নির্বাচন ঘিরে অনলাইন প্লাটফর্মে গুজব আতঙ্ক
ঘনিয়ে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সামনে আর মাত্র কয়েক মাস। নির্বাচন ঘিরে ছড়াতে শুরু করেছে রাজনৈতিক উত্তাপ। এ সময়টাতে মাঠের রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন প্লাটফর্মেও সরব হতে দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক কর্মী, রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ সমাজের একটি বড় অংশের মানুষকে। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অনলাইন প্লাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে দেশের অভ্যন্তরে অরাজকতা সৃষ্টির শঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অনলাইন প্লাটফর্মেই সবচেয়ে দ্রুত গতিতে গুজব ছড়ায় এবং এর মারাত্নক প্রভাব পড়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তাই আমাদের সচেতন থাকার বিকল্প নেই।
বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটি ২৫ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রতি বছর নতুন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে ১১ দশমিক ৬ শতাংশ হারে, যার পরিমাণ ৫৫ লাখ। এই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৯৯ শতাংশই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অনলাইন প্লাটফর্মে যুক্ত থাকে বলে এক পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিচ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্ট্যাডিজ (বিআইপিএসএস)।
একই রকম তথ্য উঠে বিশ্বের অন্যতম গবেষণা সংস্থা ডেটা রিপোর্টালের তথ্যে। তারা বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ কোটি ৬৯ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে বাংলাদেশে। যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৮ দশমিক ৯ শতাংশ। একইসঙ্গে দেশটিতে অনলাইন ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪ কোটি ৪৭ লাখ। যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ। দেশে এক্টিভ মোবাইল কানেকশন আছে ১৭ কোটি ৯৯ লাখ। যা তাদের মোট জনসংখ্যার ১০৪ দশমিক ৬ শতাংশের সমান।
বিপুল সংখ্যক মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত রয়েছে। যেখানে এই জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ তথ্য যাচাইয়ের বিষয়ে সচেতন নয়। ফলে যেকোনো গুজব যেকোনো সময় ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি বলে মন্তব্য করেন দেশের অন্যতম গুজব সনাক্তকারী প্রতিষ্ঠান বিডি ফ্যাক্টচেকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ড. জাহেদ আরমান। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে গণমাধ্যম সম্পর্কিত জ্ঞান খুবই কম। যার কারণে তারা অনলাইনে কোনো কিছু দেখলেই তা বিশ্বাস করেন। অনেকেই মনে করেন ফেসবুকে কোনো তথ্য আসছে মানে এটা সত্য। এটার সোর্স কে তা আর যাচাই করেন না। এমনকি অনেক শিক্ষিত লোকজনও রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কোনো তথ্য মিথ্যা হলেও তা শেয়ার দেয়। কারণ এই তথ্যটা তার নিজের মতাদর্শের সঙ্গে যাচ্ছে।”
এদিকে বিশ্বে এখন জনসংখ্যা ৭৯১ কোটি থাকলেও মোবাইল ফোন চালু রয়েছে ৮২৮ কোটি। অর্থাৎ জনসংখ্যার চেয়ে চালু করা মোবাইলের ফোনের সংখ্যা বেশি। একইসঙ্গে এখন বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪৯৫ কোটি। যেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত আছে ৪৬২ কোটি মানুষ। বিশাল সংখ্যক এই জনগোষ্ঠীর বিচরণক্ষেত্র সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে গুজবে ছড়িয়ে পড়ার হার আশঙ্কাজনক। তুরস্কে নিউজের নামে গুজব ছড়ানোর হার ৪৯ শতাংশ, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। মেক্সিকোতে এর পরিমাণ ৪৩ শতাংশ, ব্রাজিলে ৩৫ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৩১ শতাংশ , দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩০ শতাংশ, স্পেনে ২৯ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ২৫ শতাংশ। এ তালিকায় এমন আরও অনেক দেশের নাম রয়েছে বলে বিআইপিএসএসের তথ্যে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন ঘিরে গুজব ছড়ানোর হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে পারে উল্লেখ করে ড. জাহেদ আরমান বলেন, “নির্বাচনকে সামনে রেখে ভুয়া সংবাদ ছড়ানোর প্রবণতা বেড়ে যায়। গত ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও রাজনৈতিক নেতাদের নামে বিভিন্ন ভুয়া সংবাদ ছড়ানো হয়েছিল। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে নিঃসন্দেহে তা আরও বাড়বে।”
গত কয়েক মাসের তুলনায় এখন গুজব ছড়ানোর হার অনেক বেশি উল্লেখ করে সিআইডি সাইবার পুলিশ সেন্ট্রালের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. রেজাউল মাসুদ বলেন, “অনলাইন প্লাটফর্মেই সবচেয়ে দ্রুত গুজব ছড়ায়। আসন্ন নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির পক্ষ থেকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বিভিন্ন দলের নেতাদের গ্রেপ্তার সংক্রান্ত ভুয়া সংবাদ ছড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়াও মার্কিন ভিসা নীতি প্রয়োগ, কারা মার্কিন স্যাংশনের আওতাভুক্ত হয়েছেন এবং ফিলিস্তিনি-ইসরাইল যুদ্ধ নিয়েও ব্যাপক হারে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এগুলো মূলত সামাজিক অস্থিরতা ছড়ানোর জন্যই করা হচ্ছে।”
তবে গুজবের এই ভয়াবহতার সময় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় তৎপর রয়েছে পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা বিভাগ। এ বিষয়ে রেজাউল মাসুদ বলেন, “গুজব প্রতিরোধ করতে আমরা তৎপর রয়েছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। যেগুলো গুজব ছড়ানো হচ্ছে সেগুলো কাউন্টার দেওয়া হচ্ছে। যে সকল পেইজ থেকে বা আইডি থেকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে সেগুলোকে সনাক্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
এদিকে সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে যেমন গুজব রোধ করা সম্ভব নয় তেমনি নিরাপরাধ ব্যক্তিও বিপদে পড়তে পারেন বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মুসতাসীম তানজীর। তিনি বলেন, “গুজব প্রতিহত করার জন্য ভিপিএন দিয়ে চালানো ফেসবুকের সব ফেক আইডি দমন করা অসম্ভব। ফলে গুজব রোধের নামে আবারও অনেক নিরাপরাধ ব্যক্তি এই আইনের দ্বারা বিপদগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।”
সাধারণ জনগণের অনেকেই মনে করছেন গণমাধ্যমের বাকস্বাধীনতা অনেকাংশে কমেছে। সেজন্য তারা সব খবর প্রচার করতে পারছে না। ফলে এই খবরগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই পাওয়া যাবে এবং এটি অনেকের বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন এ আইনজীবী। তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় দমন-পীড়নের হাত থেকে বাঁচতে অন্যদের মতো সেলফ সেন্সরশীপ আরোপ করেছেন সাংবাদিকরাও। এই অবস্থায় সংবাদ মাধ্যমের উপর মানুষের আস্থাহীনতা এবং সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো গুজব বিশ্বাস করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি খুবই যৌক্তিক এবং স্বাভাবিক বিষয়।”
এদিকে গুজবের এই ব্যাপক বিস্তারের সময় নিরাপত্তার স্বার্থে জনগণকে সঠিক তথ্য যাচাইয়ের পরামর্শ দিয়েছেন সমাজবিজ্ঞানী ও ইস্টার্ন ফিনল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো শহীদ মল্লিক। তিনি বলেন, “যেকোনো সংবাদ বিশ্বাস কিংবা শেয়ার করার আগে আমাদের তা যাচাই করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অনেকেই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। আমরা যেন সচেতন মানুষ হিসেবে তাদের সে সুযোগটা করে না দেই। একইসঙ্গে দায়িত্বশীলদের সঠিক সংবাদ প্রবাহের নিশ্চয়তা দিতে হবে। যেন গুজবের ভিড়ে আসল সংবাদটা হারিয়ে না যায়।”
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে