Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বিচার ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশনের সংকট, কাঠামোগত দুর্বলতা ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা

Hira  Talukder

হিরা তালুকদার

শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৩

দেশের আইন ও বিচার ব্যাবস্থা ডিজিটালাইজেশনের পথে অনেকটােই এগিয়ে গেছে। তবে এর ফলে কিছু সংকটও সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া ডিজিটালাইজেশনের কাঠামোগত দুর্বলতায় ভোগান্তিতে পড়ছে বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা। আছে আইন প্রয়োগে তথ্যপ্রযুক্ত ব্যবহারের সীমাবদ্ধতাও।

সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনে ‘স্ক্যানিং অ্যান্ড ডিজিটাইজেশন অব কেস ফাইলস’ এর আওতায় চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। সুপ্রিম কোর্টকে এই পুরো কাজে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে সরকারের আইসিটি বিভাগের অধীনে বাংলাদেশে কম্পিউটার কাউন্সিল। সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন শাখা থেকে পাঠানো ফাইলগুলোর প্রতিটি পৃষ্ঠা পরিষ্কার করা হচ্ছে। পরিষ্কার শেষে সেগুলো গ্রহণ করছেন অন্য কর্মীরা। ফাইল গ্রহণের পর মামলার নম্বর এবং কোন ধরনের মামলা সাল অনুযায়ী সেগুলো বারকোড দিয়ে এন্ট্রি করা হচ্ছে। এরপর মামলার ফাইল পাঠানো হচ্ছে স্ক্যানিং বিভাগের কর্মীদের কাছে। আধুনিক মেশিনে সেগুলো স্ক্যানিং করার পর সেগুলোর কোয়ালিটি কনট্রোল করা হচ্ছে। এরপর পুনরায় মামলার ফাইলটি বাইন্ডিং করে সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এভাবেই ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টে চালু ই-ফাইলিং পদ্ধতি হাইকোর্টের কোম্পানি ও অ্যাডমিরালটি বিষয়ক মামলা, আপিল, দরখাস্ত ই-ফাইলিং পদ্ধতিতে দায়ের করছেন আইনজীবীরা। তবে আইনজ্ঞদের মতে, এতো কিছুর পরেও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র বিচারিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে স্থায়ী অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন করা হয়নি। যে কারণে আইনের বিধান মতে ইতোপূর্বে ভার্চ্যুয়াল আদালত চালু হলেও নিম্ন আদালতে তা শুধু হাজতি আসামির জামিন শুনানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার আইন হলেও তা প্রয়োগে এখনো স্বতন্ত্র কোনো ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। যে কারণে আইনের পুরোপুরি সুফল মিলছে না।

২০২০ সালের ৯ মে আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ জারি করা হয়। সেই অধ্যাদেশের আওতায় ওই বছর ১২ মে ভার্চ্যুয়াল আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। তড়িঘড়ি করে আইন করা হলেও সেই আইন প্রয়োগে কার্যকর কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। যে কারণে মানুষের বিচার পাওয়ার সুযোগ সীমিত, ক্ষেত্রবিশেষে বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ অনেক দেশই বিচার বিভাগে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারে নতুন পদ্ধতি গড়ে তুলেছে। যেমন, যুক্তরাজ্যে কোভিড পরিস্থিতিতে শুরুর দিকে কিছুদিন আদালত বন্ধ ছিল। এরপর তারা তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য ক্লাউড ভিডিও প্লাটফর্ম (সিভিপি) নামে একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করেছে। সেখানে এখন শারিরীক উপস্থিতিতে বিচারের পাশাপাশি সিভিপি প্লাটফর্ম ব্যবহার করেও বিচারকাজ চলছে। যেসব কাজে আমাদের দেশে আদালতের বিভিন্ন শাখায় দৌড়াতে হয়, যুক্তরাজ্যে সিভিপির মাধ্যমে সেই কাজগুলো করে থাকে।

এদিকে বর্তমানে বিভিন্ন মামলায় ভিডিও বা অডিও রেকর্ড আদালতে উপস্থাপন করা হয়। যার সত্যতা ও গ্রহণ যোগ্যতা প্রমানের জন্য আদালত সিআইডির ফরেনসিক বিভাগে পাঠায়। এর রিপোর্ট আসতে ১৫ দিন থেকে দুই মাস পর্যন্ত লেগে যায়। অথচ বিচার বিভাগ ডিজিটালাইজেশনের আওতায় এসেছে বলা হলেও সেখানে নেই এসব অডিও-ভিডিওসহ বিভিন্ন ডিভাইসের তথ্য উপাত্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা।

প্রায় ১১ বছর আগে নেত্রকোনায় শিশু সৈকত অপহরণ ও হত্যা মামলায় ভিডিও বা স্থিরচিত্র, রেকর্ড ও কম্পিউটার ডিস্ককে সাক্ষ্য হিসেবে নেওয়া হয়েছিল নিম্ন আদালতে। কিন্তু সেগুলো যথাযথ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় হাইকোর্ট সাক্ষ্য আইন অনুসারে সেসব সাক্ষ্য গ্রহণ করেননি। এ হত্যা মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ সাক্ষ্য আইন সংশোধনের অভিমতসহ রায় দেন। রায়ে বলা হয়, ডিজিটাল ডকুমেন্টকে সাক্ষ্য হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে কোনো ব্যক্তির ফোনের কল লিস্ট বা কথোপকথনের কোনো মূল্য থাকে না।
বিচার ব্যবস্থায় সাক্ষ্য আইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মামলার প্রমাণ নির্ভর করে সাক্ষ্যের গুণাগুণের ওপর। দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় মামলায় সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণের পর মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সাক্ষী হাজিরে ব্যর্থতা, সাক্ষ্য গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষীর অনুপস্থিতি, সাক্ষীর ঠিকানা বদলসহ নানা ইস্যুতে এই সাক্ষ্য গ্রহণ রাষ্ট্রপক্ষের জন্য অসম্ভব হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে সাক্ষীর বক্তব্য ডিজিটাল মাধ্যমে রেকর্ড করে বিচারকাজে সংযুক্ত করা হলে তা দ্রুত বিচার নিশ্চিতে ভূমিকা রাখবে। উপমহাদেশে ১৮৭২ সালে ব্রিটিশ সরকার সাক্ষ্য আইন কার্যকর করে। ভারত প্রায় দুই দশক আগে এই সাক্ষ্য আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করেছে। অামাদের দেশের সাক্ষ্য আইনে 'অডিও-ভিজ্যুয়াল কনফারেন্স', 'আদালত প্রান্ত', 'ইলেকট্রনিক রেকর্ডস', 'ইলেকট্রনিক বিন্যাস', 'উপাত্ত', 'কর্তৃপক্ষ', 'ডিজিটাল সাক্ষ্য', 'দলিল', 'দূরবর্তী প্রান্ত', 'দৃশ্যমান বা কার্যত উপস্থিতি', 'ব্যক্তিগত উপস্থিতি'সহ বিভিন্ন শব্দের সংজ্ঞা বিদ্যমান নেই। সাক্ষ্য আইনে 'দূরবর্তী প্রান্ত' থেকে সাক্ষ্য বা উপস্থিতি গ্রহণ বা প্রদান নিশ্চিতের বিধান নেই। এতে সাক্ষ্য উপস্থাপন, প্রমাণ বা সাক্ষী ও পক্ষগণের ব্যক্তিগত উপস্থিতি গ্রহণ বা প্রদান নিশ্চিত করার বিধানাবলি সময় ও খরচসাপেক্ষ, যা বর্তমান মামলাজটের অন্যতম প্রধান কারণ।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন আইন ও বিচার ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশনের সংকট ও কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েই গেছে উল্লেখ করে ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, হাইকোর্টে মামলা দায়েরর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রের সাটিফাইড কপি ব্যবহার করতে হয়। যদি মামলা-সংশ্লিষ্ট সকল কাগজ পত্র অনলাইন বেইসড হত তাহলে বিচার কার্য আরো তরান্বিত হত এবং বিচার পার্থী লোকজনও কম হয়রানির শিকার হত। তাছাড়া উচ্চ আদালত কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ বা রায় এখনো অনলাইনের সাথে সাথে এনালগ পদ্ধতিতে পাঠাতে হয়। এতে বিচার প্রার্থীর হয়রানি কোনভাবেই কমছে না। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়,বিচার বিভাগে ডিজিটাইজেশনে চরম সংকট রয়েছে। কাঠামোগত উন্নয়নও হয়নি এখনো। যেটা খুব জরুরী।’

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‌‘বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশনের ফলে একদিকে কিছু সুফল যেমন এসছে, তেমনি সৃষ্টি হয়েছে সংকটেরও। কারণ ডিজিটালািইজেশনের কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েই গেছে। এছাড়া আইন প্রয়োগে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা তো প্রকট।

সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে ডিজিটাল আর্কাইভিং এবং ই-ফাইলিং ব্যবস্হাপনার উদ্বোধন করা হয়। মামলা জট থেকে মুক্তি পেতে আমাদের ভাচু‌র্য়াল কোর্টের বিকল্প নেই। করোনাকালীন সময়েও ডিজিটাল পদ্ধতিতে মামলা দায়ের ও শুনানী হয়েছে। যার ফলে বিচার প্রার্থী জনগন কিছুটা হলেও উপকৃত হয়েছে। কিন্তু বিচার বিভাগে ডিজিটাইজেশন শুরু হলেও এর নানা রকম সংকট রয়েছে।উদহারন হিসেবে বলতে পারি এখনও সংশ্লিষ্ট স্ব -স্ব স্থানে মামলা দায়ের করতে হয় এনালগ পদ্ধতিতে।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেআর খান রবিন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিশ্ব ডিজিটাইজেশনের যুগে আমাদের দেশের বিচার বিভাগ ডিজিটাইজেশনের জন্য মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। ই-জুডিশিয়ারি শীর্ষক এ প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে উল্লেখ সংখ্যক এজলাসকে ডিজিটাল এজলাসে রূপান্তরিত করা হবে মর্মে সরকারের সিদান্তের কথা বিভিন্ন প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে জানা যায়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে মামলা দায়ের থেকে শুরু করে আদেশ বা রায়ের অনুলিপি সবই মিলবে অনলাইনে। এতে মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়বে এবং জনগণ দ্রুত বিচার পাবার সম্ভবনা থাকবে। তথ্য প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিচার বিভাগে কিছুটা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। সে পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতেও। জুডিশিয়াল পোর্টাল, অনলাইন কজলিস্ট, ডিজিটাল ড্রাশবোর্ডের পর সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন মামলার নথি ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তরিত করা হচ্ছে।

অন্যদিকে বিচার প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ রয়েছে এবং স্ব- স্ব ক্ষেত্রে যথেষ্ট জনবল সহ উল্লেখ সংখ্যক অফিস ও টেকনিক্যাল সাপোর্টের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে যে পরিমাণ মামলার আধিক্য সে রকম জনবল সহ অফিস ও টেকনিক্যাল সাপোর্টের ব্যবস্থপনা নেই।তছাড়া ডিজিটাল বিচার ব্যবস্থায় স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অনেকেরই অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে।করোনাকালীন সময়ে ভার্চুয়ালী মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে যা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।বলতে গেলে আমাদের বিচার ব্যবস্থায় ডিজিটাইজেশনে এখনও কাঠামোগত দূর্বলতা রয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের বিচার ব্যবস্থায় তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার রয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতা। উদহরন হিসেবে বলা যায় সাক্ষ্য আইনের ৩,১৭,৩৪,৩৫, ৩৬, ৩৯,৪৫,৪৫-এ, ৪৭-এ, ৬৫-এ, বি, ৬৭-এ,৭৩-এ,বি ধারা সহ আরো কিছু সংখ্যাক ধারা সংশোধন করে ডিজিটাল সাক্ষ্যকে সাক্ষ্য আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।এছাড়াও অন্যান্য আইনে ডিজিটাল সাক্ষ্যকে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।কিন্তু ডিজিটাল সাক্ষ্যের সঠিকতা বা সত্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে উল্লেখ সংখ্যক ল্যাব না থাকায় তদন্ত কাজে বিলম্ব হওয়া সহ কোন কোন ক্ষেত্রে মিথ্যাভাবে মানুষ হয়রানির শিকার হবার সম্ভাবনা রয়েছে। আসলে বিচার বিভাগ প্রকৃত অর্থে ডিজিটাইজেশন হলে বিচার প্রার্থী সহ সবাই উপকৃত হবে। কিন্ত কোন কোন ক্ষেত্রে ডিজিটাইজেশন পদ্ধতি আবার কোন কোন ক্ষেত্রে এনালগ পদ্ধতি হলে সংশ্লিষ্ট সকলের ভোগান্তি বাড়ার সম্ভবনা থেকেই যায়। তাই বিচার বিভাগ সম্পূর্ন ডিজিটাইজেশনের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহনে আরো আন্তরিক হবেন, যা আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ