ঐকমত্যের আংশিক ভিন্নমতের ধোঁয়াশা দূর করুন
গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকেই স্লোগান উঠেছিল, ‘রাষ্ট্র সংস্কার লাগবে’। রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী, স্বৈরাচারী কাঠামো বদলাতে হবে। এবং রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে দেন। পাঁচটি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের ওপর ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মতামত জানতে চেয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে ৩৪টি দল তাদের মতামত জমা দিয়েছে এবং কমিশন এখন তাদের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করছে। কমিশন ইতোমধ্যে ১২টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা সম্পন্ন করেছে। বিএনপির সঙ্গে বর্তমানে আলোচনা চলছে।
গতকাল রোববার (২০ এপ্রিল) ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংবিধানের প্রস্তাবনায় পঞ্চম সংশোধনী পুনর্বহাল চায় বিএনপি। এ ছাড়া, সংবিধানে বহুত্ববাদ নিয়ে সংশোধনীতে কমিশনের সঙ্গে একমত বিএনপি। তবে, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনে দ্বিমত প্রকাশ করেছে বিএনপি। সরকার প্রধান ও দলের প্রধান একই ব্যক্তি হবেন না- এমন বিষয়েও ভিন্নমত প্রকাশ করেছে বিএনপি। এ ছাড়া অনেক বিষয়ে একমত হলেও কিছু বিষয়ে বিএনপির ভিন্নমত আছে। ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে ১৯৭১ সাল এবং ২০২৪ সালকে এক কাতারে আনার বিষয়ে বিএনপি ভিন্নমত পোষণ করেছে।
কমিশনের সুপারিশে বিএনপি যেগুলোতে ভিন্নমত জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জামায়াতে ইসলামসহ আরও কিছু ইসলামপন্থি দল মোটামুটি সেগুলোতেই একমত জানিয়েছে। পাশাপাশি বিএনপি যেগুলোতে একমত সেগুলোতেই তাদের জোরালো কিছু ভিন্নমত। কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে ১১৩টির পক্ষে মত দিয়েছে এনসিপি। ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন এনসিপি দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সংস্কার সমন্বয় কমিটির কো-অর্ডিনেটর সারোয়ার তুষার বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয়প্রধান যেন একই ব্যক্তি না হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা বলেছি প্রধানমন্ত্রী হবেন মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ প্রথম ব্যক্তি; কিন্তু বিএনপি এতে আপত্তি তুলেছে।
আরও বিভিন্ন বিষয়ে দলগুলোর পক্ষ থেকে বিপরীতধর্মী মতামত এসেছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের বিষয়ে দলগুলো ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিয়েছে। বিএনপি যেখানে ন্যূনতম বা জরুরি সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে, এনসিপি চায় নির্বাচনের আগেই মৌলিক সংস্কার। বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে সংস্কার কমিশনের কাছে বিএনপির দাবি সবচেয়ে বেশি এবং শক্তিশালী। অন্যদিকে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের গঠিত দল এনসিপির দাবিও কমিশন ফেলে দিবে পারবে না।
তাহলে ঐকমত্য পৌঁছাবে কোন পথে? অন্যদিকে আওয়ামী লীগ কোনো নিষিদ্ধ দল নয় এবং তাদের মতামতও নেয়া হয়নি বা জানা যায়নি। তাহলে কি আওয়ামী লীগকে ছাড়াই নির্বাচন হবে? সংস্কার হবে? ইসলামপন্থি দলগুলোও কিছু মৌলিক সংস্কারের দাবি তুলেছে। সংবিধানের মূলনীতিতে আল্লাহর প্রতি অবিচল ইমান-আস্থা ফিরিয়ে আনতে মত দিয়েছে জামায়াত। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের সঙ্গে একমত হলেও পুরাপুরি একমত নয় দলটি। খেলাফতে মজলিসও জামায়াতের সঙ্গে একমত।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) জরুরিভিত্তিতে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে; কিন্তু তারা কি জামায়াত-খেলাফতে মজলিস ও বিএনপির সঙ্গে একমত হতে পারবে? তার মানে ঐকমত্যে পৌঁছুতে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যেই অনেক বেগ পেতে হবে। তাহলে ঐকমত্য কমিশন আসলে কী করবে? সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আসলে অনেক ঘোলাটে এবং জটিল। অনেক প্রশ্ন আমাদের সামনে, অনেক উত্তর এখনো অজানা। অপেক্ষা করা ছাড়া যেন সাধারণ নাগরিকদের এখন আর কিছুই করার নেই। আমরা চাই রাজনৈতিক দলগুলোর আরও স্পষ্ট বক্তব্য দিক। ‘কিছু বিষয়ে একমত, আংশিক ভিন্নমত’-ধরনের কথায় কিছুই বোঝা যায় না। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে ঐকমত্য কমিশন যত দ্রুত ‘আংশিক ভিন্নমত’-এর ধোঁয়াশা দূর করবে ততই দেশের জন্য মঙ্গল।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে