ক্যামেরার কবির সেলুলয়েড বন্দনা
আগে যদি আমাকে বলা হতো, ডকুমেন্টারি তৈরি করা হবে- তাও আবার বাংলাদেশের একজন আলোকচিত্রীকে নিয়ে, তাহলে কাজটি যত্নের সঙ্গে করা হবে কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ থাকত; কিন্তু সম্প্রতি মকবুল চৌধুরীর করা ‘Nasir Ali Mamun in Praise of Shawdows’ (ছায়াবন্দনা) দেখে অপরাধবোধ হয়েছে। আমার জমাট ধারণাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছেন ডকুমেন্টারির কারিগর জনাব মকবুল। প্রেম, কঠোর পরিশ্রম, গভীর গবেষণা এবং অপরিসীম ধৈর্যের যোগফল আলোকচিত্রকলার জীবন্ত কিংবদন্তি নাসির আলী মামুনকে নিয়ে করা এই ডকুমেন্টারি।
এমন সময় ডকুমেন্টারিটা দেখলাম, যখন নেটফ্লিক্সসহ আন্তর্জাতিক ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো ডকুমেন্টারির প্রথাগত ভাষা ভেঙে নতুন ভাষার জন্ম দিচ্ছে, প্রতিনিয়ত চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এই বাস্তবতায় মকবুল চৌধুরীর ‘Nasir Ali Mamun in Praise of Shawdows’ বা ‘ছায়াবন্দনা’ আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বিশ্ববাজারে জায়গা করে নিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনকে এখন ও ভবিষ্যতে পাঠ করতে এই ডকুমেন্টারি টেক্সটবুক হিসেবে কাজ করবে- তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
‘ছায়াবন্দনা’র প্রথম প্রিমিয়ার শো হয় ১০ মে (২০২৪), রাজধানীর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে। শুরু হওয়ার কথা ৪টায়, সাড়ে ৩টায় পৌঁছে দেখি মানুষ আর মানুষ! না, কোনো চিত্রকর্ম প্রদর্শনী দেখতে নয়- একজন নিভৃতচারী আলোকচিত্রীর জীবন ও কর্ম নিয়ে নির্মিত একটি তথ্যচিত্র দেখতেই এই ভিড়। শুধু আলোকচিত্রীরাই আসেননি, চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, স্থপতি, অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পী, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ- কারা ছিলেন না সেদিন! মিলনায়তনের ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি দর্শক। অনেকে মাটিতে বসে, পেছনে দাঁড়িয়ে শো উপভোগ করেছেন। এই চিত্র থেকে সহজেই বুঝা যায়, মানুষ ‘ছায়াবন্দনা’কে সাদরে গ্রহণ করেছে। তার ফলশ্রুতিতে এখন এই তথ্যচিত্র সারা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আশা করছি, বিদেশ ভ্রমণেও বের হবে।
নাসির আলী মামুন সৃষ্ট পোর্ট্রেট আলোকচিত্রগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য- ‘সহজিয়া’ উপস্থাপন। নাসির আলী মামুন যদি পথিকৃৎ হয়ে মাথার ওপর না থাকতেন, আর আমাকে যদি বলা হতো কবি আহসান হাবীবের ছবি তুলতে, তাহলে আমি কীভাবে তুলতাম? আমি কবিকে বলতাম, পাঞ্জাবি পরুন, পাঞ্জাবির ওপর একটি চাদর পেঁচিয়ে নিন; তারপর তাকে বলতাম, একটি বইয়ের আলমারির দিকে পিঠ করে দাঁড়াতে। এভাবে ছবি হয়তো করা হয়ে যেত; কিন্তু সত্যিকার আহসান হাবীব কি সেই ছবিতে ধরা দিতেন? নাসির আলী মামুন কিন্তু আহসান হাবীবের ছবি তুলতে কোনো আয়োজনে যাননি, তার ছবিতে কবি স্যান্ডো গেঞ্জি পরা! তাতে কবির প্রতিকৃতি একটুও ম্লান হয়নি বরং উদ্ভাসিত, উদ্ঘাটিত হয়েছে। যেন আলোর ছেনি দিয়ে কালো পাথরে খোদাই করা ভাস্কর্য। এই ছবি বাড়তি যে তথ্য দেয়- তা হলো, কবির জীবন ছবির মতোই সহজিয়া।
এটি একটি উদাহরণ মাত্র। সেই সত্তরের দশকের গোড়া থেকে এখন পর্যন্ত নাসির আলী মামুন যে মুখগুলো ক্যামেরাবন্দি করেছেন সেগুলোর অন্যতম প্রধান সুর- ‘জীবন যেখানে যেমন’, কোনো আড়ম্বর নেই, নেই কারিগরিক ঝনঝনানি। আবার এই সহজিয়া আলোকচিত্রচর্চাই পরবর্তীতে আলোকচিত্রীদের ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলল। তখন থেকে এখন পর্যন্ত নাসির আলী মামুন যতটা প্রভাব ফেলতে পেরেছেন আর কেউ ততটা পারেননি। এখনো নাসির আলী মামুনের মতো করে তোলা পোর্ট্রেটই ‘ভালো পোরট্রেট’ হিসেবে বিবেচিত হয়! এই তথ্যচিত্রে প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলামও বলেছেন, ‘তার (মামুন) ছবি দেখলে বুঝা যায় এটি নাসির আলী মামুনের ছবি- এটি সহজ ব্যাপার নয়।’
আমি মনে করি, কবি শামসুর রাহমান কথার কথা হিসেবে তাকে ‘ক্যামেরার কবি’ বলে অভিহিত করেননি, তিনি তা বিশ্বাসও করতেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আগাগোড়া সমস্তই স্পষ্ট, সমস্তই পরিষ্কার, সে কেবল ব্যাকরণের নিয়মের মধ্যে থাকিতে পারে; কিন্তু প্রকৃতিতেও নাই, কাব্যেও নাই।’ ‘ক্যামেরার কবি’র ছবিগুলোও কবিতার মতোই- এই আলো, এই ছায়া। ‘…আলো-আঁধারের ঘটল সংগম, দেখা দিল রূপ, জেগে উঠল রস’- শেষে রবি ঠাকুরের এই পঙক্তির সমার্থক হয়ে ওঠে নাসির আলী মামুনের একেকটি আলোকচিত্রকর্ম।
নাসির আলী মামুন যতটা ‘সিমপ্লিসিটি’ সমেত বিশিষ্টজনদের মুখের ছবি তার ক্যামেরায় ধারণ করেছেন, নির্মাতা মকবুল চৌধুরী ততটা সহজ করেই তথ্যচিত্রে নাসির আলী মামুনকে ফুটিয়ে তুলেছেন। জনাব মামুন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি এই তথ্যচিত্রে নিজেকে বিস্তৃতভাবে খুঁজে পেয়েছেন। সত্যিই তাই, একজন দৃশ্যশিল্পী নাসির আলী মামুনকে সামগ্রিকভাবে খুঁজে পেতে এই মুহূর্তে মকবুল চৌধুরী নির্মিত ‘ছায়াবন্দনা’র কোনো বিকল্প নেই।
একযুগ আগে আমাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নাসির আলী মামুন বলেছিলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, একাকী ও নিঃসঙ্গ। আমার কোনো বন্ধু নেই। খুব মেধাবী মানুষের কোনো বন্ধু হয় না; কিন্তু মারা যাওয়ার পর তাদের অনেক বন্ধু আসে। আমি মনে করি, আমি সেই গোত্রের লোক। যেই গোত্রে মানুষের বন্ধু থাকে না; কিন্তু শত্রু অনেক থাকে। আমি গত ৪০ বছরে আমার আশপাশে দেখছি সব কুমির, সাপ হাঁ কইরা দাঁড়াইয়া আছে। এগুলোর মধ্য দিয়াই আমি ৪০ বছর ধরে প্রবাহিত হইয়া আসছি। পাঁচটি প্রজন্ম আমার ক্যামেরায় ধরা পড়ছে। বাংলাদেশের মিডিয়াসহ শিল্প-সংস্কৃতি জগৎ যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের পার কইরা আমি এতদূর আসছি। এখনো চলতাছি। এরা হাঁ কইরা তাকাইয়া আছে, কেউ খামচি দিতাছে, কেউ গুলি করতাছে, কেউ মারতাছে... মাইর খাইতে খাইতে এই পর্যন্ত আসছি। এখন আর আমার মৃত্যু নাই।’
‘ছায়াবন্দনা’য় এই স্বতন্ত্র, একাকী ও নিঃসঙ্গ নাসির আলী মামুনকে পাওয়া যায়। এটিকে Observational documentary বা পর্যবেক্ষণমূলক তথ্যচিত্র বলা যায়। যেখানে ক্যামেরা দিয়ে ‘ক্যামেরার কবি’র নিঃসঙ্গ অভিযাত্রাকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। তথ্যচিত্রে দেখি নাসির আলী মামুন একা হেঁটে চলেছেন দেশ থেকে দেশান্তরে, যেন এখনো তিনি তার মনের ছবির দেখা পাননি, তার খোঁজেই পথে পথে।
দেশের প্রথম প্রভাবশালী আলোকচিত্রীকে ক্যামেরার মাধ্যমে নতুন করে উপস্থাপন করাটা মকবুল চৌধুরীর জন্য সহজ ছিল না। তিনি ক্যামেরার কারুকাজ দিয়েই তথ্যচিত্রটি সাজিয়েছেন, ধারাভাষ্য নেই, নেই নিজস্ব বক্তব্য আরোপের চেষ্টা। নাসির আলী মামুনকে যারা দীর্ঘদিন ধরে জানেন, শ্রদ্ধা বা স্নেহ করেন, তারাই বলেছেন তার সম্পর্কে। অনেকের কথা আছে, সেগুলোকে একটি সুতায় গেঁথে মালা বানিয়ে আমাদের উপহার দিয়েছেন নির্মাতা। মকবুল চৌধুরীর মুনশিয়ানার কারণে তথ্যচিত্রটি তথ্যে ভারাক্রান্ত না হয়ে কাব্যিক হয়েছে। জনাব মকবুল বলেছেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি জনাব মামুনের ছবির অনুরাগী। সেই অনুরাগের ছোঁয়া এই তথ্যচিত্রের পরতে পরতে। তিনি মনে করেন, শিল্পী হিসেবে নাসির আলী মামুনের জীবন থেকে শেখার আছে।
তথ্যচিত্রে প্রয়াত শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক আনিসুজ্জামান বলেছেন, নাসির আলী মামুন ব্যক্তিকে দেখে, তার সঙ্গে শিল্পকে যোগ করে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত জনাব মামুন কীভাবে আলোকচিত্রচর্চায় শিল্পটাকে অটুট রাখতে পারলেন? চর্চাটাকে জীবিকার অবলম্বন না করে জীবনযাপনের সঙ্গী করার কারণে? এ জন্যই কি তিনি শিল্পকলার আলোচনা ও পঠনপাঠনে এত বেশি প্রাসঙ্গিক?
আরও দু-একটি প্রশ্ন তুলে শেষ করব। ‘ছায়াবন্দনা’য় সাক্ষাৎকারের সংখ্যা কিছু কম হলে কি ভালো হতো? সচেতনভাবেই কি জনাব মামুনের পরিবারের সদস্যদের বাইরে রাখা হয়েছে? যাতে শিল্পী হিসেবে তার নিঃসঙ্গতাকে সুস্পষ্ট করা যায়? নাসির আলী মামুনের জীবনযাপনের আরও গভীরে ক্যামেরা নামানো যেত কি না? যেমন- তিনি রান্না করছেন, গাছের যত্ন নিচ্ছেন, স্ত্রীর সঙ্গে সংসারের আলাপ করছেন, বাজারে যাচ্ছেন, লিখছেন (তিনি তো লেখকও), ছবি আঁকছেন (তিনি চিত্রকলাচর্চায়ও মন দিয়েছেন), বন্ধু-সুহৃদদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন…। নাকি দর্শক হিসেবে এই যে প্রত্যাশা বা অতৃপ্তি তাও থাকা জরুরি?
সুদীপ্ত সালাম : লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে