Views Bangladesh Logo

স্থানীয় সরকার নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার প্রস্তাব

Kamrul  Hasan

কামরুল হাসান

জাতীয় নির্বাচন না স্থানীয় নির্বাচন আগে হবে, তা নিয়ে চলমান দ্বিধাবিভক্তির মাঝেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে প্রথমে স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন এবং পরে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করার প্রস্তাব দিয়েছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। সব নির্বাচন আয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ নির্ধারিত করতে বলছে চারমাস।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে স্থায়ী ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি)’ গঠন এবং এনসিসি দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের নাম চূড়ান্ত এবং সরকারপ্রধান কর্তৃক অন্য ২০ জন উপদেষ্টাকে নিয়োগের বিধানের কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে এনসিসি গঠন করা না গেলে সব রাজনৈতিক দল, বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজ ও সমাজের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা প্রণয়ন এবং ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক তা সংসদে পাস ও বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।

১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয় সেটি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল


প্রতিবেদনের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল নিয়ে হতাশার কথা বলেছে কমিশন।

কমিশন বলেছে, ‘রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে কার্যকর নির্বাচনি ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক শাসন কায়েমে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রস্তাব বেশ অভিনব হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটি বেশ কার্যকরী ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া নির্বাচনগুলো সম্পর্কে পরাজিত দলগুলো নির্বাচনের মান নিয়ে বাগাড়ম্বরপূর্ণ কিছু রাজনৈতিক বক্তব্য দিলেও দেশ-বিদেশে সেসব নির্বাচন কমবেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে’।

হাইকোর্টের রায়ের ভিত্তিতে যে সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে সন্নিবেশিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়, তাকে ‘অসাংবিধানিক ঘোষণা’ বলে গত বছরের ২৪ ডিসেম্বরের রায়ে উল্লেখ করেছেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশিষ রায়ের হাইকোর্ট বেঞ্চ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার রায়টি বর্তমানে রিভিউয়ের পর্যায়ে রয়েছে।

কমিশন আশাবাদী, সর্বোচ্চ আদালতের রায়েই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আবারও ফিরবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মেয়াদ চারমাস নির্ধারিত করে এ মেয়াদকালে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন সম্পন্নের সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রতিবেদনের ১৮তম অনুচ্ছেদে দ্বিতীয় সুপারিশে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন আয়োজনের সুপারিশ করা হয়েছে।

‘না-ভোট' ও না ভোটের জয়ে পুনর্নির্বাচন

দেশের নির্বাচনগুলোতে কোনো ক্ষেত্রে যদি একজন মাত্র প্রার্থী থাকেন, তাহলে তাকে প্রচলিত নিয়মে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কমিশন বলছে, সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরপিও'র ১৯ ধারায় এই সংক্রান্ত বিধান আছে। যদিও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন আমাদের সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সর্বোপরি এটি সংবিধান এবং গণতন্ত্রের অত্যাবশ্যকীয় চেতনার পরিপন্থি। কারণ নির্বাচন হচ্ছে, একাধিক বিকল্পের মধ্য থেকে পছন্দসই কাউকে খুঁজে নেয়া’।

‘দীর্ঘসময় ভুক্তভোগী হবার কারণে দেশের জনগণ এখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের প্রতি কঠোর নেতিবাচক মানসিকতা পোষণ করেন’- মন্তব্য করে সমাধান হিসেবে ‘না ভোট’ প্রবর্তনের কথা এসেছে প্রস্তাবনায়।

কমিশন বলছে, নির্বাচনি ব্যবস্থায় ব্যালটে ‘না ভোট’ দেয়ার অপশন থাকলে সব প্রার্থীকে প্রত্যাখ্যানের সুযোগ পাবেন ভোটাররা। বর্তমানে বিশ্বের ২০টি দেশে এই ভোটের বিধান প্রচলিত আছে। অন্যদিকে তিনটি দেশ বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং রাশিয়া এটি প্রচলনের পরও আবার বাতিল করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘না ভোট’ একটি অপশন হলেও তার বাস্তবায়নের ধরন নিয়ে মতভেদ আছে। ‘না ভোটে’র প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে দুই রকমের করণীয় আছে। ‘না ভোট’ হতে পারে প্রতীকী, অর্থাৎ যতো ভোটারই না ভোট দিন না কেন, সেটি কোনো ব্যক্তির নির্বাচিত হবার পথে প্রতিবন্ধক হবে না। নির্বাচনে ‘না ভোট’ সর্বোচ্চ হলেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশে প্রবর্তিত ‘না ভোট’ এবং ভারতের বর্তমান ‘না ভোট’ ব্যবস্থাটি এ ধরনের। কিছু দেশে (যেমন, পোল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া) নির্বাচনে ‘না ভোটে’র সংখ্যা যদি অন্য যেকোনো প্রার্থীর চেয়ে বেশি হয়, তাহলে সেই নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচনের বিধান আছে’।

২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবনার প্রেক্ষিতে এটি গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে যুক্ত করা হয়েছিল এবং নবম সংসদ নির্বাচনে এটি ভোটারদের সামনে অপশন হিসেবে ছিল। তখন সারাদেশে মোট প্রদত্ত ছয় কোটি ৯৭ লাখ ৫৯ হাজার ২১০ ভোটের মধ্যে ‘না ভোট’ ছিল তিন লাখ ৮২ হাজার ৪৩৭টি। ওই নির্বাচনে ৩৮টি দল অংশগ্রহণ করলেও মাত্র ছয়টি দল ‘না ভোটের’ চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিল। অর্থাৎ ‘না ভোট’ সপ্তম অবস্থানে ছিল।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন জাতীয় নির্বাচনে ‘না ভোট’ প্রচলন এবং ‘না ভোট’ নির্বাচনে যদি সর্বোচ্চ ভোট পায়, তাহলে সেই নির্বাচন বাতিল করে পুনর্নির্বাচনের বিধান করার কথা বলছে। সেক্ষেত্রে বাতিল নির্বাচনের কোনো প্রার্থী নতুন নির্বাচনে আর প্রার্থী হতে পারবেন না, এমন বিধান করার প্রস্তাবনাও দেয়া হয়েছে।

রিকল বা প্রতিনিধি প্রত্যাহার

প্রথমবারের মতো দেশে রিকল বা প্রতিনিধি প্রত্যাহার ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাবনা দিয়েছে কমিশন। বলেছে, বিশ্বজুড়ে রিকল ব্যবস্থাকে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সক্ষম হন।

প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ‘এই ব্যবস্থা চালু করা গেলে একদিকে যেমন আইনপ্রণেতা বা সংসদ সদস্যদের (এমপি) ক্ষমতার চেক এন্ড ব্যালেন্স বা ক্ষমতার সামঞ্জস্য রক্ষা করা যাবে, তেমনি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নেতিবাচকভাবে এটির ব্যবহার হতে পারে এবং বেশি পরিমাণে রিকল আয়োজনে সরকারের নির্বাচনী ব্যয় বেড়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে’।

তারপরও এই ব্যবস্থা প্রচলনের পক্ষে মত দিয়েছে কমিশন। এর প্রক্রিয়াগত প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এড়াতে নির্বাচিত প্রতিনিধির মেয়াদের প্রথম ও শেষ বছরে রিকল নির্বাচন কার্যকর না করার প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে’।

রিকল নির্বাচন কার্যকরের উদাহরণ দিতে গিয়ে কমিশন বলছে, ‘প্রথমে কোনো ব্যক্তি বা দলকে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী আসনের মোট ভোটার তালিকার ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হবে হবে। রিকলের কারণ উল্লেখপূর্বক স্বাক্ষরসহ আবেদন নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দিতে হবে। কমিশন আবেদনটির যথার্থতা মূল্যায়নপূর্বক রিকল প্রক্রিয়া কার্যকরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। যদি ওই আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫১ শতাংশ) জনগণ রিকলের পক্ষে ভোট দেয়, তাহলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে তার পদ থেকে অপসারণ করা হবে’।

এমপি নির্বাচনে দলে তিন বছরের সদস্যপদ থাকা বাধ্যতামূলক


নতুন দল নিবন্ধনের শর্ত শিথিলের লক্ষ্যে ১০ শতাংশ জেলা ও ৫ শতাংশ উপজেলা বা থানায় দলের অফিস এবং ন্যূনতম পাঁচ হাজার সদস্য থাকার বিধানের প্রস্তাব করেছে কমিশন। দলের সাধারণ সদস্যদের তালিকা তৈরি ও ওয়েবসাইটে প্রকাশ এবং ওই তালিকা প্রতি বছর একবার হালনাগাদ করতে হবে। আরপিও’র ১২ ধারা অনুসারে সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য ব্যক্তিদেরকে কোনো নিবন্ধিত দলের সাধারণ সদস্য বা কমিটির সদস্য হওয়ার অযোগ্য করার প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে।

দলের অনুদান ব্যাংকিং চ্যানেলে নেয়ার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ট্যাক্স রিটার্নে প্রদর্শনের বিধান করার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। দলের তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতে নিবন্ধিত দরের বার্ষিকভাবে দাখিলকৃত অডিটেড আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ ও নির্বাচন কমিশনে দাখিল এবং কমিশনকে এগুলো অডিটের ক্ষমতা দেয়ার কথাও বলছে কমিশন।

সব রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র, শিক্ষক ও শ্রমিক সংগঠন, ভাতৃপ্রতিম বা যেকোনো নামেই হোক না কেন, তা না থাকার বিধান তৈরির প্রস্তাব রয়েছে ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে। দলের যেকোনো নামেই হোক না কেন, বিদেশি শাখা না থাকার সুপারিশও করা হয়েছে।

এই অনুচ্ছেদের (ঠ) উপ-অনুচ্ছেদে সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে দলে তিন বছরের সদস্যপদ থাকা বাধ্যতামূলক করতে বলছে কমিশন।

রাজনীতিমুক্ত নির্বাচন প্রশাসন

কমিশনের প্রতিবেদনে নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা যেন কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির প্রতি অনুগত না থাকেন, তা নিশ্চিতে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের সুপারিশ রয়েছে। এ দায়িত্ব পালনে পর্যাপ্ত সংখ্যক কমিশনের কর্মকর্তা পাওয়া না গেলে প্রশাসনসহ অন্য ক্যাডার থেকে নিয়োগ এবং রিটার্নিং বা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের আচরণবিধিমালা প্রণয়ন ও সেগুলো প্রয়োগের বিধানের কথাও বলা হয়েছে।

ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে রান-অফ পদ্ধতি প্রচলনেরও প্রস্তাব করেছে কমিশন। বলছে, কোনো নির্বাচনী এলাকা থেকে বিজয়ী হতে হলে সেই এলাকার সব প্রার্থী মিলে ভোট পাওয়ার হার হতে হবে ন্যূনতম ৪৫ শতাংশ। অন্যথায় পুনর্নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশনের ফলাফল স্থগিত ও বাতিলের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ