গুজবের আগুনে পুড়ল পাহাড়
গত বুধবার থেকে দেশের পার্বত্য অঞ্চলে চলমান সহিংসতায় নিহত হয়েছেন অন্তত পাঁচজন এবং পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শতাধিক ঘরবাড়ি, ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠান। কথিত গণপিটুনির ঘটনায় স্থানীয় এক বাঙালি যুবকের মৃত্যুর পর থেকে শুরু হওয়া এই আরাজকতার বলি হয়েছে নিরাপরাধ পাহাড়ি ও বাঙালি। হঠাৎ করে পাহাড়ে এই অশান্ত অবস্থা তৈরি হওয়ার পিছনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজবকে দুষছেন স্থানীয়রা।
তাদের দাবি, বিভিন্ন এলাকায় আক্রমণ, আগুন দেওয়া, গোলাগুলি ও হত্যার বিষয়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে গুজব ও অপতথ্য।তাতেই স্থানীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে চরম আতঙ্ক, উদ্বেগ। এসব ‘মিথ্যা ও উসকানিমূলক’ পোস্ট দিয়ে তরুণ ও যুবকদের মধ্যে ছড়ানো হয় উত্তেজনা।
তার নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যান এবং দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থির অবনতি ঘটে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সংবাদমাধ্যম কর্মীরা।
খাগড়াছড়ি জেলার মিলনপুর এলাকার বাসিন্দা ধনঞ্জয় চাকমা ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার সংঘর্ষ চলাকালীন এবং তার পরে সোস্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য ও ভুয়া ছবি পোস্ট করা হয়। পরিস্থিতি যেভাবে দেখানো হয় আসলে পুরা জেলার পরিস্থিতি তেমন খারাপ ছিল না। নানাভাবে খবর ছড়ানো হয় যে রাতে বাড়িতে বাড়িতে হামলা হতে পারে। আমরা সারারাত জেগে ছিলাম। সবাই আতঙ্কে রাত কাটিয়েছি।’
ঘটনার সূত্রপাত বুধবার। খাগড়াছড়ি সদরে ‘গণপিটুনিতে’ মৃত্যু হয় মো. মামুন (৩০) নামের এক বাঙালি যুবকের। স্থানীয়রা জানায়, মামুন খাগড়াছড়ি যুবদলের সদস্য ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ১১টি চুরির মামলা রয়েছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই দিনই পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়।
পরদিন বৃহস্পতিবার বিকেলে হত্যার প্রতিবাদে সদর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরের দীঘিনালায় বাঙালিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। বাঙালিদের অভিযোগ, মিছিলটি বোয়ালখালী বাজার অতিক্রম করার সময় পাহাড়িরা বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এই সংঘর্ষের জেরে লারমা স্কয়ার সংলগ্ন এলাকায় ১০৫টি ছোট-বড় দোকান ও স্কয়ারের পাশের দু’একটি স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়। এর মধ্যে পাহাড়িদের ৭৮টি ও বাঙালির সম্প্রদায়ের ২৪টি দোকান রয়েছে।
বুধবারের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় ছয়জন আহত হলে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, পাঁচজন নিহত হয়েছে। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একটা নির্দিষ্ট এলাকায় আগুন লাগলেও ফেসবুকে দেখা যায় গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার খবর।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, পার্বত্য এলাকায় যার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে গুজব ছড়াচ্ছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় বৃহস্পতিবার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে। ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হওয়া নিয়ে আরেকদফা গুজব ছড়িয়ে পড়ে এবং সাধারণ জনগণ আতঙ্কিত হয়ে উঠে।
দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ বলেন, আগুনে দীঘিনালা বাসস্টেশন ও লারমা স্কয়ার এলাকায় ১০২টি দোকান আগুনে পুড়ে গেছে, এতে বাঙালি ও পাহাড়ি উভয়পক্ষের ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি আরও ভয়াবহ করে তোলা হয়। ফেসবুকে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে নির্বিচারে পাহাড়িদের হত্যা করা হচ্ছে, তাদের বাড়িঘর লুট করে আগুন দেওয়া হচ্ছে। এমনকি লাশ গুম করে ফেলার মতো মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইন্টারনেট বন্ধের কথা ছড়িয়ে পড়লেও ইন্টারনেট বন্ধের জন্য সরকারের নির্দেশনা দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না বলে মন্তব্য করেছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেছেন, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলায় কেবল কাটা পড়েছে, আগুনে পুড়েছে এবং বজ্রপাতের ঘটনায় ইন্টারনেট সংযোগ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যাহত হয়েছিল। দ্রুতই তা সচল করার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি, গুজবে কান দিয়েই খাগড়াছড়ি শহর, শহরতলী ও বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ি-বাঙালি মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়। তারা বলেন, বাস্তব ঘটনা যতখানি ছিল, তার চেয়ে বেশি মাত্রায় ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে, যা পরিস্থিতিকে অবনতির দিকে টেনে নিয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাতে খাগড়াছড়িতে তিনজনের মৃত্যু হলেও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা অন্তত পঞ্চাশজনকে গুলি করে হত্যা করে। এতে, পাহাড়ের উত্তেজনা সমতলেও ছড়িয়ে পড়ে। সারাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা উৎকণ্ঠায় রাত কাটান।
এরপ্রেক্ষিতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, ‘খাগড়াছড়ি জোনের একটি টহল দল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টায় একজন মুমূর্ষ রোগীকে স্থানান্তরের সময় খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এলাকায় পৌঁছালে অবস্থানরত উত্তেজিত জনসাধারণ ইউপিডিএফের (মূল) নেতৃত্বে বাধা সৃষ্টি করে। এক সময় ইউপিডিএফের (মূল) সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর টহল দলের সদস্যদের ওপর গুলি করে এবং আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনী পাল্টা গুলি চালায়। ওই গোলাগুলির ঘটনায় তিনজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয় বলে জানা যায়।’
অন্যদিকে খাগড়াছড়ির ঘটনা উত্তেজনা ছড়ায় রাঙামাটিতেও। সেই উত্তেজনার ধারাবাহিকতায় শুক্রবার সেখানে সংঘর্ষও হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকালে পাহাড়ি ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাঙামাটি শহরের বনরূপা এসে বেশ কয়েকটি গাড়ি ও দোকানে হামলা চালায়। খবর পেয়ে বাঙালি ও ব্যবসায়ীরা প্রতিরোধের চেষ্টা করলে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে একজন নিহত ও আহত হয়েছেন উভয়পক্ষের ৫৩ জন।
সহিংসতার পর খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিসহ পার্বত্যাঞ্চলজুড়ে জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পরিস্থিতি শান্ত রাখতে কাজ করছে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান জানান, আমাদের সবাইকে সচেতন থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। কেউ যেন গুজবে কান না দেয়। বর্তমানে জেলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। শান্তি-সম্প্রীতি রক্ষায় প্রত্যেককে সংযতভাবে চলার আহ্বান জানাই।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, সকাল থেকে রাঙামাটি শহরে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার উদ্ভব ঘটেছে। তাই ১৪৪ ধারা মোতায়েন করা হয়েছে। এই আদেশ পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। এছাড়া রাঙামাটি শহরে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
চলমান উত্তেজনা তিন পার্বত্য জেলায় ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে উল্লেখ করে আইএসপিআর থেকে বলা হয়, অনতিবিলম্বে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে চলমান উত্তেজনা প্রশমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। যথাযথ তদন্ত কার্যক্রম সম্পাদনের মাধ্যমে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের শনাক্তপূর্বক প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিন পার্বত্য জেলায় শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সর্বসাধারণকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।
পাহাড় এবং সমতল ভূমির মানুষের মাঝে এক ধরনের গুজব রয়েছে ভারতের সেভের সিস্টার খ্যাত অঞ্চল সমূহে চলমান অস্থিরতার করণে বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। যার জবাবে, শনিবার পররাষ্ট্র উপদেষ্ঠা বলেন, এটা বাংলাদেশের আভন্তরিন ইস্যু, এর সাথে প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক আছে বলে আমারা মনে করি না।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে