সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কর ফাঁকি দেয়ার সব রাস্তা বন্ধ করতে হবে
দেশ ও অর্থনীতির এই পর্যায়ে এসে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ‘পুশ ফ্যাক্টর’র প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। যে কোনো মূল্যেই হোক রাজস্ব আহরণের পরিমাণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নীত করার জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কর প্রদানের উপযোগী বিপুলসংখ্যক মানুষকে এখনো ট্যাক্স নেটওয়ার্কের আনা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে সঠিক পরিমাণে কর ও শুল্কায়নযোগ্য যে সব খাত বাইরে আছে সেগুলোকে শুল্ক ও করের আওতায় আনার চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই পরিশীলিত, সংস্কারকৃত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়ে একটা করদাতাবান্ধব ও স্বয়ংক্রিয় প্রণোদনামূলক পদ্ধতি গড়ে তোলা বা প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। অর্থাৎ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা কর প্রদান করছেন না, তাদের উৎসাহিত করার পাশাপাশি কর ফাঁকি দেয়ার সব রাস্তা বন্ধ করতে হবে। কর দান ও আদায়ের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা বা জটিলতাসহ স্পর্শকাতরতা রয়েছে, তা দূর করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১৯৯০-এর দশক থেকেই এ ব্যাপারে চেষ্টা চালানো হচ্ছে; কিন্তু সাফল্য মিলছে না। আগে আমাদের অর্থনীতি ছিল কার্যত আমদানি বাণিজ্যনির্ভর। নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা তেমন একটা শক্তিশালী ছিল না বলে তখন আমদানি শুল্ক ব্যতিরেকে কর ও ভ্যাট রাজস্ব আহরণের তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন ট্রেডিং নির্ভরতা থেকে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের দিকে অগ্রসরসমান হয় তখন থেকেই শুল্কের চাইতে করের কলেবর বৃদ্ধি পেতে থাকে। রেমিট্যান্সের পাশাপাশি পোশাক শিল্পের হাত ধরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ও উন্নয়ন বৃদ্ধি পেতে থাকলে এবং আমদানি ব্যয় আনুপাতিকভাবে হ্রাস পেতে থাকলে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ সংক্রান্ত বিষয়াদি নতুন করে জাতীয় ভাব-ভাবনার চৌহদ্দীতে চলে আসে। অন্যদিকে ১৯৯০ দশকের শুরুতে রুশ ফেডারেশনের পতনের পর বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়। তখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর আগের মতো বিদেশি ঋণ ও অনুদান প্রাপ্তির সুযোগ এবং সম্ভাবনা কমতে থাকে। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত অথচ দ্রুত উন্নয়ন আগ্রহী দেশে অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে রাজস্ব আহরণের গুরুত্ব বেড়ে যায়।
সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে রাজস্ব আহরণের হার বৃদ্ধির প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কর-জিডিপি রেশিও এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে হলে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। বিশ্বের যেসব দেশে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও সবচেয়ে কম বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রতি বছর জাতীয় বাজেটে যে হারে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় কোনো বছরই তা অর্জন করা সম্ভব হয় না। কর আদায়ের লক্ষমাত্রা বেশি ধরা হলেও তা অর্জনে সঠিক দিক নির্দেশনা থাকে না। এক্ষেত্রে পদ্ধতিগত, অবকাঠামোগত এবং বিবিধ সব ধরনের ত্রুটি দূর করে উপযুক্ত করদাতাদের মধ্যে থেকে যত বেশি জনকে করের আওতায় আনা যায় সে চেষ্টাই যেন শুধু চলছে। পাশাপাশি যেসব নিত্য নতুন আর্থিক খাত তৈরি হচ্ছে সেগুলোকেও চটজলদি করের আওতায় আনার প্রয়াস চলছে। কিন্তু কর্মক্ষমতায় ও কর্মদক্ষতায় সে প্রয়াস কাঙ্ক্ষিত ফলাফল দিতে যথেষ্ট সময় নিচ্ছে। রাজস্ব আহরণ দপ্তরে দক্ষ জনবলের অভাব এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির প্রসার প্রতিপত্তির প্রেক্ষাপটে রাজস্ব আহরণ পদ্ধতি প্রক্রিয়ায় অন-লাইনীকরণের কাজ, সংস্কারের কাজ কেমন যেন শেষ হয়েও হচ্ছে না শেষ।
প্রযোজ্য সবার করদানে সচেতন অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য যখন এবং যেখানে উদ্বুদ্ধ ও প্রণোদনামূলক পন্থা পদ্ধতি প্রয়োগের কথা সেখানে কর আহরণ পরিবেশ-পরিস্থিতিকে স্বয়ম্ভর ও অভিজ্ঞ মনে করে কঠিন কঠিন পদ্ধতি প্রয়োগের পরকাষ্ঠা যদি দেখানো হয় বা অহেতুক চাপ সৃষ্টি করা হয় তাহলে কর দাতারা স্বচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না। দেখতে হবে আইন-কানুন সংস্কারের পাশাপাশি রীতি পদ্ধতিকে করদাতা বান্ধবকরণের নামে পরিবেশ পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তোলা হচ্ছে কি না। কর আহরণ পদ্ধতি এমনতর জটিল, কমপার্টমেন্টালাইজড ও কঠিন হলে যারা এখনো করের আওতায় আসেনি তারা করদাতা হতে ভয় পেতে পারেন। পাশাপাশি যারা কর দিচ্ছেন তারাও সঠিকভাবে কর দিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। করদাতারা তাদের অভিযোগ ও সমস্যার সমাধান পেতে পারতেন কর ন্যায়পাল এর কাছে। শতাধিক দেশে কর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান কার্যকর থাকলেও বাংলাদেশে প্রবর্তিত কর ন্যয় পাল প্রতিষ্ঠানকে বাল্যবয়সেই বিদায় করে দেয়া হয়েছে।
কর ন্যয়পাল প্রতিষ্ঠানের কার্যকরকরণে যে সব সমস্যা সীমাবদ্ধতার যুক্তিতে তাকে অপাঙক্তেয় ভাবা হয়েছিল আইনে সেগুলো সংশোধন সংযোজন করে প্রতিষ্ঠানটির পুনরুজ্জীবনের অবকাশ রয়েছে। যারা কর দান কারেন এবং কর আদায় প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত তাদের সবারই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এবং উন্নয়ন ঘটাতে হবে। আমরা যদি মনে করি, উন্নত অর্থনীতির মতো আমাদের-সব করদাতা শিক্ষিত, কর দানে দায়িত্ব সচেতন এবং তারা আইন কানুন বুঝেন জানেন তাহলে কর-দৃষ্টিভঙ্গি (মাইন্ডসেট) ভিন্ন আঙ্গিকে নির্মিত হতে বাধ্য। এমনতরো অবস্থায় রাজস্ব আহরণ পরিবেশ পরিস্থিতি প্রোগ্রেসিভ না হয়ে রিগ্রেসিভ হতে পারে। নতুন করদাতা যেহেতু আসতে চাচ্ছে না বা তাদেরকে আনা যাচ্ছে না, সেহেতু তাদের স্থলে বিদ্যমান করদাতাদের ওপর চাপ বেড়ে গেলে তারাও পথ খুঁজতে পারেন কীভাবে কর দেয়া থেকে ফাঁকি দিয়ে পরিত্রাণ মিলতে পারে।
প্রতি বছর যে অর্থবিধি জারি করা হয় সেখানে বিদ্যমান তিনটা রাজস্ব আহরণ আইনেরই সংশোধন ও সংযোজন পরিমার্জনে গুরুত্ব দেয়া হয়। ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনের স্থলাভিষিক্ত একটা নতুন কর আইন ২০১২ সালে জারি হলেও ২০১৯ সালে আগে তার পূর্ণ প্রবর্তন করা যায়নি। এদিকে ১৯৬৯ সালের কাস্টমস আইনের সংস্কার ও আধুনিকীকরণের চেষ্টাও চলছে। পাশাপাশি ইনকাম ট্যাক্সের ১৯৮৪ সালের অধ্যাদেশটির নবায়ন হয়েছে ২০২৩ সালে। এসবের পাশাপাশি ইদানীং দেখা যাচ্ছে, অর্থবিধিতে বিস্তর রিভিশনের প্রস্তাব করা হচ্ছে। বছর বছর ট্যাক্স রেট, কর রেয়াতের মাত্রা, অবকাশের হার ও ক্ষেত্রে নিত্য নতুন সংশোধন, সংস্কার প্রস্তাবনা প্রতি বছর যেন বেড়েই চলেছে। উল্লেখ্য, শুধু আয়করের ক্ষেত্রেই গড়ে ৭০টির মতো সংস্কার প্রস্তাব আসে অর্থবিধিতে। এক্ষেত্রে খেয়াল করতে হবে প্রতি বছরের অর্থবিলে যদি এক একটা আইনের ধারা উপধারা অতি পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও সংশোধনের হিড়িক পড়ে তখন সংশ্লিষ্ট সবার পক্ষে ওই সব পরিবর্তন অনুসরণ করা কঠিন হবে। একই সঙ্গে তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা আরো বৃদ্ধি পাবার আশঙ্কা থাকবে।
ব্যবসায়-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় করদাতাদের। আইনের সংশোধন সংক্রান্ত এসআরও’র প্রয়োগ ন্যূনতম ৩ বছর বা তার বেশি হলে ওই এআরওর কার্যকারিতা অনুসরণ অনুধাবন যুক্তিযুক্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। এদিকে আয়কর পরিপত্র-১ জারিতে বিলম্ব করেও তাতে কিছু কিছু বিষয়ে অস্পষ্টতা নিরসনে ব্যাখ্যার অবকাশ থেকে যায়। এসবই সঠিক পরিমাণে ন্যায্য কর আদায়ের ক্ষেত্রে বিলম্ব সৃষ্টি বা অন্তরায় হিসেবে কাজ করতে পারে। পরিপত্রে স্পষ্টীকরণ করতে গিয়ে যে দীর্ঘসূত্রতা হয় তা থেকে উত্তোরণ ঘটানো সম্ভব না হলে প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রতিবেশগত নানা প্রভাব পুরো বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই উপযুক্ত কর আদায়ের জন্য অপারগ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থবছর শুরু থেকেই ঝড়বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি আরও নানা উপলক্ষের সমস্যা থাকে, এর সুযোগ নিয়ে আয়কর দেয়ার সময় বাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে সবাই। এই অবস্থা থেকে স্থায়ীভাবে বেরিয়ে আসতেই এবার আইনের মধ্যেই সময় নির্ধারণ করা হয়েছে অর্থবছর শেষ হবার ৩ মাসের স্থলে ৫ মাস অর্থাৎ নভেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যক্তি আয়-কর দেয়া যাবে। যেহেতু সবাই অপেক্ষা করে পরিপত্র জারির, তাই সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যাখ্যার জন্য অপেক্ষায় কিংবা পরিপত্র জারির কাজটি যত দ্রুত করা যায় ততই মঙ্গল। আমরা যদি সবাইকে করের আওতায় আনতে চাই তাহলে অর্থ বছর শেষ হওয়ার পর পাঁচ মাস পর্যত অপেক্ষার অবকাশ অর্থাৎ সময় ক্ষেপণের এ ধরনের অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে সবার জন্য যথাসময়ে কর দেয়ার সহজ সুযোগ সৃষ্টি শ্রেয়োতর বিবেচিত হতে পারে।
বাজেটে নতুন হারে করারোপের পর অর্থবছরের শুরু থেকেই কর কীভাবে দিতে হবে, কোন কোন পরিস্থিতিতে কি করণীয় সেটা নিশ্চিত না করা গেলে সমস্যা সৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে আয়কর প্রদানের ক্ষেত্রে সময় নভেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়ে নেয়াতে মূল সমস্যা যেটা হয়েছে, সেটা হলো কর প্রদান ও প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা বেড়েছে। এক্ষেত্রে আগের তুলনায় দুই মাস পর কর আদায় হওয়ায় সামষ্টিক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিড়ম্বনা ও ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। কেননা অর্থ বছরের শুরু থেকে সরকারি অর্থ ব্যয় অব্যাহত থাকে; কিন্তু রাজস্ব আয় কত আসবে সেটার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে বেশ কিছুটা সময়। ফলে ব্যাংক বরোয়িং বাড়তে থাকে। অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত কর নাও আসতে পারে। একবারে ৩ থেকে ৫ মাস টাইম বেড়ে যাওয়াতে সবাই যাতে যার যার মতো গা ছাড়া ভাব বা বিলম্ব করার প্রবণতায় অর্জিতব্য রাজস্বের উপযোগিতা যাতে হ্রাস না পায় সেদিকে সচেতন দৃষ্টিক্ষেপ প্রয়োজন হবে।
রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমে ও পদ্ধতি প্রক্রিয়ায় আইনসংগত স্বচ্ছতার আলোকে গতিশীলকরণের স্বার্থে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আইন ও প্রক্রিয়ার যৌক্তিকতা যথাযথভাবে নির্ধারিত হওয়া উচিত। বিশেষ করে কর আহরণ প্রক্রিয়ার যে সব আইনি জটিলতা সেটা ঠিক মতো সংস্কারের মাধ্যমে স্পষ্ট করা না গেলে সমস্যা থেকেই যাবে। অন্তত এই অবস্থায় রেখে ব্যাপক কর আদায়ের যে কথা চিন্তা করা হচ্ছে তা অর্জন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে আইনের আর্থ-প্রশাসনিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে যদি আরও কিছু অসম্পূর্ণতা ও ফাঁকফোকর থেকে থাকে তা সংশোধন করা না গেলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এনবিআর কর্তৃপক্ষের নেতৃত্ব দেয়া কঠিন হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
লেখক: সাবেক সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান এবং প্লানিং কমিশনের সাবেক সদস্য।
অনুলিখন: এম এ খালেক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে