চীন-ভারত ঘনিষ্ঠতা, ট্রাম্পের উদ্বেগ ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক সমীকরণ
২০২৫ সালে এসে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এমন এক মোড় নিয়েছে যেখানে ‘কৌশলগত অবিশ্বাস’ নতুন ধরনের ‘অস্থায়ী মিত্রতা’ তৈরি করছে। চীন ও ভারতের মধ্যকার ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠতা, মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ব্যবহৃত হওয়া, আর দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত অবস্থানের গুরুত্ব- এই সমীকরণগুলো দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। চীন ও ভারতের মধ্যে ২০২০ সালের গ্যালওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষের পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ছিল তিক্ত; কিন্তু বিগত এক বছরে ব্রিকস (BRICS) শীর্ষ বৈঠক, সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (SCO), এবং দ্বিপক্ষীয় সীমান্ত আলোচনা চীন-ভারত সম্পর্ককে নতুন এক ‘পরিকল্পিত সহাবস্থান’-এ পরিণত করছে।
কয়েকটি তথ্যের দিকে নজর দেওয়া যাক। ২০২৪ সালে ভারত-চীন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ছিল প্রায় ১৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে চীন ভারতের শীর্ষ আমদানির উৎস। ওদিকে ৯০ শতাংশ সীমান্ত বিরোধ সংক্রান্ত অঞ্চল এখন ‘বাফার জোন’ হিসেবে চিহ্নিত, যেখানে উভয় পক্ষই সামরিক নিয়ন্ত্রণে সাবধানতা অবলম্বন করছে। শুধু তাই নয়, ভারত সম্প্রতি চীনা প্রযুক্তিপণ্যের ওপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে, বিশেষত স্মার্টফোন ও সোলার প্যানেলের ক্ষেত্রে। এই উন্নয়ন কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং এটি মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির জন্য এক ধরনের চাপও সৃষ্টি করছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের চলমান প্রচারণায় জে ডি ভান্সের ভারত সফর মোটেও কাকতালীয় নয়। মার্কিন কূটনীতিতে এটি এক ‘সিমবলিক ডিটেরেন্স’ বা প্রতীকী হস্তক্ষেপ- যা চীন-ভারত ঘনিষ্ঠতার প্রতি এক ধরনের অপ্রকাশ্য অনাস্থা প্রকাশ করে। উল্লেখ্য, ভান্স ভারত সফরে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতি সহানুভূতির যে বার্তা দিয়েছেন, সেটি দুটি উদ্দেশ্যে করা: প্রথমত, মার্কিন অভ্যন্তরে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভোটারদের সমর্থন অর্জন। মার্কিন নির্বাচনে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভোটারের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ডেমোক্রেটদের ভোট দেয়। ট্রাম্প সেটি উল্টাতে চান। দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল রক্ষণশীল জোট গঠনের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, যেখানে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলসহ একাধিক কনজারভেটিভ মূল্যবোধসম্পন্ন রাষ্ট্র এক ছাতার নিচে কৌশলগত সহযোগিতা গড়তে পারে।
ভারত এখন এক বহুমুখী পররাষ্ট্রনীতির চর্চায় প্রবেশ করেছে, যার মূল লক্ষ্য হলো ‘নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সর্বোচ্চ কূটনৈতিক সুবিধা আদায় করা’। উদাহরণস্বরূপ:
• রাশিয়া থেকে ২০২৩ সালে ৪৫ শতাংশ অস্ত্র আমদানি, তবুও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে BECA ও COMCASA চুক্তিতে সম্পৃক্ততা।
• চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ থাকা সত্ত্বেও ৮০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি অব্যাহত রাখা।
• সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ তহবিল গঠন (২০২৫ সালে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার অবধি লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে) । এই ভূ-কৌশলগত ‘ঝুলন্ত অবস্থা’ ভারতের পক্ষে স্বকীয় নীতি বজায় রাখলেও, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা উদ্বেগকেও বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ সব কৌশলগত খেলার এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষুদ্র ভেন্যু বাংলাদেশ, বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক অঞ্চল। বাংলাদেশ যদি কৌশলগত বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে, তবে পরবর্তীকালে তাকে শুধুই প্রভাবিত নয়, বরং পরিচালিত হতে হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ভারতীয়-আমেরিকান জনগোষ্ঠী ক্রমেই রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হচ্ছে। ট্রাম্প শিবির হিন্দুত্ব ও রক্ষণশীল মূল্যবোধের মিল খুঁজে পেয়ে এই ভোটারদের পাশে টানতে চাইছে। ভান্সের ভারত সফরের মাধ্যমে একটি ‘গ্লোবাল কনজারভেটিভ অ্যালায়েন্স’ গঠনের সম্ভাবনাও উঁকি দিচ্ছে, যেখানে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদ, ইসরায়েলের জায়নিস্ট কৌশল, যুক্তরাষ্ট্রের খ্রিষ্টান কনজারভেটিভ ভাবধারা- সব এক ছাতার নিচে আনা যেতে পারে।
চীন-ভারত ঘনিষ্ঠতা, ট্রাম্পের উদ্বেগ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় মহাশক্তির পুনর্বিন্যাস- সব মিলিয়ে একটি নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরির পথে আছে। এখানে প্রশ্ন একটাই- এই সমীকরণে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় এবং কতটা সচেতনভাবে তা স্থির করছে? এই অঞ্চলকে ঘিরে চীন ও ভারতের প্রতিযোগিতা ক্রমাগত তীব্রতর হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত করিডর বাস্তবায়ন হলে ভারতের জ্বালানি ও সরবরাহ খরচ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে আসবে। ওদিকে চীনের ‘রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ’ অনুযায়ী, কুনমিং-চট্টগ্রাম-দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর সংযোগ একটি সম্ভাব্য বাণিজ্যিক পথ। এই প্রতিযোগিতায় ভারত চায় একচেটিয়া প্রভাব বজায় রাখতে। আরাকান আর্মির মাধ্যমে সীমান্ত অঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি করে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে একটি নিরাপত্তাগত হস্তক্ষেপের ন্যায্যতা তৈরির আশঙ্কা এখন কেবল আশঙ্কাই নয়, বরং সম্ভাব্য পরিকল্পনা।
এক্ষেত্রে ‘নন-স্টেট অ্যাক্টর’-এর কৌশলগত ব্যবহার হতে পারে। ভারতের নিরাপত্তা কৌশলে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো ‘নন-স্টেট অ্যাক্টর’-এর ব্যবহার। যেহেতু তারা রাষ্ট্রীয় বাহিনী নয়, তাই কূটনৈতিকভাবে দায় অস্বীকার করা সহজ। আরাকান আর্মির সাম্প্রতিক তৎপরতা এই উদ্বেগকে বাড়িয়ে তুলছে। সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে প্রায় ২৫টির বেশি সংঘর্ষ আরাকান আর্মির সঙ্গে ঘটেছে, যার অভিঘাত পড়েছে বাংলাদেশের নাইক্ষ্যংছড়ি ও রুমা এলাকায়। আরাকান আর্মির অস্ত্রের উৎস সন্দেহজনক হলেও কিছু উপগ্রহ চিত্রে ভারতের মিজোরাম সীমান্তে লজিস্টিক ট্রেইল দেখা গেছে। এই ধরনের সশস্ত্র গোষ্ঠীর ছায়াতলে নিরাপত্তা সংকট সৃষ্টি করে কৌশলগত হস্তক্ষেপের পথ তৈরি করাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে একটি অঘোষিত কৌশল।
এই জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের মধ্যে মোদীর সৌদি সফর কেবল জ্বালানি রাজনীতির খেলা নয়; এটি মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে ভারতের অংশগ্রহণকে বাড়ানোর কৌশল। এতে পাকিস্তানের ভূমিকা দুর্বল হবে এবং বাংলাদেশেও প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, ভারত ‘মুসলিম মোল্ড’ তৈরির মাধ্যমে ওআইসিতে অন্তর্ভুক্তির স্বপ্নও লালন করছে- যা ভারতকে মুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরে নীতিনির্ধারক হিসেবে তুলে ধরবে। বর্তমানের এই জটিল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি দ্বৈত কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন- যেখানে কৌশলগত নিরপেক্ষতা বজায় রেখেও সীমান্ত নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করা যায়।
একই সঙ্গে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে একটি ‘কৌশলগত মনিটরিং টাস্কফোর্স’ গঠন করা যেতে পারে, যা আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিশ্লেষণে নিয়োজিত থাকবে। এর পাশাপাশি বাণিজ্যিক ও নিরাপত্তা নীতির সমন্বয় ঘটাতে হবে, যেন কোনো করিডোর বা বন্দর ব্যবহারের চুক্তি জাতীয় নিরাপত্তাকে ছাপিয়ে না যায়। আরাকান আর্মি ও সীমান্ত সন্ত্রাসীদের বিষয়ে জাতিসংঘে সরাসরি প্রতিবেদন দাখিল করে কৌশলগতভাবে সহানুভূতি ও জনমত গঠনের চেষ্টা করা উচিত। পাশাপাশি চীন-ভারত উভয়ের সঙ্গে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে সমান্তরাল সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে একটি আঞ্চলিক ডায়ালগ প্ল্যাটফর্ম (যেমন বিমসটেক+) জোরদার করতে হবে।
চীন ও ভারতের সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠই হোক, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক হিসাবকে শুধু চ্যালেঞ্জই করছে না, নতুন মেরুকরণেরও সূচনা করছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো- বিশেষ করে বাংলাদেশ- এই খেলার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় সময় এসেছে দৃঢ়, তথ্যভিত্তিক, এবং বহুমাত্রিক কূটনৈতিক কৌশল গ্রহণ করার। বর্তমান বিশ্বের ভূরাজনীতির ‘জিরো সাম গেম’-এ যদি বাংলাদেশ নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অবস্থান সুসংহত করতে ব্যর্থ হয়, তবে ভবিষ্যতের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব কেবল নীতি দিয়েই নয়, অস্তিত্ব দিয়েও রক্ষা করতে হতে পারে।
চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে