বাড়ছে না করমুক্ত আয়সীমা
আরও চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ
জীবনযাত্রার মান টিকিয়ে রাখার সংকট, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপের মধ্যেই শুরু হয়েছে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট কার্যক্রম। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে হিমশিম খাওয়া দেশের সাধারণ মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে আরও অস্বস্তি। কর আদায় বৃদ্ধি করতে না পেরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাজারে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে ভাবছে না। দেশের সাধারণ মানুষের ব্যয়যোগ্য আয় আরও সংকুচিত হওয়ায় চাপের মুখে পড়তে হবে তাদের।
সংশ্লিষ্টদের মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি মূলত আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব। এটি ঠেকাতে সরকার খুব বেশি কিছু করতে পারে না। তবে সরকারের হাতে যা থাকে তা হচ্ছে অর্থ ও অর্থনৈতিক কৌশল, যার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির ধাক্কা থেকে জনগণকে রক্ষা করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
অর্থনীতিবিদ ও খাত সংশ্লিষ্টরা করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ানোর বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দেশের মাথাপিছু আয়ের তুলনায় করমুক্ত আয়সীমা বেশি হওয়ায়, তা স্থির রাখার পক্ষপাতী। অন্যদিকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম ও এনবিআর-এর আয়কর নীতির সাবেক সদস্য ড. সৈয়দ আমিনুল করিম দেশের মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বিবেচনায় করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো প্রয়োজন বলেন মনে করেন।
তবে অন্যদিকে, আয়সীমা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন অনেক এনবিআর কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআর-এর আয়কর নীতির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ভিউজ বাংলাদেশকে জানান, এনবিআর-এর বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে দেশে করদাতার সংখ্যা কোটি ছাড়িয়েছে। রিটার্নদাতার সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। রাজস্ব আদায়ের একটা চাপ সবসময়ই থাকে। তারপরও এনবিআর সাধারণ মানুষের উপর করের বোঝা চাপিয়ে দিতে চায় না। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে কিন্তু সেই সঙ্গে মানুষের আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর বিষয়টি তাই বিবেচনার সুযোগ কম।
বর্তমানে দেশে করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। নারী ও ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ টাকা। প্রতিবন্ধীদের করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা। তৃতীয় লিঙ্গের করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী, আয়ের প্রথম ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার ওপর কোনো কর দিতে হয় না। পরবর্তী ১ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৩ লাখ টাকায় ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখ টাকায় ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকার ওপর ২০ শতাংশ ও বাকি আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ আয়কর দিতে হয়।
আয়কর আইন অনুযায়ী, করমুক্ত আয়সীমা অতিক্রম করলেই ন্যূনতম কর দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি চট্টগ্রাম সিটির করদাতাদের ৫ হাজার টাকা; অন্য সিটির করদাতারা ৪ হাজার টাকা ও অন্য এলাকার করদাতাদের ন্যূনতম ৩ হাজার টাকা কর দিতেই হবে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ১ কোটির বেশি কর সনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএনধারী) আছেন। তাদের মধ্যে ৪০ লাখ টিআইএনধারী আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন, যদিও সব টিআইএনধারীর রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক।
ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির কারণে নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এজন্য করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংস্থা ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। সংগঠনটি বলছে, এতে স্বল্প আয়ের মানুষকে মূল্যস্ফীতির বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিতে পারে। এফবিসিসিআই ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী সংগঠন করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর কথা বলেছে।
প্রাক-বাজেট আলোচনায় বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। তাই মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে আগামী বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো উচিত।
তবে এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর চিন্তা করা হলেও করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ালে বিপুলসংখ্যক করদাতা করজাল থেকে বেরিয়ে যাবেন। আর যারা করজালে থাকবেন, তাদের করের পরিমাণ কমবে। এ কারণে বর্তমান প্রান্তিক করদাতাদের করজালে ধরে রাখতে বিকল্প চিন্তাও করছেন কর কর্মকর্তারা।
এনবিআর-এর আয়কর নীতির সাবেক সদস্য ড. সৈয়দ আমিনুল করিম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, গত এক থেকে দুই বছরে মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি। সেই বিবেচনায় করমুক্ত আয়সীমা কমপক্ষে ৪ লাখ টাকা হওয়া উচিত। ৪ লাখ টাকা হলে একটা ন্যায্য সীমা হত। না করা হলে এটা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য একটা চাপ হবে এবং আয়বৈষম্য আরও বাড়িয়ে তুলবে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের আয় দিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছেন। উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে এই সীমা আরেকটু বাড়িয়ে দিলে তা মানুষের জন্য সুবিধা হত। পরবর্তীতে কর দিতেও তারা উৎসাহিত বোধ করত।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, করমুক্ত আয়ের সীমা না বাড়ালে সমাজে ধনী-গরিবের মাঝে আয় বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাবে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে।
তবে ভিন্নমত পোষণ করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, “রাজস্ব বাড়ানোর স্বার্থে এনবিআর-এর এই চিন্তা খারাপ না। আয় বাড়ার সাথে সাথে যদি করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে ফেলি, তাহলে করদাতা বাড়বে না। বর্তমান করমুক্ত আয়সীমা ৩ হাজার ২০০ ডলারের (৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা) মতো। সে তুলনায় মাথাপিছু আয় আরও বেশি (২ হাজার ৭৪৯ ডলার)। গড়ের চেয়ে করমুক্ত আয় বেশি হলে অর্ধেক মানুষ এর ভেতর পড়ে যাবে। আমার মতে কয়েক বছর না বাড়ানোই ভালো।”
উল্লেখ্য, সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছিল। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা ২ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে আড়াই লাখ টাকা করা হয়েছিল।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে