সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন
বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ বিরাজ করছে। এর মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি পদক্ষেপ হচ্ছে মুদ্রানীতি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, চরিত্রগত দিক থেকে তা সংকোচনমূলক। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তবে এই উদ্যোগ বিলম্বে নেয়া হয়েছে। আর যে মাত্রায় সংকোচন করা হচ্ছে, তা উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ততটা পর্যাপ্ত হবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ মূল্যস্ফীতি তো এক কারণে সৃষ্টি হয়নি। মূল্যস্ফীতির আরও অনেক কারণ রয়েছে। কাজেই শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির পেছনে যেসব কারণ কাজ করছে, তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে মার্কিন ডলারের সংকট। মার্কিন ডলারের স্বল্পতার কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। মার্কিন ডলার সংকট কাটাতে না পারলে শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক ঢালাওভাবে আমদানি ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছে; কিন্তু কিছু কিছু পণ্য আছে, যা আমদানি করতে না পারলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। অপ্রয়োজনীয় এবং বিলাসজাত পণ্য আমদানি কমানো গেলে সেটা ভালো হবে; কিন্তু শিল্পে ব্যবহার্য বিভিন্ন উপকরণ আমদানি কমানো কোনোভাবেই সংগত হবে না। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নামানো সহজ হবে না। মূল্যস্ফীতি যে পর্যায়ে আছে, তা হয়তো সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে আর বাড়বে না। কিন্তু এ মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা।
মূল্যস্ফীতির আর একটি বড় কারণ হচ্ছে সঠিকভাবে বাজার ব্যবস্থাপনা না করতে পারা। আমাদের দেশের বাজার ব্যবস্থা মুক্তবাজার অর্থনীতির সূত্র মেনে চলছে না। ইদানীংকালে আমরা দেখছি সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে নানা ধরনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হচ্ছে, যাতে বাজারে পণ্যমূল্য আর বৃদ্ধি না পায়। শুধু হুঁশিয়ারি দিয়ে কোনোভাবেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এ জন্য নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের উপযুক্ত প্রস্তুতি থাকতে হবে; কিন্তু সেই প্রস্তুতি কি আমাদের আছে? বাজার কীভাবে চলছে, এটা আমরা মোটামুটি জানি; কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অ্যাকশনে যেতে হবে। শুধু মুখের কথায় কাজ হবে না। আমাদের কম্পিটিশন আইনের আওতায় বাজার ব্যবস্থাপনা সঠিক এবং সুষ্ঠু করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের যেসব সুযোগ আছে, তা ব্যবহার করতে হবে। এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। আইনের আওতায় যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও উন্নতি হবে। মাঝে মাঝেই বাজারে কারসাজি করার যে প্রবণতা আমরা প্রত্যক্ষ করি, তা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা মাঝে মাঝেই কোনো পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এটা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
বাজারে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তৎপর আছে বলে শোনা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সিন্ডিকেট আছে কিন্তু সবক্ষেত্রে সিন্ডিকেট আছে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বাজারের আচরণ দেখে মনে হয়, এখানে কোনো একটি শক্তি বাজারকে ম্যানিপুলেট করছে। এটা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হচ্ছে নাকি অন্য কোনো উপায়ে হচ্ছে, এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝেই বাজার কেন অস্থির হয়ে ওঠে তার কারণ খতিয়ে দেখে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে। কারা এই কাজটি করছে কীভাবে করছে, তা খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কর্তৃপক্ষ খুচরা পর্যায়ে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়ে বাজারকে নিয়ন্ত্রণের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, সেটা তো কোনো সুফল দেয়নি। বাজারে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই যারা পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করে চলেছে, তাদের যদি ছুঁতে না পারেন, তাহলে পরিস্থিতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আসবে? বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করা যায় বাজরে হঠাৎ করেই কোনো পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হতেই থাকবে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজধানীর বাজারে গরুর গোশতের মূল্য হঠাৎ করেই কেজিপ্রতি ৮০০ টাকা থেকে কমে ৬০০ টাকায় নেমে আসে। আবার নির্বাচনের পর সেই গরুর গোশতের মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই গরুর গোশতের মূল্য কেজিপ্রতি ৭০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। আগামীতে আবারও তা ৮০০ টাকায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গরুর গোশতের মূল্যের এই হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ে ভিন্নরকম ব্যাখ্যাও আছে। যেসব গরুর গোশতের দাম কমানো হয়েছে, সেখানে হাড্ডি বেশি, চর্বি বেশি অর্থাৎ গরুর গোশতের গুণগত মান ছিল নিম্ন পর্যায়ের। হাড্ডি ও চর্বি বেশি পরিমাণে দেয়ার কারণে প্রকৃত গোশতের পরিমাণ ছিল কম। কাজেই ব্যবসায়ীরা গরুর গোশতের দাম যেভাবে কমিয়েছে বলে মনে হয়েছে, আসলে বিষয়টি ঠিক তা নয়। তারপরও বলব, বাজারে গরুর গোশতের মূল্য এভাবে হঠাৎ করেই কেন কমেছিল, আবার কেনই বা বৃদ্ধি পেল–এ ব্যাপারে কোনো সঠিক তথ্য আমার কাছে নেই। তাই এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। গোশতের মানে যে কারসাজি করা হয়েছে, তা কি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হয়েছে, না কি অন্য কোনোভাবে হয়েছে–সেটা আমি ঠিক জানি না। বিষয়টি খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্তত ৭৭টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পলিসি রেট ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেয়। এতে ব্যাংক ঋণের সুদের হারও আনুপাতিকভাবে বৃদ্ধি পায়। বাজারে মুদ্রা সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ে; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক যখন পলিসি রেট বাড়িয়েছিল, তখন তা বাজারে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। কারণ পলিসি রেট বাড়ানো হলেও ব্যাংক ঋণের ‘আপার ক্যাপ’ ৯ শতাংশে বহাল রাখা হয়। ফলে পলিসি রেট বাড়লেও ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি পায়নি। এতে বাজারে অর্থের জোগান না কমে বরং আরও বেড়েছে। এই অবস্থায় পলিসি রেট বৃদ্ধি করে বাজারে অর্থের জোগান কমানো তথা উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। গত জুলাই মাস থেকে স্মার্ট পদ্ধতিতে সুদহার নির্ধারণের পর বাজারে সুদ হার যেটা বেড়েছে, তা পর্যাপ্ত নয়। কারণ এই অবস্থায় ব্যাংকগুলো বাজার চাহিদার ভিত্তিতে সুদ হার নির্ধারণ করতে পারছে না। এই পদ্ধতির প্রভাব এখনো পুরোপুরিভাবে বাজারে পৌঁছায়নি। এই পদক্ষেপগুলো এসেছে বিলম্বে। ব্যাংক ঋণের সুদ হার বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে কি পারবে না, তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আগামী কয়েক মাসের মূল্যস্ফীতির প্রবণতা দেখে এটা অনুধাবন করা যেতে পারে।
একটি দেশ বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে কত শতাংশ মূল্যস্ফীতি সহনীয় হতে পারে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি শূন্যের দিকে যাবে এটা আশা করা বাস্তবসম্মত নয়। একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমি মনে করি, গড় মূল্যস্ফীতির হার যদি ৪ বা ৫ শতাংশের নিচে রাখা যায় তাহেলে সেটাকে সহনীয় বলা যেতে পারে। একই সঙ্গে মজুরির হার যদি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে, তাহলে তাকে সহনীয় বলা যেতে পারে।
মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। মার্কিন ডলারের যে সংকট দেখা যাচ্ছে, তা দূরীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। আর মুদ্রানীতিতে যে সংকোচনমূলক অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে যতদিন পর্যন্ত না মূল্যস্ফীতি কমে সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে। ডলারের বর্তমান সংকট কাটাতে হলে যে কোনোভাবেই হোক ডলারের জোগান বাড়াতে হবে এবং ডলার ব্যয়ের পরিমাণ কমাতে হবে। মার্কিন ডলারের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জোগান আমরা পাই রেমিট্যান্স থেকে। রেমিট্যান্স যাতে ফর্মাল চ্যানেলে আসে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। ফর্মাল চ্যানেলে যারা ডলার ক্রয় করেন তারা যদি ইনফর্মাল মার্কেটের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক রেট অফার করতে না পারেন, তাহলে ডলারের জোগান বাড়ানো যাবে না। মূলত এ কারণেই বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করার কথা বলা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, তারা বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করতে চাচ্ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে তারা অতিরিক্ত সময় নিচ্ছেন। কারণ সংকট এখন বর্তমানে কাজেই যেসব ব্যবস্থা নেয়ার তা এখনই নিতে হবে।
আমরা যদি শুধু বলতেই থাকি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হবে; কিন্তু যদি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে সৃষ্ট সংকট কাটবে না। মার্কিন ডলারের বিনিময় হার যদি বাজারভিত্তিক করা হয়, তাহলে আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে বলে কেউ কেউ বলছেন; কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত ঠিক নয়। কারণ আমদানিকারকরা বর্তমানে প্রতি মার্কিন ডলার ১২২/১২৩ টাকা দামে কিনছেন। এটা বাফেদা নির্ধারিত রেটের চেয়ে অনেক বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক ঘোষণা না দিলেও ইতিমধ্যেই ডলারের মূল্য বাজারের মধ্যে ঢুকে গেছে। মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলে ডলারের জোগান বৃদ্ধি পাবে। আর আমদানি ব্যয় কমানোর ক্ষেত্রে মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও আরও অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করার আছে।
বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বৃদ্ধি পাবে। সেই অবস্থায় বর্তমান আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণের জন্য যে কড়াকড়ি করা হচ্ছে, তা শিথিল করা সম্ভব হতে পারে। এতে বাজারে পণ্যের জোগান বৃদ্ধি পাবে যা, চূড়ান্ত পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। রপ্তানিকারকদের অনেকেই রপ্তানি আয়ের একটি অংশ বিদেশে রেখে দিচ্ছেন। তারা মনে করছেন, স্থানীয় মুদ্রার বিপরীতে মার্কিন ডলারের মূল্য আরও বৃদ্ধি পেলে এই অর্থ দেশে আনব। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলে রপ্তানিকারকরা তাদের রপ্তানি আয়ের পুরোটাই দেশে আনার জন্য উদ্বুদ্ধ হবেন। অর্থ পাচারের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের দমন করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক লিড ইকোনমিস্ট, বিশ্বব্যাংক, ঢাকা অফিস।
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে