কনডেম সেলের যন্ত্রণা সহস্রাধিক ডেথ রেফারেন্স মামলা
কনডেম সেল যেন কারাগারের ভেতর আরেক কারাগার। এখানে রাখা হয় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে। এই সেলের বাসিন্দারা সবসময়ই থাকেন মৃত্যু আতঙ্কে। আর সেইসঙ্গে অপেক্ষায় থাকেন ডেথ রেফারেন্স মামলার বিচার শেষের। অথচ বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে সহস্রাধিক ডেথ রেফারেন্স মামলা বিচারাধীন। কবে নাগাদ শেষ হবে এসব মামলার বিচার তাও অজানা।
বিচারিক আদালতে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হলেই তা কার্যকর করা যায় না। আইন অনুযায়ী বিচারিক আদালতের মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাঠাতে হয় হাইকোর্টে। বিচারিক আদালতের এই নথি যখন হাইকোর্টে আসে তখন তাকে বলা হয় ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) মামলা। সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে ডেথ রেফারেন্স মামলার স্তূপ জমে গেছে হাইকোর্টে। সেখানে চারটি বিশেষায়িত ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চে ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বিচারের অপেক্ষায় ছিল ১০২১টি ডেথ রেফারেন্স মামলা। এর মধ্যে ৭ শতাধিক মামলা আছে পেপারবুক প্রস্তুতের অপেক্ষায়। আর বিচারের অপেক্ষায় আছে প্রায় ৩০০ মামলা। এসব মামলার প্রায় আড়াই হাজার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বর্তমানে বন্দি আছেন দেশের বিভিন্ন কারাগারের কনডেম সেলে।
সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার আসাফ-উদ-দৌলা ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘হাইকোর্টে ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ১০২১টি ডেথ রেফারেন্স মামলা বিচারাধীন। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ডেথ রেফারেন্সের বিপরীতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের নিয়মিত জেল আপিলও রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, বরগুনার রিফাত হত্যা, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা, বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা, হলি আর্টিজানে হামলার হত্যা মামলাসহ বেশকিছু চাঞ্চল্যকর মামলার ডেথ রেফারেন্স রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটি ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্ট বেঞ্চ বছরে সর্বোচ্চ ৪৫ থেকে ৫০টি মামলা নিষ্পত্তি করে থাকেন। তাই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিভিন্ন অবকাশের সময় বাড়তি বেঞ্চ দিয়ে ডেথ রেফারেন্স শুনানি করা হয়। এসব মামলায় প্রায় আড়াই হাজার ফাঁসির আসামি কনডেম সেলে আছেন বিচার নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। বর্তমানে যেসংখ্যক ডেথ রেফারেন্স মামলা পেনডিং আছে তা চলতি বছরের মধ্যেই অনেকাংশে কমে আসবে বলে আশা করছি।’
হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স সেকশন কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম ভিউজ বাংলাদেশকে জানান, বর্তমানে ২০১৮ সালের ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি শুরু হয়েছে। ২০১৬ ও ২০১৭ সালের বেশ কয়েকটি মামলার শুনানি বিচারাধীন আছে। বর্তমানে ২০১৮ সালের ১২৬ মামলার পর ২০১৯ সালের ১১২টি ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি হবে। এছাড়া, ২০১৯ সালের ১৩০, ২০২০ সালের ১০৯, ২০২১ সালের ১২৩, ২০২২ সালের ১১৬, ২০২৩ সালের ১৩২ ও ২০২৪ সালের ১৬১টি ডেথ রেফারেন্স বিচারের অপেক্ষায় আছে। বর্তমানে চারটি বিশেষায়িত ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চে এসব মামলা শুনানির অপেক্ষায় আছে। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলা, ফেনীর নুসরাত হত্যা মামলা ও গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা মামলার পেপারবুক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিজি প্রেস থেকে তৈরি করা হয়েছে। বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে হলি আর্টিজান মামলার শুনানি হচ্ছে।
এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৩১(২) ধারায় বলা হয়েছে- ‘দায়রা জজ অথবা অতিরিক্ত দায়রা জজ আইনে অনুমোদিত যে কোনো দণ্ড দিতে পারেন; তবে এই রূপ কোনো জজ মৃত্যুদণ্ড প্রদান করলে তা হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন সাপেক্ষে কার্যকর হতে হবে।’ আইনের এই বিধানটিই ডেথ রেফারেন্স। এই ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি হতে যত দেরি হবে কারাগারে থাকা আসামির কষ্ট ততই বাড়বে। কারণ এসব মামলার আসামিরা কারাগারে সাধারণ সেলে থাকেন না, থাকেন কনডেম সেলে। যা অত্যন্ত কষ্টদায়ক স্থান।’
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘একজন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পর তাকে আলাদা সেলে রাখা হয়। যেটি কনডেম সেল হিসেবে পরিচিত। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হাইকোর্ট বিভাগে এসে খালাস পেলেও সেই রায় পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। আবার মৃত্যুদণ্ড হাইকোর্টে বহাল থাকলেও সেই রায় পেতেও লেগে যায় ৫ থেকে ৬ বছর। সেসময় পর্যন্ত এসব আসামিকে কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন দোষী ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রাপ্তিতে বিলম্ব হয়, তেমনি দোষ প্রমাণ না হলে একজন নির্দোষ ব্যক্তিকেও দীর্ঘ সময় কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে। যা দ্রুত ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অন্তরায়।’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও ফৌজদারি মামলা বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘ডেথ রেফারেন্স মামলার রায় পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অধিকাংশেরই সেই দণ্ড হাইকোর্টে এসে বহাল থাকে না। অনেকে আবার খালাস পান আপিল বিভাগ থেকেও। তাই দায়রা আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি হাইকোর্ট বা আপিল বিভাগে খালাস পেলেও তার জীবনের বড় একটা সময় পার হয় কনডেম সেলে। এর অন্যতম কারণ ডেথ রেফারেন্স মামলার বিশাল জট। এমন স্পর্শকাতর মামলার জট কমাতে পেপারবুক প্রস্তুত দ্রুত করতে হবে ও বেঞ্চ সংখ্যা বাড়াতে হবে।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে বিচার বিভাগের অবস্থা খুবই নাজুক ছিল। সুপ্রিম কোর্টের প্রতিটি সেকশনে কাজ চলেছে ধীরগতিতে। এর বাইরে ছিল না ডেথ রেফারেন্স সেকশনও। এ কারণে বর্তমানে হাজারেরও বেশি ডেথ রেফারেন্স মামলা পেনডিং আছে। আমরা দ্রুত এসব মামলার বিচার শেষ করার উদ্যোগ নিচ্ছি। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমানোর চেষ্টা করব।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে