‘মব ডেভিলদের’ থামান
দায়িত্ব নেয়ার পরদিন থেকে মব ও আন্দোলন মোকাবিলা করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাতে সফলতা যে খুব একটা নেই, তার সর্বশেষ উদাহরণ অমর একুশে বইমেলা। সব্যসাচী প্রকাশনীর স্টলে ‘বিতর্কিত’ লেখক তসলিমা নাসরিনের বই রাখার অভিযোগে সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) একদল বিক্ষুব্ধ লোকের রোষানলে পড়েন শতাব্দী ভব নামে একজন লেখক। পুলিশের সাহায্যে মেলা থেকে বের করে নেয়া হয় তাকে। এ সময় প্রকাশ্যে লেখককে ক্ষমা চাইতে হয়। এর পরপরই সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয় স্টলটি। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ জানায়, সাময়িক বন্ধের পর স্টলটি খুলে দেয়া হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে টাস্কফোর্সের সভার পরে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, তসলিমা নাসরিনের বই বিক্রি করা দেখে সব্যসাচীর স্টলে ভিড় করে একদল লোক। লেখক শতাব্দী ভব তখন সেখানেই বসেছিলেন।
তসলিমা নাসরিনের বই কেন বিক্রি করছেন- এমন প্রশ্নকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে শতাব্দী ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিলে উত্তেজিত লোকজন তাকে মারতে যায়। এ সময় তাকে কানে ধরে ক্ষমা চাওয়ার দাবিও ওঠে। এক পর্যায়ে তিনি হাতজোড় করেন এবং পুলিশ তাকে নিয়ে চলে যায়। প্রসঙ্গত, এ ঘটনার আগে থেকেই স্টলে তসলিমা নাসরিনের বই রাখার কারণে সব্যসাচী প্রকাশনীকে হুমকি দেয়া হচ্ছিল। ফেসবুকে কেউ কেউ সব্যসাচীর স্টল বন্ধ করে দেয়ারও দাবি জানান।
প্রশ্ন হলো, বইমেলার এই ঘটনাটি কি নিছকই একটি মব নাকি এর পেছনে অন্য কিছু রয়েছে? গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে মব জাস্টিসের নামে যে একের পর এক মব ভায়োলেন্স হচ্ছে, বইমেলার এই ঘটনাটি কি তারই ধারাবাহিকতা এবং অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই যে ইনক্লুসিভনেস বা ঐক্যের কথা বলছে, এই ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়ে সরকারের সেই অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে কি না? একের পর এক ঘটনা ঘটলেও সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কার্যত কিছু করতে পারছে না। সম্প্রতি ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে, ক্যাম্পেইন করে ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হলেও তারা সেটি প্রতিহত করেনি। এমনকি সেনাবাহিনীর একটি দল সেখানে উপস্থিত হলেও তারা সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতের এই ঘটনার পরদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অনেক নেতার বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়। আগুন দেয়া হয়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোথাও এ ধরনের ঘটনা প্রতিহত করেছে, এমন খবর পাওয়া যায়নি। তাতে এই প্রশ্ন ওঠাও অস্বাভাবিক নয় যে, সরকার কি তাহলে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে সমর্থন দিয়েছে এবং লোক দেখানোর জন্য ঘটনার পরে কড়া ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে? সরকার চাইলে কি এই ঘটনাগুলো ঠেকাতে পারতো না? যারা এই ঘটনা ঘটাচ্ছে, তারা কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সরকারের চেয়েও বেশি শক্তিশালী?
গত মাসে দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেয় স্থানীয় কিছু লোক। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হলে ৩০ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিৃবতি দেয়া হয় এবং স্থানীয় প্রশাসনকে খেলা আয়োজনের নির্দেশ দেয়া হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, কেউ যদি নারীদের অধিকার লঙ্ঘন বা বেআইনি বিধিনিষেধ আরোপের সঙ্গে জড়িত থাকে, তবে তার বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে। নাগরিকদের প্রতি বৈষম্য বা নিপীড়নের যে কোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে; কিন্তু এই হুঁশিয়ারির এক সপ্তাহ না যেতেই রংপুরের তারাগঞ্জে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেয়া হয় ‘তৌহিদী জনতা’ নামে কিছু লোকের প্রতিবাদের মুখে। এমনকি সেখানে ১৪৪ ধারাও জারি করে প্রশাসন। স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার হুঁশিয়ারির মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে কী করে এই ঘটনা ঘটলো?
যারা মব তৈরি করে একটি খেলা বন্ধ করে দিতে পারে, তারা কি সরকার, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেয়ে বেশি শক্তিশালী? স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন কেন খেলা বন্ধ করে দিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করলো? তারা কেন উত্তেজিত লোকদের দাবির বিপরীতে গিয়ে খেলা আয়োজনের ব্যবস্থা করতে পারলো না? এর মধ্য দিয়ে কার দুর্বলতা প্রকাশ পেলো? এই ঘটনায় স্বয়ং ড. ইউনূস ও তার সরকারকে বিব্রত করা হলো না? দেশের বাইরে এই ঘটনা কী বার্তা পৌঁছে দিলো? প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এইসব হুঁশিয়ারির পরেও কেন পিটিয়ে হত্যা বা মব জাস্টিসের নামে এইসব মব অ্যানার্কি থামছে না? রাষ্ট্রের এই বার্তা তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না? তারা কি সরকারের এইসব নির্দেশনা আমলে নিচ্ছে না নাকি কোনো একটি গোষ্ঠী চাচ্ছে দেশে এইসব নৈরাজ্য বাড়তে থাকুক- যার সুযোগ নিয়ে তারা অন্য কোনো স্বার্থ হাসিল করবে?
বইমেলায় যেদিন এই অপ্রীতিক ঘটনাটি ঘটলো, সেদিন সন্ধ্যায় দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল। বৈঠক শেষে বেরিয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, তারা দেশের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর বিষয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। বিএনপি মনে করে এসব ঘটনায় সরকার তার দায় এড়াতে পারে না। কারণ সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর সামনেই একের পর এক ঘটনাগুলো ঘটেছে। তবে বইমেলার এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তার কার্যালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মেলায় নিরাপত্তা জোরদার করা এবং এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যেন কোন অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে, তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে লিখেছেন: যারা মব করবে, তাদেরকে ডেভিল হিসেবে গণ্য করা হবে। বইমেলার এই ঘটনার পর আর কোন অনুরোধ করা হবে না। কথিত আন্দোলন আর মবের মহড়া এখন থেকে সরকার শক্ত হাতে মোকাবিলা করবে। রাষ্ট্রকে অকার্যকর ও ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা করা হলে একবিন্দু ছাড় দেয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ার করেন মাহফুজ আলম। যদিও এই পোস্টের কারণে সোশ্যাল মিডিয়ায় মাহফুজ আলমেরও সমালোচনা শুরু হয় এবং পরে তিনি আরেকটা পোস্ট দিয়ে লিখেছেন যে, তিনি ‘তৌহিদ জনতা’কে ভয় দেখাননি, বরং সতর্ক করেছেন। অনেকেই মনে করেন, শুরু থেকেই যদি মবকারীদের ‘ডেভিল’ বা অপশক্তি হিসেবে বিবেচনা করে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতো, তাহলে একের পর এক এই ধরনের ঘটনা ঘটতো না।
বস্তুত যারা এই ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে, বিশেষ করে ‘তৌহিদী জনতা’র নামে যারা ইসলামের সেবা করতে চাচ্ছে বা করছে বলে মনে করছে, তারা ইসলামের ধারেকাছেও নেই। তারা উগ্রবাদী। কেননা ইসলামে উগ্রবাদের কোনো জায়গা নেই। ইসলাম সব সময় সহনশীলতা ও পরমতসহিষ্ণুতার কথা বলে। পবিত্র কোরানের সুরা হামিম সিজদায় বলা হয়েছে: ‘ভালো ও মন্দ সমান নয়। জবাবে তুমি তাই বলো যা উত্তম। ফলে দেখবে, তোমার সঙ্গে যার শত্রুতা রয়েছে, সেও পরম বন্ধুতে পরিণত হবে।’ সুতরাং ইসলামের এত সুন্দর মর্মবাণী অনুধাবন না করে কাউকে নাস্তিক বা মুরতাদ ঘোষণা করে আক্রমণ করা ইসলামের মূল দর্শনের পরিপন্থি। তাছাড়া তৌহিদী জনতার প্রতিবাদ ও মবের নামে যা হচ্ছে তার মধ্য দিয়ে প্রথমত তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে বিতর্কিত করছে।
দ্বিতীয়ত তারা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করছে একটি উগ্র মৌলবাদী দেশ হিসেবে। তৃতীয়ত তারা দেশের মানুষের মধ্যেই নিরাপত্তাহীনতার বোধ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। চতুর্থত তারা ইসলাম সম্পর্কে মানুষের মনে ভুল ধারণা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। অতএব তারা শুধু দেশের নয়, ইসলামেরও শত্রু। সুতরাং সরকারের উচিত হবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আপোস না করে শক্ত অবস্থান গ্রহণ। গত ৫ আগস্টের পর থেকে এরকম যতগুলো মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটেছে তার ভিডিও ফুটেজ দেখে সামনের সারিতে থাকা তথা নৃশংসতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে সরকারের সদিচ্ছার প্রমাণ দেয়া উচিত এবং ভবিষ্যতে আর একটিও মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটবে না এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কোনো ধরনের উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করলে সঙ্গে সঙ্গে তাতে আইনের আওতায় আনতে হবে। সেজন্য সরকারের সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং জোরদার করতে হবে।
দল-মত ও গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার ব্যাপারে সরকারকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। ‘ডেভিল’ বলতে শুধু একটি দল বা গোষ্ঠীকে চিহ্নিত না করে সরকারের ভেতরে কিংবা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠদের মধ্যেও যদি ডেলিভ ফোর্স বা অপশক্তি থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। উপরন্তু কেউ এই ধরনের মব ভায়োলেন্সকে ইনিয়ে-বিনিয়ে বা নানাবিধ যুক্তি দাঁড় করিয়ে জাস্টিফাই বা জায়েজ করতে চাচ্ছে কি না, সে বিষয়েও সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। না হলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে বার্তা যাচ্ছে, তাতে ড. ইউনূসের মতো একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষের ভাবমূর্তি যেমন প্রশ্নের মুখে পড়বে, তেমনি জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে যে একটা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, সেটি ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, পরিবর্তন ও সংস্কারের এমন সুযোগ বারবার আসবে না। এটা ব্যর্থ হলে দেশ আরও বড় অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবে।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে