচ্ছে নতুন নতুন মামলা। যে কারণে কিছুতেই কমছে না মামলার জট। সুপ্রিম কোর্ট ও বিভিন্ন বিচারিক আদালতে বর্তমানে ৪২ লাখেরও বেশি মামলা বিচারাধীন। মামলার দীর্ঘসূত্রতা, অযাচিত মামলা, করোনা মহামারি চলাকালে দুই বছর বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত, অনেক ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের কালক্ষেপণের মতো কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আইনজ্ঞরা।