সিভিল সার্জনদের ভ্রাম্যমাণ আদালত
কার্যপরিধির স্পষ্ট দিকনির্দেশনা চাই
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনেকটা বাজারি ব্যবস্থার মতোই। বাজারে যতরকম অনিয়ম-দুর্নীতি-সিন্ডিকেট-ভেজাল আছে তার সবই স্বাস্থ্য খাতেও বহাল। বাজারের দুর্নীতিচক্র দমনে ভ্রাম্যমাণ আদালত আছে, এবার স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করার জন্য সরকারের কাছে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা চেয়েছেন দেশের সিভিল সার্জনরা। একই সঙ্গে হাসপাতাল ও কর্মস্থলের নিরাপত্তায় আনসার বা ‘স্বাস্থ্য পুলিশ’ দেয়ার প্রস্তাব করেছেন তারা। গতকাল মঙ্গলবার (১৩ মে) সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, জেলা প্রশাসক সম্মেলনের আদলে প্রথমবারের মতো দুদিনের সম্মেলন আয়োজন করেছেন দেশের সিভিল সার্জনরা। সেখানে সিভিল সার্জনরা সরকারের কাছে নানাবিধ দাবি ও প্রস্তাব তুলে ধরেছেন।
তাদের দাবিগুলো হলো- অবৈধ ক্লিনিক ও ল্যাব, ভুয়া চিকিৎসক, দালাল চক্র ও ভেজাল ওষুধ নিয়ন্ত্রণে সিভিল সার্জনদের সীমিত আকারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা দেয়া জরুরি। এ ছাড়া দেশের প্রতিটি হাসপাতালে নিরাপত্তার অভাবে স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রায়ই হুমকির মুখে পড়েন। এ জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হাসপাতালে আনসার বা ‘স্বাস্থ্য পুলিশ’ মোতায়েন করা যেতে পারে। তারা আরও বলেন, স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহির অভাব রয়েছে। এ অভাব দূর না হলে চিকিৎসক, নার্সসহ জনবল যতই নিয়োগ দেয়া হোক না কেন, কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসবে না। দক্ষ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি এবং দেশি ও আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ানোর কথাও বলেন তারা।
তাদের দাবিগুলা যৌক্তিক, নিঃসন্দেহে; কিন্তু সিভিল সার্জনরা ভ্রাম্যমাণ আদালতের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে তা স্বাস্থ্য খাতে নতুন কোনো নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে কি না তাও ভেবে দেখার বিষয়। কারণ যে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করতে ক্ষমতার চেয়ে স্বদিচ্ছাই যথেষ্ট। সিভিল সার্জনরা সীমিত ক্ষমতা চেয়েছেন, সেই সীমিত ক্ষমতা কতটুকু, সেটা কোন আইনের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে? সিভিল সার্জনদের ভ্রাম্যমাণ আদালতও কি বাংলাদেশে প্রচলিত মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ অনুসারে চলবে? না কি সিভিল সার্জনদের জন্য নতুন মোবাইল কোর্ট আইন চালু করা হবে?
সিভিল সার্জনদের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা সত্যিই দেয়া হবে কি না সেটা ভবিষ্যতে জানা যাবে; কিন্তু বিগত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি ভ্রাম্যমাণ আদালত অনেকটা জনগণকে একটু সান্ত্বনা দেয়ার নামেই পরিচালিত হয়। যখন বাজারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, দ্রব্যমূল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন ভ্রাম্যমাণ আদালত কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে জরিমানা আদায়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন; কিন্তু চলমান দুর্নীতিচক্র, সিন্ডিকেট বছরের পর বছর একই থেকে যায়। সিভিল সার্জনদের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা দিলে পরিস্থিতি একই হবে কি না আমরা জানি না।
তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে তাদের কোনো বিরোধ ঘটবে কি না তাও আমরা জানি না। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন ২০২৩ অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত যে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি রোধের আইন বলবৎ আছে; কিন্তু তারপরও আমরা দেখেছি অনেকক্ষেত্রেই সেই আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের ব্যত্যয় ঘটেছে। জনকল্যাণে দ্রুত বিচারের স্বার্থে অনেকেই হয়তো ভ্রাম্যমাণ আদালত পছন্দ করে থাকেন; কিন্তু সাংবিধানিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না হলে, দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ সুসংহত না হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যপরিধিও খুব বেশি বিস্তৃত হতে পারে না। অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে রেখেই আমরা সিভিল সার্জনদের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার দাবিটিকে একদিকে যেমন সাধুবাদ জানাই অন্যদিকে তাদের কার্যপরিধির স্পষ্ট দিকনির্দেশনাও চাই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে