Views Bangladesh Logo

নতুন সম্পূরক করারোপ

টেলিযোগাযোগ খাতে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা

ফের খরচ বাড়ানো হয়েছে মোবাইল ফোনসেবা এবং ইন্টারনেট ব্যবহারে। নতুন করে কর আরোপ অস্থিরতা সৃষ্টি করবে টেলিযোগাযোগ খাতে। নতুন এই কর আরোপের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রান্তিক মানুষ ও মোবাইল এবং ইন্টারনেটভিত্তিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। এর মধ্যে আরেক দফা খরচ বৃদ্ধি এ খাতে বিপর্যয় ডেকে আনবে। মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫-এর অনুচ্ছেদ ৩(গ)-তে উল্লিখিত সেবা কোড এস ০১২ দশমিক ১০ ও এস ০১২ দশমিক ১৪-এর মূসকের (ভ্যাট) হার বৃদ্ধি করে যথাক্রমে টেলিফোন সেবায় ২৩ শতাংশ এবং ইন্টারনেট সেবায় ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। মোবাইল কলরেট ও ইন্টারনেট প্যাকেজের দাম কমানোর দীর্ঘদিনের দাবি থাকলেও, সরকার এখন মুঠোফোন গ্রাহকদের সেবার ওপর অতিরিক্ত সম্পূরক কর আরোপ করল।

গত ৯ জানুয়ারি দুটি নতুন অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে- মূসক ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫ এবং দ্য এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫। এসব অধ্যাদেশ প্রকাশের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগ সংশ্লিষ্ট নির্দেশনা জারি করেছে, যার ফলে সংশোধনীগুলো সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকর হয়েছে। এর মানে হলো, বাড়তি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক এখন থেকে প্রযোজ্য।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএফএম) শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে কিছু পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি সেগুলোর যৌক্তিকীকরণও করা হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে, গত ১ জানুয়ারি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এনবিআরের ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব পাস করা হয়।

জানা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মোবাইল ফোনসেবায় সম্পূরক শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছিল। এখন তা আরও বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আগে ১০০ টাকার মোবাইল রিচার্জে সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ও সারচার্জসহ মোট ৫৪ দশমিক ৬ টাকা কর কাটা হতো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্পূরক শুল্ক ৩ শতাংশ বাড়ানোর কারণে, গ্রাহককে ১০০ টাকায় কর বাবদ ৫৬ দশমিক ৩ টাকা দিতে হবে। ফলে গ্রাহক ১০০ টাকায় শুধু ৪৩ টাকা ৭০ পয়সা ব্যবহার করতে পারবেন।

প্রথমবারের মতো সম্পূরক শুল্ক বসেছে ইন্টারনেট সেবা বা আইএসপির ওপর। এ ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক দিতে হবে। এ ছাড়া স্থানীয় ব্যবসায়ে ভ্যাটের হার ৫ থেকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে ৫০০ টাকা বিলের ওপর মোট করভার সাড়ে ৭৭ টাকা দাঁড়িয়েছে, আগে যা ছিল ২৫ টাকা। এ ছাড়া ১ হাজার টাকার প্যাকেজের বর্তমান দাম পড়বে ১ হাজার ১৫৫ টাকা। ইন্টারনেট সেবাদাতারা অনেক ক্ষেত্রে আগের ভ্যাট বাবদ টাকা আদায় করতেন না; কিন্তু এখন যেহেতু ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপিত হয়েছে, সেহেতু দেখা যাবে আইএসপি প্রোভাইডাররা এখন ভ্যাটসহ সম্পূরক শুল্ক আদায় করছে। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে খরচ বাড়ছে গ্রাহকেরই।

এমটব মহাসচিব লে. কর্নেল মোহাম্মদ জুলফিকার (অব.) বলেছেন, ‘মোবাইল ব্যবহারের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ফলে মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবার মূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে, যা প্রান্তিক ও স্বল্প আয়ের মানুষ, বিশেষত শিক্ষার্থীদের মোবাইল ব্যবহারে বাধা সৃষ্টি করবে। ফলে অপারেটরদের আয় হ্রাস পাবে, যা এই খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ের ওপরও নিম্নমুখী প্রভাব ফেলতে পারে। আমরা চাই, অব্যাবহিতভাবে কর না বাড়িয়ে মোবাইলসেবাকে জরুরি ও মৌলিক খাত হিসেবে বিবেচনা করে করের হার যৌক্তিক পর্যায়ে এনে সেবার মানোন্নয়নে সহায়তা করা হোক। আমরা আশা করি, সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে কর কাঠামো পুনর্বিবেচনা করবে।’

বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামের (বিআইজিএফ) চেয়ারপারসন এবং আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (আইআইজিএবি) সভাপতি আমিনুল হাকিম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, প্রান্তিক পর্যায়ে আইএসপি থেকে গ্রাহক ব্যান্ডউইথ পায়। এক্ষেত্রে আইটিসি সরকারকে ২ শতাংশ রেভিনিউ শেয়ার, ৫ শতাংশ ভ্যাট, ১ শতাংশ এসওএফ দেয়, এনিটিটিএন ৫ শতাংশ ভ্যাট, ৩ শতাংশ রেভিনিউ শেয়ার ১ শতাংশ এসওএফ দেয়, আই আই জি ১০ শতাংশ রেভিনিউ শেয়ার, ৫ শতাংশ ভ্যাট, ১ শতাংশ এসওএফ দেয়। এর ওপর আবার এখন আইএসপি-এর ওপর ১০ শতাংশ সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি, ৫ শতাংশ ভ্যাট, ১ শতাংশ এসওএফ আরোপ করা হয়েছে। অর্থাৎ সরকার একই পণ্যের ওপর একাধিকবার কর পাচ্ছে। বাসায় ১ হাজার টাকার যে লাইনটা যায়। সেখান থেকে সরকার প্রথমেই ১৬০-১৭০ টাকার বেশি নিয়ে যায়। আবার আইএসপি থেকে ১ হাজার টাকার ব্যান্ডউইথ প্রাইসে ২০ শতাংশ ভ্যাট পায়। এখন ইন্টারনেটের ওপর সাপলিমেন্টারি ডিউটি আরোপ করে কি আসলে সরকার এটাকে বিলাসী পণ্য হিসেবে বোঝাতে চায়? এটা কি তামাকের মতো? স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর?  ইন্টারনেট এখন বিলাসী পণ্য না। এটা মৌলিক চাহিদা। এটা বিবেচনা না করে হঠকারি সরকারি সিদ্ধান্ত দেশকে তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি থেকে পিছিয়ে দেবে। 

তিনি আরও বলেন, এখন দাম বাড়িয়ে তো আসলে সরকার ডিজিটাল বৈষম্য বাড়াল। কারন গ্রাম আর শহরের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এক না। সার্বিকভাবে প্রভাবটা হবে অনেক বেশি। সব কিছুর দাম বাড়লে মানুষ কি আসলে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে ঠিকমতো? বেকারত্ব বাড়বে। ফ্রিল্যান্সার রা অসুবিধায় পড়বে। গত সরকার কে চলে যেতে হয়েছিল জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার কারণে। এরকম পদক্ষেপ নিয়ে এই সরকারও কি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়?

ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি ইমদাদুল হক ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, এ ধরনের পদক্ষেপ আসলে গ্রাহকদের ওপরে সরাসরি প্রভাব ফেলবে। তাদের জন্য ইন্টারনেটের খরচ বাড়বে। ব্যবসায়ীদের খরচ ও বাড়বে। ছোট ছোট উদ্যোক্তারা যেমন নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে, ঠিক তেমনই গ্রাহকদের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝাও বাড়বে। এটা আসলে ইন্টারনেট ব্যবস্থার সম্পূর্ণ ইকোসিস্টেমের ওপরে একটা বড় আঘাত। গ্রাহক কমে আসবে। সেবার মান কমে আসবে এ ধরনের পদক্ষেপ এর কারণে।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির এ বিষয়ে ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, গত ১ বছরে গ্রাহক কমেছে। ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারী বাড়লেও সে হার কম। এর পেছনে বড় কারণ মূল্যস্ফীতি। মানুষ খরচ কমাতে ইন্টারনেট ও মুঠোফোন ব্যবহার কমিয়ে এনেছে। অন্য আরও কারণ থাকতে পারে। তবে এটা মূল কারণ। ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ালে সেটার একটা বড় প্রভাব গ্রাহক এবং ব্যবসায়ীদের ওপর পড়বেই। সরকার হয়তো নানাদিক বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারাই ভালো বলতে পারবে, হুট করে তারা কেন এ সিদ্ধান্ত নিল। তবে এক্ষেত্রে আসলে গ্রাহকের ওপরেই বেশি চাপ পড়বে।

তিনি বলেন, কারণ শুল্ক ও করের এ ভার তাদেরই বেশি বহন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহক কমে আসবে। আর গ্রাহক কমলে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ বাড়বে। কেন এ ব্যবসায় লাভ নির্ভর করে বছর বছর যদি গ্রাহক বৃদ্ধি পায় তার ওপর। ব্যবসায়ীদের জন্য এ শুল্ক আরোপ কোনোভাবেই সুসংবাদ না। এ শুল্ক আদায় করে সরকার কোথায় কোন খাতে খরচ করবে, সরকারই ভালো জানে। যদি মৌলিক চাহিদাগুলো যেমন শিক্ষা বস্ত্র, বাসস্থান এসব খাতে সরকার খরচ কমাতে পারে, তাহলে ভালো হবে। যদিও জানুয়ারির তুলনায় নভেম্বরে ইন্টারনেট গ্রাহকসংখ্যা বেশি ছিল; কিন্তু গত ৫ মাস ধরে কমছে। অর্থাৎ কমার একটা ট্রেন্ড আছে। সরকারের এ দিকটা মাথায় রাখা উচিত ছিল।


মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ