মামলা গ্রহণের আগে ভালো করে তদন্ত করা হোক
সমাজ-রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে আইন-আদালত-মামলার উৎপত্তি; কিন্তু ক্ষমতাশালী মানুষের ইঙ্গিতে এবং খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফিলতিতে নির্দোষ-নিরীহ ব্যক্তিও অনেক সময় হয়রানির শিকার হতে পারেন, যার সাম্প্রতিক নজির সুপ্রিম কোর্টের প্রথিতযশা আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী জেড আই খান পান্নার বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলা।
গতকাল সোমবার (২১ অক্টোবর) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের পক্ষে আদালতে যাওয়া সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নাকে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি করা হয়েছে। রাজধানীর খিলগাঁও থানায় ১৭ অক্টোবর মামলাটি করা হয়। এই মামলায় নাম উল্লেখ করা আসামি মোট ১৮০ জন। ৯৪ নম্বর নামটি জেড আই খান পান্নার।
কোনো ধরনের প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই এই মামলা নেয়া হয়েছে বলে জানান খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. দাউদ হোসেন। তিনি গতকাল রাতে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বাদীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে আসামিদের নাম-ঠিকানা সঠিক আছে কি না, সেটি তদন্ত করে দেখা হয়েছে। তবে আসামিরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত কি না, সেটি প্রাথমিকভাবে তদন্ত করা হয়নি। তিনি বলেন, তদন্তের পর কেউ জড়িত না থাকলে তার নাম বাদ দেয়া হবে।
এই খিলগাঁও থানাতেই জেড আই খান পান্নাসহ ১৮০ জনের বিরুদ্ধে নিজের ছেলে আহাদুল ইসলামকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেছিলেন মো. বাকের। জেড আই খান পান্নার বিরুদ্ধে করা মামলায় গত ১৯ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আহাদুল ইসলামকে গুলি ও মারধর করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়। ঘটনার প্রায় তিন মাস পর ১৭ অক্টোবর খিলগাঁও থানায় মামলাটি করেন আহাদুলের বাবা মো. বাকের।
সুপ্রিম কোর্টের এই প্রথিতযশা আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীর বিরুদ্ধে মামলার পর দেশজুড়ে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়। কারণ, মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন জেড আই খান পান্না একজন স্বচ্ছ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থি নানা আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন।
আরও আজব ব্যাপার, গতকাল সকালেই এ হত্যাচেষ্টা মামলার বাদী মো. বাকের সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, তিনি জেড আই খান পান্নাকে চেনেন না। বিএনপি ও জামায়াতের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে তিনি এ মামলা করেছেন। আর এ কাজে পুলিশ সহযোগিতা করেছে। এখন এটা সহজেই অনুমান করা যায়, একটি মামলা গ্রহণের আগে পুলিশ কতখানি অসতর্কতা পালন করে!
আমরা মনে করি, এটা কোনো না কোনো প্রভাবশালীর ইন্ধনেই হয়েছে। অথচ তিনি কোটা আন্দোলনকারীদের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। আবার যে স্থানের কথা বলা হয়েছে, সেই মেরাদিয়ায় তিনি কখনো যান নাই। অহেতুক এরকম এক মামলায় হয়রানি করার জন্য জেড আই খান পান্না অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তীব্র সমালোচনার পরে গতকাল হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ জেড আই খান পান্নাকে এ মামলায় পুলিশি প্রতিবেদন দাখিল পর্যন্ত জামিন দিয়েছেন।
গতকাল দুপুর ১২টার দিকে থানায় এসে সেই বাকেরই আবার আইনজীবী পান্নাকে বাদ দেয়ার আবেদন জানান বলে জানিয়েছেন খিলগাঁও থানার ওসি মো. দাউদ। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে এখানে পুলিশের অসতর্কতা ও অবহেলার বিষয়টি স্পষ্টই চোখে পড়ে। এজাহারী মামলা গ্রহণের আগে পুলিশের উচিত আরও ভালো করে তদন্ত করা।
আমরা চাই পুলিশ এসব মামলা গ্রহণের ব্যাপারে আরও সতর্ক হবে এবং দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে। তা না হলে প্রকৃত অপরাধীদের বিচার না হয়ে হয়তো বিচার হবে নিরঅপরাধ মানুষের। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম দায়িত্ব গণঅভ্যুত্থানের সময় যারা নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তাদের বিচার করা। নিরপরাধ মানুষ যদি কোনোভাবে হয়রানির শিকার হন, তাহলে এই সরকারের প্রতি মানুষের আস্থাও বিনষ্ট হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে