মায়ের দুধের বিকল্প নেই
ফর্মুলা দুধের আধিপত্য বন্ধ করুন
নবজাতক শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত কেবল বুকের দুধ খাওয়ালে শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করা যায় এবং কমে মৃত্যুঝুঁকি; কিন্তু দেশে জন্মের প্রথম ছয় মাসে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার বাড়ছে না। বরং শহর এলাকায় এ হার দিন দিন কমে যাচ্ছে। তা ছাড়া বুকের দুধ খাওয়াতে চান এমন মায়েরা পাচ্ছেন না সঠিক দিক-নির্দেশনা। অন্যদিকে ফর্মুলা দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ আসে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের কাছ থেকে। ফলে দেশজুড়ে বাড়ছে নবজাতক শিশুর স্বাস্থ্য ও মৃত্যুঝুঁকি, যা দেশের জন্য অশনিসংকেত।
শিশু যখন ভূমিষ্ঠ হয়ে পৃথিবীর আলো-বাতাস অনুভব করে, তখন তার প্রয়োজন হয় নিরাপত্তার। মা এবং মায়ের দুধ এ সময় তাকে সম্পূর্ণভাবে নিরাপত্তা প্রদান করে। এভাবে মায়ের দুধ মা ও শিশুর ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে কাজ করে। সেইসঙ্গে উভয়ের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে, মায়ের বুক খুঁজে নেয়ার প্রবৃত্তি নিয়েই শিশুরা জন্মায়। তাই মায়ের দুধ খেলে শিশুর অসুখ হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ বলছে, নবজাতকের জন্মের ১ ঘণ্টার মধ্যে মায়ের দুধ পান করানো গেলে ৩১ শতাংশ শিশুমৃত্যু কমিয়ে আনা যেত। বিশ্বে প্রতি বছর ৪০ লাখ নবজাতক মারা যায়। পাশাপাশি পরিবারের আর্থিক খরচ বেড়ে যায়।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফর্মুলা দুধ খায় এমন শিশুদের ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিউলাইটিস, মেনিনজাইটিস, অ্যালার্জিসহ নানা ধরনের সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এই শিশুরা বড় হয়ে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসেও বেশি আক্রান্ত হয়। যারা বুকের দুধ খাওয়ান, সেই মায়েদের স্তন ও জরায়ু ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা কম।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, চিকিৎসকের রুম থেকে ব্যবস্থাপত্র হাতে শিশুর অভিভাবকরা বের হলেই ঘিরে ধরেন ওষুধ কিংবা ফর্মুলা দুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। দেখেন চিকিৎসক তাদের কোম্পানির ওষুধ লিখেছেন কি না, ফর্মুলা দিয়েছেন কি না। ছবি তোলেন। মূলত চিকিৎসকরা ফর্মুলা দুধ কোম্পানির কাছ থেকে উপঢৌকন নিয়ে থাকেন। তাই ফর্মুলা দুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা এভাবে হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যবস্থাপত্র চেক করে দেখেন চিকিৎসকরা তাদের কোম্পানির ফর্মুলা দুধ লিখেছেন কি না।
ডব্লিউএইচও এবং ইউনিসেফের যৌথভাবে করা ‘ফর্মুলা দুধের বিপণন কীভাবে শিশুকে খাওয়ানোর বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে’ শীর্ষক জরিপ বলছে, মা হয়েছেন এমন ৯৮ শতাংশ নারীর প্রবল ইচ্ছা ছিল ছয় মাস পর্যন্ত শিশুকে কেবল বুকের দুধ খাওয়ানোর; কিন্তু সঠিক পরামর্শের অভাবে তারা পারেননি। প্রসব-পরবর্তী অবস্থায় শিশুকে ফর্মুলা দুধ দেয়ার ৬০ শতাংশ পরামর্শ দেন পেশাদার স্বাস্থ্যসেবাদাতারা। তথ্য বলছে, ঘরে জন্ম নেয়া শিশুদের তুলনায় হাসপাতালে জন্ম নেয়া শিশুরা ফর্মুলা দুধ পায় ২০ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে ফর্মুলা দুধের প্রচার জোরেশোরে এখন চলছে অনলাইনে। ফর্মুলা দুধ কোম্পানির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পেজ রয়েছে। চিকিৎসকরাও ইউটিউবে ফর্মুলা দুধের পরামর্শ দিয়ে কনটেন্ট তৈরি করেন। মায়েদের বিভিন্ন গ্রুপে ফর্মুলা দুধের গুণগান করা হয়। এমন গুণগান শুনে অনেক মা-ই ফর্মুলা দুধ দেন।
কিন্তু দেশের বিদ্যমান আইন বলছে, প্রকাশ্য বা অনলাইনে ফর্মুলা দুধের প্রচার ও ব্যবস্থাপত্রে ফর্মুলা দুধ লেখা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবু কেন শাস্তিযোগ্য এসব ফৌজদারি অপরাধ প্রকাশ্যেই ঘটছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো পর্যবেক্ষণ না হওয়ার ফলে এবং শাস্তি হয় না বলেই দিন দিন ফর্মুলা দুধের আগ্রাসন বাড়ছে। তা ছাড়া এখন পর্যন্ত এ ধরনের অপরাধে কেউ শাস্তি পেয়েছেন- এমন কোনো নজির নেই। ফলে গুঁড়া দুধ কোম্পানি অবাধে তাদের পণ্য প্রচার ও প্রসারের সুযোগ পাচ্ছে। সে জন্য মায়েরা প্রভাবিত হচ্ছেন।
এমতাবস্থায় ফর্মুলা দুধের আধিপত্য কমাতে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে বিদ্যমান আইনটি সম্পর্কে অংশীদারদের সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি আইন লঙ্ঘনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে