Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

নতুন করে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা

Rayhan Ahmed Tapader

রায়হান আহমেদ তপাদার

বৃহস্পতিবার, ৮ আগস্ট ২০২৪

রান নিয়ে কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা পারমাণবিক উত্তেজনা, শত্রুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ এবং পশ্চিমাদের সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ব্যাপারে নতুন প্রেসিডেন্টরা অনেক সময় পেয়েছিলেন; কিন্তু দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান পেলেন মাত্র ১০ ঘণ্টা। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার শপথ গ্রহণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেশটির রাজধানী তেহরানে শক্তিশালী রেভলিউশনারি গার্ডের অতিথিশালায় হামলায় নিহত হলেন হামাস নেতা হানিয়া। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের রাজনৈতিক শাখার নেতা হানিয়াকে ইরানের প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান ও দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। তাদের পক্ষ থেকে এ হামলাকে ইসরায়েলের লজ্জাজনক কাজ বলে মন্তব্য করা হয়েছে।

গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলার মধ্যেই লেবানন ও ইরানের ভেতর একাধিক ইসরায়েলি হামলায় পাল্টা প্রতিশোধের ঘোষণা দিয়েছে ইরান ও তার প্রক্সি হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুতিরা। এতে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পেজেশকিয়ান ও খামেনির শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের হাতে ইসরায়েলে হামলা করা ছাড়া আর ভিন্ন কোনো পথ বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল না। পেজেশকিয়ান তার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনটি তাই কাটিয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়েছে। হানিয়ার হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলে সরাসরি হামলার নির্দেশ দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। এর আগে হানিয়া নিহত হওয়ার পর এক এক্স বার্তায় প্রতিশোধের বার্তা দেন আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। তিনি লিখেছেন, ইরানের সীমানার মধ্যে ঘটা এমন তিক্ত ও দুঃখজনক ঘটনার পর প্রতিশোধ নেয়াটা আমাদের কর্তব্য। গত এপ্রিলে ইসরায়েলে এক দফা হামলা চালিয়েছিল ইরান।

অবশ্য ওই সময় ইরানের ৩০০ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের ৯৯ শতাংশই আকাশে থাকা অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, জর্ডান ও যুক্তরাজ্য জোট ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। এবারে ইরান কীভাবে প্রতিশোধ নিতে চায়, তা এ সংঘাতে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। ইরান যদি আগের মতোই সরাসরি হামলা চালায়, তাহলে উত্তেজনা আরও বেড়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ঘনিষ্ঠ লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ যদি ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে হামলা করে বা সিরিয়ার হুতিরা যদি লোহিত সাগরে তাদের হামলা আরও বাড়ায়, তাহলে লেবানন ও সিরিয়ায় যুদ্ধ আরও ছড়িয়ে পড়বে। ৯ মাসের বেশি সময় ধরে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমিক আন্তঃসীমান্ত সংঘাত চলছে। এ সময় ইসরায়েলে হামলা চালাতে নানা রকম অস্ত্র ব্যবহার করেছে হিজবুল্লাহ।

বিশ্বের অন্যতম অরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর ভান্ডারে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র আছে। বলা হয়ে থাকে যে অরাষ্ট্রীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে হিজবুল্লাহর কাছেই সবচেয়ে বেশি অস্ত্রের মজুত আছে। এ ক্ষেত্রে লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল চালু রাখতে মার্কিন নৌবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এর বাইরে আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ উপায় আছে ইরানের হাতে। সেটি হলো, তাদের পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করা। কয়েক দশক ধরে তারা এ পথে হেঁটেছে। তারা পারমাণবিক জ্বালানি তৈরি ও সম্প্রতি বোমা তৈরির মতো ইউরেনিয়ামের সংগ্রহ সমৃদ্ধ করেছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা মনে করেন যে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে রয়েছে। তবে ইরানের নেতারা সম্প্রতি সরাসরি এ পথে হাঁটার কথা বিবেচনা করছেন বলে জনসম্মুখে বলেছেন। হানিয়া হত্যার জবাব দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে হামাস। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের খানানি বলেছেন, হানিয়ার রক্ত কখনোই বৃথা যাবে না। এর ফলে গাজায় যুদ্ধ চলার মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

হানিয়ার আগেই লেবাননের রাজধানী বৈরুতে হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহর এক নেতাকে হত্যার দাবি করে ইসরায়েল। ২৪ ঘণ্টার কম সময়ে ইরান-সমর্থিত দুই সশস্ত্র সংগঠনের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতার হত্যাকাণ্ডে স্বাভাবিকভাবেই মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা নতুন করে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার অভিপ্রায় ইরানের আছে। কারণ, হামাস নেতাকে হত্যার ঘটনায় ইরান সরকারের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যুর জেরে মধ্যপ্রাচ্যে বড় আকারে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। এ নিয়ে জরুরি বৈঠক আয়োজন করা হয় নিরাপত্তা পরিষদে। সেখানেও ছড়ায় উত্তাপ। ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনসের মধ্যপ্রাচ্য-গবেষক কেলি পেটিলো বলেছেন, এই দুই হত্যাকাণ্ডের প্রভাব গোটা অঞ্চলের ওপর পড়বে।

জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চেভেলে তিনি বলেছেন, ঠিক কী প্রভাব পড়বে তা এখনই বলা কঠিন, তবে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকা উচিত। তিনি বলেছেন, হানিয়ার মৃত্যুর পর ইসরায়েল হামাসের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে শেষ করে দিল। এই রাজনৈতিক নেতারা ছিলেন মধ্যপন্থি। কাতার, মিশর ও যুক্তরাষ্ট্র যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির চেষ্টা করছে, তাতে হানিয়ার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে, এখন সামরিক শাখার নেতারা আরও বেশি করে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন পাবেন। তারাও বলতে পারবেন, হানিয়া আলোচনার রাস্তায় গেছিলেন। তার কী হাল হলো তা দেখা যাচ্ছে। যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনায় চীনও একটা চেষ্টা করছিল। তারা ১৪টি ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর মধ্যে আলোচনার ব্যবস্থা করেছিল। যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা কে শাসন করবে, তা নিয়ে একটা মতৈক্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিল। হানিয়ার মৃত্যু তাতেও প্রভাব ফেলতে পারে।

এ ছাড়া হামাস যাদের বন্দি করে রেখেছে, তাদের মুক্তির ওপরেও এর প্রভাব পড়তে পারে। জেরুজালেমে হিব্রু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সাইমন উলফগ্যাং ডিডব্লিউকে বলেছেন, হানিয়ার মৃত্যুর প্রভাব কী হবে, তা এখনই আন্দাজ করাটা কঠিন। তবে বন্দিমুক্তি নিয়ে আলোচনা একেবারে শেষ পর্যায়ে ছিল। এই হত্যাকাণ্ড তার ওপর প্রভাব ফেলবে বলে মনে হচ্ছে। হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত বাড়বে শুধু তাই নয়, হিজবুল্লাহ নব উদ্যমে এই সংঘাতের মধ্যে নিজেদের জড়াতে পারে। সাইমন উলফগ্যাং বলেছেন, 'বহু বছর ধরে হিজবুল্লাহ ও হামাসকে সমর্থন করছে ইরান। তেহরানে হানিয়ার মৃত্যু ইরানকে ধাক্কা দেয়ার মতো ঘটনা।

সবচেয়ে বড় কথা, নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের সময় এটা ঘটল। এটাও দেখানো হলো, ইরান তার অতিথিকেই নিরাপত্তা দিতে পারে না। পেটিলো বলেছেন, ইরানের মাটিতে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে। তাই ইরান এখন প্রত্যাঘাত করতে চাইবে। তাদের দিকে এখন নজর থাকবে। ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের মধ্যে দীর্ঘদিনের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। তেহরানের বিতর্কিত পরমাণু কর্মসূচি, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ইসরায়েলকে ধ্বংসের শপথ নেয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থনের কারণে দীর্ঘদিন ধরে ইরানকে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখে আসছে ইসরায়েল। অন্যদিকে ইরানও নিজেকে ইসরায়েলি শাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দেখে এবং দেশটির শীর্ষ নেতারা বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। ইরানের রাষ্ট্রদূত আমির সাঈদ ইরাভানি নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে বলেন, 'ইসরায়েলকে এই আগ্রাসনের জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আনতে নিরাপত্তা পরিষদের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়া উচিত। 'তেহরানে হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া ভোরে নিহত হওয়ার পর তার সরকার এই অনুরোধ করে।

এর মধ্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং আরও লঙ্ঘন রোধে অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনা করা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বারা ইসরায়েলের অশুভ কার্যকলাপ সহ্য করা হবে না এমন সংকেত দেয়া অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়া হামাস নেতা নিহত হওয়ার জন্য ইরান ও হামাস ইসরায়েলকে দায়ী করছে। ইসরায়েল এই হামলার দায় স্বীকার না করলেও জোর ধারণা, তারা এই হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯৭ সালে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে। ইসরায়েল, মিশর, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপানও হামাসকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে। লেবাননের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স বলেন, ইসরায়েল এই অঞ্চলকে বিপর্যয়কর পরিণতিসহ একটি বৃহত্তর যুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে।

যুক্তরাষ্ট্রের দূত রবার্ট উড বলেন, হিজবুল্লাহ নেতার ওপর ইসরায়েলের হামলার সঙ্গে ওয়াশিংটন জড়িত নয় এবং হামাস কর্মকর্তার লক্ষ্যবস্তু করার বিষয়ে তারা অবগত বা জড়িত ছিল না। তিনি বলেন, 'তার মৃত্যুর বিষয়ে হামাসের দাবি নিয়ে আমাদের কাছে নিরপেক্ষ কোনো নিশ্চয়তা নেই। 'এই হামলার ফলে আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গাজার যুদ্ধের কারণে টগবগ করে ছড়িয়ে পড়তে পারে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরান কী করতে সক্ষম তার সামান্য চিত্র দেখাল মাত্র। এটা এমন একটি দৃশ্য যা কখনো কেউ দেখেনি। এমন হামলার পরেই পাল্টা হামলার আশঙ্কায় সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী, একই সঙ্গে ইসরায়েলের প্রতিও সতর্কবার্তা দিয়ে রেখেছে।

রায়হান আহমেদ তপাদার: গবেষক ও কলাম লেখক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ