ছায়ানট থেকে চিরবিদায় নিলেন সনজিদা খাতুন
‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে’- এই গানের মতোই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন বাঙালি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আলোকবর্তিকা, ছায়ানটের সহ প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি সনজিদা খাতুন। বুধবার (২৬ মার্চ) দুপুরে ছায়ানট প্রাঙ্গণে তার মরদেহ আনা হয়। এরপর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার সহকর্মী, শিক্ষার্থী ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন শিল্পীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। ফুলেল শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে সনজিদা খাতুনের মরদেহ রাখার বেদী। সহকর্মী এবং শিক্ষার্থীরা গান গেয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানান।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা তার কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। তারা বলেন, সনজিদা খাতুন ছিলেন বটগাছের মতো। তার চলে যাওয়া বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শূন্যতার সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তার অবদান ভোলার মতো নয়।
সনজীদা খাতুন গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের মেয়ে সনজীদা খাতুন ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শিক্ষাজীবন শুরু করেন কামরুন্নেসা স্কুলে। এরপর ইডেন কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। পরে তিনি শান্তি নিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করার পর, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৭৮ সালে পিএইচডি করেন। দীর্ঘদিন অধ্যাপনা শেষে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে অবসর নেন।
সনজীদা খাতুনের লেখার অধিকাংশ অংশ জুড়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি কবিগুরুকে ব্যাপকভাবে জনমানসে পৌঁছে দেয়ার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালে তিনি শুদ্ধ সংগীতের চর্চা করতেন এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তখন তাকে সহযোদ্ধারা ‘মিনু আপা’ নামে ডাকতেন।
১৯৬০-এর দশকের শুরুর দিকে, বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি নিবেদিত প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সনজীদা খাতুন। তার নেতৃত্বে ছায়ানট আজ বিশ্বব্যাপী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও নৃত্যের প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তিনি জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। নালন্দা শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন ছাড়াও তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানিত ফেলো ছিলেন।
সনজীদা খাতুন ভারত সরকারের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’সহ একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি ১৬টি বই রচনা করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সাংস্কৃতিক মুক্তিসংগ্রাম’, যা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও বাঙালির সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ইতিহাস ধারণ করে এবং ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’, যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদান নিয়ে লেখা। এছাড়া তার অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ’, ‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে’ এবং ‘রবীন্দ্রনাথ: তাঁর আকাশ ভরা কোলে’ প্রভৃতি।
তার সম্পাদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘রইল তাঁহার বাণী: রইল ভরা সুরে’ এবং ‘গীতবিতান: তথ্য ও ভাবসন্ধান’।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে