ওষুধের দাম আবারও বাড়ার শঙ্কা
নব্বইয়ের দশকে পেরেস্ত্রইকার ধাক্কায় যখন ধরাশায়ী একদা পরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অগত্যা পূর্ব ইউরোপজুড়ে একের পর এক সোভিয়েত ব্লকের দেশগুলো, তখন তার ধাক্কাটা গিয়ে লেগেছিল পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত। সে সময় হাতেগোনা যে দুই-একটি দেশ পেরেস্ত্রইকা সুনামী সামলে বহাল তবিয়তে টিকে গেছে এবং এখনো আছে, তার অন্যতমটি হলো কিউবা। অথচ উইরোপে একের পর এক ধরাশায়ী রাষ্ট্রের কাতারে কিউবা একদম শুরুর দিকেই থাকবে এমনটাই ছিল প্রত্যাশা। কারণটাও সঙ্গত, দেশটার মাত্র নব্বই মাইলের দূরত্বে থাবা মেলে ওত পেতে বসে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
কিউবার সে যাত্রায় পার পেয়ে যাওয়ার গল্পটাও দারুণ। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের নতুন ওষুধ ‘ন্যাসভ্যাক’ নিয়ে কিউবানদের সঙ্গে যৌথ গবেষণার সুবাদে দেশটায় আমার যাওয়া হয়েছে। ওখানে গিয়েই গল্পটা শোনা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় কিউবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভটা ছিল খুবই নাজুক। সম্ভবত পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ সময় ফিডেল ক্যাস্ত্রো তার সভাসদদের নিয়ে বসেছিলেন পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণে। চ্যালেঞ্জটা ছিল বিশাল, অথচ হাতে রশদ খুবই কম। সভাসদদের মধ্যে নানা মুনীর ছিল নানান মত। সবার মতামত নিয়ে ক্যাস্ত্রো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার নিজের মতো করে। ওই পাঁচ বিলিয়নের প্রায় পুরোটাই খরচ করা হয়েছিল স্বাস্থ্য আর পর্যটন খাতে। ক্যাস্ত্রোর যুক্তি ছিল সোজা সাপ্টা। কিউবার বিপ্লবী জনগণ আধপেট খেয়ে থাকতে আপত্তি করবে না; কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা যদি নিশ্চিত না করা যায় তবে তারা বিগড়ে যেতেই পারে। আর পর্যটনে বিনিয়োগ দীর্ঘ মেয়াদে সুফল জোগাবে। বলাই বাহুল্য ক্যাস্ত্রো তার জায়গায় আরও একবার শতভাগ সাফল্যের নমুনা দেখিয়েছিলেন।
ধান ভাঙতে হঠাৎ শীবের গিত গাওয়ার অবশ্য আমার একটা ভালো কারণ আছে। পত্রিকান্তরে খবর ছাপা হয়েছে সামনে দেশে ওষুধের দাম আরেকদফা বাড়তে যাচ্ছে। দেশে বর্তমানে প্রায় দেড় হাজারের বেশি জীবন রক্ষাকারী ওষুধের ২৭ হাজারের বেশি ব্র্যান্ড উৎপাদিত এবং বাজারজাত হচ্ছে। এর মধ্যে ১১৭টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি এদেশে সরকারের এখতিয়ারে, আর বাদবাকিগুলোর দাম উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর হাতে। আর দু-দশটি পণ্যের মতো সিন্ডিকেট করে একদল দুষ্ট ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য নিয়ে এদেশের জনগণকে রোলার কোস্টারে চাপতে অনায়াসেই সকাল-বিকাল বাধ্য করতে পারলেও ওষুধের বাজারটা ঠিক তেমনটা নয়। এখানে দুষ্ট ব্যবসায়ীরা ওষুধের দামকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে পারেন ঠিকই; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই শেষ কথাটা বলেন সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্তারাই।
প্রায় শতভাগ উৎপাদন, ৮০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি এবং বহুলাংশে ফিনিশড প্রোডাক্ট রপ্তানি নির্ভর আমাদের ওষুধ শিল্প শেষমেশ তাদের পণ্যের অনুমোদন, উৎপাদন এবং রপ্তানির জন্য ওই একটি জায়গায় কিছুটা হলেও বাধা পড়েই থাকেন। আর তাই ওষুধের দাম বাড়ানোর বিষয়টা এদেশে ঠিক ‘উঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’ টাইপের না। নানা মতবিনিময় এবং বিচার বিশ্লেষণ শেষে অতঃপর এদেশে ওষুধের মূল্য নির্ধারিত হয় বিধায় এ বিষয়ে খবরাখবরও মিডিয়ায় আগাম চলে আসে, যার ব্যতিক্রম এ যাত্রায়ও ঘটেনি।
অতএব, আমরা ধরে নিতেই পারি যে এতসব কিছুর পর ওষুধের বাজার মূল্য যখন আবারও বাড়তে চলেছে তার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ যথেষ্টই থাকছে। দেশের ওষুধ শিল্পের কর্তাব্যক্তিরা সম্প্রীতি প্রধানমন্ত্রীর পুনঃনিযুক্ত বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা মহোদয়কে অভিনন্দন জানানোর ফাঁকে ওষুধের মূল্য বৃদ্ধিতে তাদের আবদারের কথা জানিয়ে এসেছেন। এর পেছনে তারা যে সব যুক্তি উপস্থাপন করেছেন, তা হালে আমাদের সবারই জানা। আর্ন্তজাতিক বাজারে ওষুধের কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি আর দেশে ডলারের সংকটই মুলত তাদের আবদারের ভিত্তি। অবশ্য ভোক্তাদের পক্ষীয় বোদ্ধারা এর বিপক্ষে বেশ কয়েকটি যুক্তিও উপস্থাপন করেছেন, যেগুলোও আমাদের অজানা নয়। কাঁচামালের দাম বাড়লে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়তে আমরা এদেশে হরহামেশাই দেখি, তবে যা দেখি না তা হলো কাঁচামালের দাম পড়ে গেলে পণ্যের দাম পড়তে।
আলোচনায় এসেছে প্যারাসিটামলের বিষয়টি। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে প্যারাসিটামলের কাঁচামালের মূল্য কমে আসলেও তার কোনো প্রভাব দেশের বাজার কোনো ব্যান্ডের প্যারাসিটামলের ওপরই পড়েনি। অথচ কিছু দিন আগে এই প্যারাসিটামলের দাম প্রায় পঞ্চাশ থেকে শতভাগ বাড়ানো হয়েছিল। একই রকম কথা এসেছে এমোক্সিসিলিন, মেট্রোনিডাজল, ডায়াজিপাম, অ্যাসপিরিন, উচ্চ রক্তচাপ, গ্যাস্ট্রিক, ডায়াবেটিসের আর অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় একগাদা ওষুধের বেলাতেও, যেগুলোর দাম সম্প্রতি ১০-৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।
বাস্তবতা হচ্ছে আবেগ সব সময় যুক্তি দিয়ে চলে না, হৃদয় সব সময় মগজকে শাসন করতে পারে না। অসুস্থ মানুষ চায় সুস্থতা, চায় বাঁচতে। মানুষ না খেয়ে থাকতে পারে, হেসে খেলে খাবারের তালিকা থেকে ছেটে দিতে পারে পেঁয়াজ, মরিচ, আলু ইত্যাদি ইত্যাদি; কিন্তু রোগাক্রান্ত স্বজনকে যখন ওষুধের দামের কারণে বিনা চিকিৎসায় রাখতে হয়, তবে তা আপোষে মেনে নিবেন এমন মানুষ প্রায় ১৭ কোটির এই দেশে একজনও আছেন কি না, সন্দেহ। সমস্যা হচ্ছে নব্বইয়ের দশকে ফিডেল ক্যাস্ত্রোর মতো একজন বিপ্লবী নেতা, যা বুঝেছিলেন আজকে স্মার্ট বাংলাদেশ বির্নিমাণে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন যেসব জনবান্ধব ব্যবসায়ী, তা কেন যেন তারা ঠিক অনেক সময় তা বুঝে উঠতে পারছেন না, অথবা চাচ্ছেন না।
লেখক: অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে