অনুষ্ঠিত নির্বাচনের জটিল হিসাব
বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর টানা ৪৮ ঘণ্টা হরতালের মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করল নির্বাচন কমিশন। ৭ জানুয়ারি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বিকেল ৩টা পর্যন্ত গড়ে ২৭ শতাংশ ভোট পড়েছে জানানো হলেও ৪টার পর নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ভোট কাস্ট হয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
নির্বাচন কমিশন ভোট সন্তোষজনক হয়েছে বলেও উল্লেখ করেছে। নির্বাচন কমিশন আশা করেছিল ৫০ শতাংশ ভোট পড়তে পারে। রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগও চেয়েছিল ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ভোট যাতে কাস্ট হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নির্বাচনটিকে সফল বলে দেখানো যাবে। তার থেকে খানিকটা কম হলেও মোটামুটি সন্তোষজনক বলেই নির্বাচন কমিশন এবং আওয়ামী লীগ মনে করছে। অন্তত কোনো লজ্জাজনক ভোটার অনুপস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি। উল্লেখ্য, বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো জনগণকে ভোট বর্জনের অনুরোধ জানিয়ে আসছিল। তারা দেশব্যাপী ১২ কোটি লিফলেট বিলিয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের শাসনামলে তাদের ভাষায় দুর্নীতি, দুঃশাসনের কথা তুলে ধরেছেন। ১২ কোটি লিফলেট বিতরণ ও প্রচারের তথ্য খোদ দলটির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু একটি অন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন। এই প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে একেবারে পরিচিত এবং সরাসরি সমর্থক ছাড়া অন্য সাধারণ ভোটারদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে হয়নি। একটি বড় দল হিসেবে বিএনপির দেশে আনুমানিক ২৫ শতাংশ সরাসরি কর্মী-সমর্থক রয়েছে।
আওয়ামী লীগেরও তেমনি ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ সরাসরি কর্মী-সমর্থক রয়েছে। বাকি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষ ভাসমান ভোটার ও কিছু ছোট দলের সমর্থক। অর্থাৎ তারা যখন যে দলকে ভালো মনে করেন, সেই দলকে সমর্থন দেন বা সেই দলের প্রার্থীকে ভোট দেন। এই ৫০ শতাংশ ভোটার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এদের নিয়েই মূলত বড় দুই দলের মধ্যে কাড়াকাড়ি হয় তা আমরা বিগত দিনে দেখেছি। বাংলাদেশে সাধারণত খুব ভালো, স্বচ্ছ ভোট হলে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়। সুতরাং এই অঙ্কের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রে আনতে পেরে আওয়ামী লীগ সফল হয়েছে। অবশ্য এই ভোটার উপস্থিতির জন্য প্রার্থীদের অনেক বড় ভূমিকা ছিল। আওয়ামী লীগের লক্ষ্য ছিল, যতই প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে না থাকুক, কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলে এবং নির্বাচনটি মোটামুটি স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন করা গেলে এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা আন্তর্জাতিকভাবে তৈরি হবে। কারণ খেয়াল করলেই দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্র দু-একবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বললেও প্রধানত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের ওপরই জোর দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কখনো সরাসরি বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না এমন কথা বলেনি।
এ কথাও অনস্বীকার্য যে এই নির্বাচনটি ২০১৪ অথবা ২০১৮ সালের মতো ছিল না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, প্রার্থীদের ভোটারের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলও এ নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে। এবং এটাও লক্ষ্য করা গেছে যে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেছে। আমরা জানি, বিশ্বের ৮০ শতাংশ গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত হয় পশ্চিমা স্টেটক্র্যাফটের দ্বারা। কেবলমাত্র ভারত, মধ্যপ্রাচ্য এবং রাশিয়ার তৈরি নতুন ব্লক ছাড়া বাকি গণমাধ্যম বিএনপির সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলতে চেষ্টা করেছে। আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ব্যাপার লক্ষ্য করা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র, স্কটল্যান্ড, চীন, উজবেকিস্তান, ওআইসি, রাশিয়া, ফিলিস্তিন ও গাম্বিয়া থেকে আসা পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন নিয়ে অন্তত অসন্তোষ প্রকাশ করে বিবৃতি দেননি। এটিও আওয়ামী লীগের এক ধরনের বিজয়। পর্যবেক্ষকরা কত ভোটার উপস্থিত হলো তার চেয়ে বেশি ভোট কতটা সুষ্ঠু হচ্ছে এবং কারচুপি হচ্ছে কি না, সেই দিকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
নির্বাচন একবারে সহিংসতামুক্ত ছিল তা বলার উপায় নেই। ১৮ কোটি মানুষের দেশ। জাতীয় নির্বাচন কখনোই পুরোপুরি অসহিংস হতে আমরা দেখিনি। বরং সেই তুলনায় ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল অনেক শান্তিপূর্ণ। দেশের প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টায় কোনো ত্রুটি দেখা যায়নি। সারা দেশে ১৪০টি কেন্দ্রে অনিয়ম এবং ৪২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের এই পদক্ষেপ অধিকাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে। এমনকি নৌকা মার্কার একজন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করেছে কমিশন। সারাদেশে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির কারণে সহিংসতা তীব্র আকার ধারণ করতে পারেনি।
কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য আওয়ামী লীগ যে পন্থা অবলম্বন করেছে তা দীর্ঘমেয়াদি রাজনীতিতে দলটির ক্ষতির কারণ হতে পারে। দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের নেতা বা কর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। অনেকটা স্থানীয় নির্বাচনের মতো। এতে দলের মধ্যে যে ঐক্য থাকার কথা তা ব্যাহত হয়েছে। দেশব্যাপী দেখা গিয়েছে, নৌকার প্রার্থীর সমর্থক ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, সংঘাত। কিছু কিছু আসনে এমনো দেখা গেছে যে নৌকার প্রার্থীর চাইতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা অধিক সংখ্যায় মাঠে নেমেছে। এই বিভাজন ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ কী করে সমঝোতায় আনবে তা দলের ভাবনা ও পলিসি ও কৌশলের ওপর নির্ভর করছে।
নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভূমিকা নির্বাচনকে আরও জটিল করে দিয়েছে। বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির থাকার কথা ছিল। দীর্ঘদিন যাবত জাতীয় পার্টি নেতা জি এম কাদের সরকারের সমালোচনা করে আসছিলেন; কিন্তু শেষ মুহূর্তে কী ভয় পেলেন কে জানে, তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় আসল ২৬টি আসনের ব্যাপারে। এটি জাতীয় পার্টির ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জাতীয় পার্টির সুযোগ ছিল পূর্ণ বিরোধী দল হিসেবে, সরকারের সমালোচনায় মুখর থেকে বিএনপির ভোটারদের কাছে টানার। তাতে অনেক আসনে বিজয় ছিনিয়ে নিতে পারতো বলেই আমাদের ধারণা। কিন্তু সে ঝুঁকি তারা নেননি। জাতীয় পার্টির মরহুম নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতাচ্যুতির পর তারা তিনি বিপুল ভোটে ৫টি আসন থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন। এবং উত্তবঙ্গকে জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত করেছিলেন। সে জায়গাটি যে জি এম কাদের ধরে রাখতে পারেননি এবারের নির্বাচন তার প্রমাণ।
নির্বাচনের পর সরকার গঠন হবে শিগগির। সেক্ষেত্রে আসতে পারে নতুন চমক। হয়তো আমরা দেখব অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী কেবিনেট সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন। সেটা দেখতে আর মাত্র কয়েকটি দিন অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে বিএনপি এবং সমমনা দলগুলোর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হয়, মার্কিন যুক্তষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কী হয়, অন্যান্য দেশ কীভাবে এই নির্বাচন দেখবে তা বুঝতে।
লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে