বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন
বড় পরিবর্তনের প্রস্তাবে সতর্কতারও পরামর্শ
পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন, বিচার প্রক্রিয়া দ্রুততর করা, বিচারক নিয়োগে পৃথক কমিশন গঠন, হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগের সর্বনিম্ন বয়স ৪৮ করা ও দেশের সব প্রশাসনিক বিভাগে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠাসহ বেশ কিছু সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন।
সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে এ প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। ৮ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা রয়েছে। এর আগে গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের দেয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনেও বিচার বিভাগ সংস্কার নিয়ে বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে বিচার বিভাগ নিয়ে এসব সংস্কার প্রস্তাবের বেশ কিছু বিষয়ে সতর্ক হতে পরামর্শ দিয়েছেন আইনজ্ঞরা।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন বেশ কিছু সুপারিশ করেছে তাদের প্রতিবেদনে। যার মধ্যে রয়েছে হাইকোর্ট বিভাগ ও অধস্তন আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ অর্থাৎ বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ ও উপজেলা পর্যায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠা, উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়া, নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা ও অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন।
আইনজীবী নিয়োগ পরীক্ষার সিলেবাসে সংশোধনীসহ কিছু প্রয়োজনীয় আইনের অন্তর্ভুক্তি ও সিলেবাস সম্প্রসারণ, বার কাউন্সিল কর্তৃক আইনজীবী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন ও নতুনভাবে নিয়োগকৃত আইনজীবীদের ছয় মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, বার কাউন্সিল অর্ডার ১৯৭২ সংস্কার, এনরোলমেন্ট কমিটির সদস্যপদ বৃদ্ধি, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের কার্যক্রম সম্প্রসারণ, বিকল্প উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন, মামলা জট কমানোর জন্য দেওয়ানী কার্যবিধি সংস্কার, প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্য বিচারকদের নিয়োগে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র কমিশন গঠন, আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগ কমিশনের কার্যক্রমে স্বার্থের সংঘাত পরিহার করতে হাইকোর্ট বিভাগের দুইজন বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীকে নিয়োগ কমিটির সদস্য না করা, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন, বিচার প্রক্রিয়া দ্রুততর করা, বিচারক নিয়োগে পৃথক কমিশন গঠন, হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগের সর্বনিম্ন বয়স ৪৮ করা ও দেশের সব প্রশাসনিক বিভাগে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি।
এছাড়া আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের প্রসারের বিষয়ে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলেছে, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার বিদ্যমান সেবাগুলোর পরিধি বাড়িয়ে আইনি সহায়তার পাশাপাশি মীমাংসা ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা ও বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্র সৃষ্টি করে মধ্যস্থতার কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করা।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনেরে এসব প্রস্তাবের বেশিরভাগকেই স্বাগত জানিয়েছেন আইনজ্ঞরা। তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সতর্কও করা হয়েছে। তাদের মতে কিছু কিছু প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে তা বিচার বিভাগের জন্য ভালো নাও হতে পারে। আবার কিছু প্রস্তাব আছে যা বাস্তবায়ন হলে সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আক্তার ইমাম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে ছয় বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ করা হয়েছিল। কিন্তু তা প্রথমে হাইকোর্ট ও পরে আপিল বিভাগ বাতিল করেছেন। এখন এটা আবার করলে সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রতিটি বিভাগে হাইকোর্ট বেঞ্চ গঠন হবে আদালত অবমাননা। কারণ সুপ্রিম কোর্টে উভয় বিভাগেই এটা বাতিল করে রায় দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনজীবী প্রতিনিধি না রাখাটা বাস্তব সম্মত নয়।’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেছেন, ‘হাইকোর্টে অস্থায়ী বিচারক নিয়োগের বয়স ৪৮ বাস্তবসম্মত নয়। এ বয়সেও যার প্র্যাকটিস ভালো হয়নি, তিনি যদি বিচারক হন তাহলে তিনি ভালো বিচারও করতে পারবেন না।’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের দুইজন বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীকে নিয়োগ কমিটিতে না রাখার সুপারিশ সঠিক হয়নি। ওই নিয়োগে স্বচ্ছতা বাড়াতে এদের কমিটিতে রাখা উচিত। কারণ তারা সবচেয়ে ভালো জানবেন কোন বিচারক আপিল বিভাগে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত।’
এ ব্যাপারে সংস্কার কমিশনের সদস্য হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ফরিদ আহমেদ শিবলী ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়া হবে। এরপর এই প্রস্তাবের কী কী বাস্তবায়ন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।’
বিচার বিভাগকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ৩ অক্টোবর বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানকে প্রধান করে করা এই কমিশনের সদস্য হলেন বিচারপতি এমদাদুল হক (হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ), বিচারপতি ফরিদ আহমেদ শিবলী (হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ), সাইয়েদ আমিনুল ইসলাম (সাবেক জেলা ও দায়রা জজ এবং সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার), মাজদার হোসেন (সাবেক জেলা ও দায়রা জজ এবং মাজদার হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলার বাদী), তানিম হোসেন শাওন (সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট), কাজী মাহফুজুল হক (সুপন), অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে