বাণিজ্যিক সিনেমা অক্সিজেনের অভাবে ভুগছে আর ভিন্ন ধারার সিনেমা দর্শক খরায় ধুঁকছে
পেশাগত প্রয়োজনে একবার চলচ্চিত্র পরিচালক কাজী হায়াতের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, ইন্ডাস্ট্রিতে বিভিন্ন ধরনের সিনেমা নির্মাণ হবে। কোনো ছবি হলে দর্শক টানবে, লোকে লাইন ধরে দেখবে। আবার কোনো সিনেমা বিদেশের মাটিতে প্রতিনিধিত্ব করবে, পুরস্কার জিতে দেশের নাম উজ্জ্বল করবে। শুনে ভেতর থেকে একটি দ্বিধার বিদায় ঘটে। ভিন্ন ঘরানার ছবির ঝুলিতে রাশি রাশি পুরস্কার জুটলেও হলে সারি সারি দর্শক জোটে না।
অন্যদিকে যে বাণিজ্যিক সিনেমাগুলো দেখতে দর্শক চিনিলোভী পিপড়ার মতো লাইন ধরলেও পুরস্কারের দৌড়ে ওই ছবিগুলো থাকে খারাপ ছাত্রের কাতারে। তাই দেখে ভেতর দ্বিধার উদয় হয়েছিল– যে সিনেমা দর্শক দেখলেন না সে সিনেমার স্বার্থকতা কোথায়? হায়াৎ সাহেবের সহজ ও সুন্দর ব্যাখ্যায় প্রশ্নটির হায়াত ফুরোলো। বুঝতে পারলাম বিষয়টি পোশাক ও অলংকারের মতো। কাপড় লজ্জা নিবারণে পরা হলেও গহনা মূলত সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য। তাই বলে সেই সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে পোশাক এড়িয়ে গেলে তো লজ্জা নিবারণ সম্ভব না। আর উলঙ্গ শরীরে গহনা পরলে আদৌ কি সৌন্দর্য চোখে পড়ে? অথচ আজকাল সেরকমই চিত্র দেখা যাচ্ছে। বাণিজ্যিক সিনেমার দশা শক্তি হারানো চুম্বকের মতো। দর্শক টানতে পারে না। এই সুযোগে ভিন্ন ঘরানার সিনেমাগুলো দিয়ে দর্শক টানার ব্যর্থ চেষ্টা করা হচ্ছে। টেলিফিল্মধর্মী সিনেমার এলিট নির্মাতাদের ভিড়বাট্টা ফেস্টিভ্যালের পাশাপাশি বেড়েছে হলে। কিন্তু হল দখল করে নিলেও দর্শকের মন দখল করতে পারছে না।
এতে অবশ্য ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্রের কিছু যায় আসে না। কেননা ওই সিনেমাগুলো প্রশংসা ও পুরস্কার আনলেও ভাতের জোগাড় তো করেছে মূল ধারার সিনেমা। সেই সিনেমা যখন উইয়ে খাচ্ছে তখন চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি নামক গাছটির শিকড়বাকড়সহ উপড়ে ওঠার দশা। ১৪০০ থেকে কমতে কমতে দুই ডিজিটে গিয়ে দাঁড়িয়েছে হল সংখ্যা। এই হ্রাস-বৃদ্ধিতে ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্রের কারণে নয়। মূল ধারার সিনেমা দর্শকপ্রিয়তা হারানোয়। অতএব, বোঝাই যাচ্ছে বাণিজ্যিক দিক বিবেচনায় মূলধারা ও বিকল্পধারার গুরুত্ব।
এই যখন অবস্থা তখন ভিন্ন ধারার শিবিরে যেন চলে ফাঁপা উল্লাস। নির্মাতা অভিনয় শিল্পীদের পরিচিতির কারণে সংবাদপত্র সয়লাব হয় সাফল্যের সংবাদে। পড়ে মনে হয় গোটা দেশ নেড়েচেড়ে দিচ্ছে সিনেমাগুলো। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে হয়তো কিছুদিন চলে। এর চেয়ে বেশি কিছু না। গল্পনির্ভর ছবির স্লোগান তুললেও সে গল্প টানে না দর্শককে। দিন শেষে হল মালিকদের কাছে খোঁজ নিতে গেলে শোনা যায় ভিন্ন কথা। তারা জানান আশার সলতে প্রজ্বলিত করতে পারছে না ছবিগুলো। উল্টো হচ্ছে গলার কাঁটা। দেশে-বিদেশে চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসার জলে ভাসলেও লোকসানের জলে হাবুডুবু খাওয়াচ্ছে হল মালিকদের। কেননা ছবি চলুক আর না চলুক খরচ তো তাদের চলছেই।
বিষয়টি নিয়ে গেল বছরের নভেম্বরে কথা হয় চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমারের সঙ্গে। ভদ্রলোক বেশ হতাশা নিয়ে বলেন, ‘সিনেপ্লেক্সের মালিকদের নিয়ে কদিন আগে একটি মিটিংয়ে বসেছিলাম। তারা বললেন, ‘কী করব আমরা। যেসব সিনেমা নিয়ে আশা নেই সেগুলো চালানোর অনুরোধ ফেলতেও পারি না, রাখতেও পারি না।’ কারণ হিসেবে যা জানালেন খুবই খারাপ অবস্থা তাতে। কেননা ঢাকায় স্টার সিনেপ্লেক্সের যতগুলো শাখা সবগুলো ভাড়ায় চলে। সেল হোক আর না হোক ভাড়া কিন্তু দিতে হবে। বিদ্যুৎ বিল, স্টাফদের বেতন হিসেবে বড় একটি অংক দিতেই হয়।’
এতে বোঝা যায় বিকল্পধারার সিনেমাগুলো দুটো পয়সা এনে দেবে সে ভরসাও করতে পারে না হল মালিক ও প্রদর্শক সমিতি। কারণও আছে। গেল বছরের শেষের দিকে মুক্তি পাওয়া একটি সিনেমার পরিচালককে বারবার বলতে শুনেছি, তার সিনেমা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি হয়নি। একই ব্যক্তিকে আবার সিনেমাটি দর্শক খরায় ভুগছে বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় হতাশা প্রকাশ করতে দেখেছি। কথা হচ্ছে যে ছবির বাণিজ্যিক কোনো উদ্দেশ্য নেই সে ছবি কেন বাণিজ্যের জন্য সিনেমা হলে দেয়া হয়। তা দর্শক না দেখলেই কেন দীর্ঘশ্বাস ফেলা! এটা হাস্যকর।
সিনেমা বানিয়ে লাভের মুখ দেখা আর সোনার হরিণ দর্শন এক হলেও বছরে যে কটি ছবি লাভের গুড় ঘরে তোলে তা ওই বাণিজ্যিক ধারার সিনেমাই। এই যেমন গেল বছর তুফান নামের বাণিজ্যিক ধারার ছবিটি ছাড়া কোনোটাই ব্যবসা সফল হয়নি। অন্যদিকে ভিন্ন ধারার ছবিগুলো দাঁড়াতে পারে না। ব্যর্থতার এই ধারাবাহিকতা গেল বছরও বজায় ছিল। বছরের শেষ ছবি জয়া আহসানের নকশীকাঁথার জমিনের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। সিনেমা হলে চালানো ওয়েবফিল্ম ৩৬ ২৪ ৩৬ ব্যবসা করা তো দূরের কথা মানুষ উল্টো হাসাহাসি করেছে।
এদিকে গত দেড় দশকের আওয়ামী দুঃশাসন নিয়ে ৮৪০ নামের একটি সিনেমা বানিয়েছেন নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ছবিটিকে তিনি আওয়ামী দুঃশাসনের এক্সরে রিপোর্ট বলে আখ্যায়িত করেছেন। ফারুকী গুণী নির্মাতা। নাটকে নতুন ধারা তৈরি করেছেন। তার সিনেমা দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়। তরুণদের কাছে সমাদৃত হয়। এই সিনেমাওয়ালাকে শনিবার বিকেল ছবিটি নিয়ে ভুগিয়েছে আওয়ামী সরকার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন লুকিয়ে ছাপিয়ে ৮৪০-এর দৃশ্য ধারণ করেছেন তিনি। তবে শুনেছিলান শুরুতে তা ছিল ওটিটি মাধ্যমের জন্য। পরে নাকি কিছু অংশ রি শুট করে সিনেমা বানিয়েছেন। ফারুকীর সিনেমা বিকল্পধারার বলেই পরিচিত। তার অন্য কাজগুলোর মতো সিনেমাটিও সামাজিক মাধ্যমে দারুণ প্রশংসিত হয়েছে। ব্যবসা সফল হয়েছে কি? প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গেলে স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘ছবিটি এক মাস চালিয়েছি আমরা। প্রথম সপ্তাহ বেশ দর্শক পেয়েছিলাম। পরে তেমন পাইনি।’
এছাড়া মাল্টিপ্লেক্সের বাইরে কোনো সিঙ্গেল স্ক্রিনে প্রদর্শিত হয়নি ছবিটি। মেজবাহ উদ্দিন আরও জানান ৫ আগস্টের পর প্রিয় মালতী ছাড়া কোনো বাংলা সিনেমায় দর্শক টানতে পারেনি। ব্যতিক্রম প্রিয় মালতী। মোটামুটি টেনেছে। যমুনা ব্লকবাস্টারে এখনো প্রদর্শিত হচ্ছে সিনেমাটি। তবে মিলছে না প্রত্যাশিত দর্শক। ব্লকবাস্টারের মার্কেটিং বিভাগের সহকারী ম্যানেজার মাহবুবুর রহমান বলেন, আশানুরূপ দর্শক মিলছে না। একেবারেই অল্পসংখ্যক আসছে। শুরু থেকেই এ চিত্র। অবশ্য এখন কোনো সিনেমাই দর্শক টানতে পারছে না। চট্টগ্রামের সুগন্ধা সিনেমা হলেরও একই অবস্থা। হলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফ হোসাইন বলেন, ‘এক সপ্তাহ চালিয়েছিলাম ছবিটি। খুবই খারাপ গেছে। প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলে জানালেন শ্যামলী সিনেমা হলের হাউজ ম্যানেজার আহসানউল্লাহ। তিনি বলেন, ছবিটি এক সপ্তাহ চলেছে। তবে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এ থেকেই মেলে উত্তর।
চলচ্চিত্র নিয়ে তামাশাটাও যেন গেল বছরই হলো। ওটিটি মাধ্যমের জন্য বানানো কনটেন্ট মুক্তি দেয়া হলো সিনেমা হলে। ৩৬ ২৪ ৩৬ নামের ওয়েবফিল্মের কথা বলছিলাম। একটিবার ভেবে দেখবেন, ওটিটি মাধ্যম না থাকলে এটি বড়জোর টেলিফিল্ম বলে টিভিতে চালানো হতো। ওটিটির কল্যাণে নামের পাশে ফিল্ম শব্দটির ছোঁয়া পেয়ে এমনই আশকারা পেল যে রাতারাতি হলে মুক্তি পেল! এই ওয়েবফিল্ম আদৌ দর্শক টানতে পারবে কি না ভাবার প্রয়োজন ছিল। কেননা দেশের দর্শকরা সিনেমা হলে টেলিফিল্মধর্মী কনটেন্ট দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না। ওয়েব সিনেমাকে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা বলতেও নারাজ তারা। নাটক টেলিফিল্ম বলে ডাকেন।
অতএব, যে জনপদের অধিকাংশ এতে সহমত প্রকাশ করেন তাদের টানতে ওয়েব সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত হল মালিকদের বোঝা বাড়ানো ছাড়া কিছুই না। এই যখন অবস্থা তখন বলতেই হয়, বাণিজ্যিক সিনেমা অক্সিজেনের অভাবে ভুগছে। ভিন্ন ধারার সিনেমা দর্শক খরায় ধুঁকছে। প্রশংসার চাদরে সে ক্ষত ঢাকতে চাইলেও হচ্ছে ব্যর্থ।
রাফিউজ্জামান রাফি: সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে