Views Bangladesh Logo

বিসিবিতে দ্বন্দ্ব: ক্রিকেটের এ কোন রূপ!

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

. ভূপেন হাজারিকা বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গনের নানা ঘটনাচক্রে হয়তো লজ্জায় মুখ লুকাতেন! প্রয়াত এ শিল্পীর লেখা ‘এই পৃথিবী এক ক্রীড়াঙ্গন’ গানের ‘ক্রীড়া হলো শান্তির প্রাঙ্গণ’ কথাটা যে ১ লাখ ৪৯ হাজার ২১০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ ভূখণ্ডে একদমই খাটছে না। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) স্বীকৃতি অর্ধশতাধিক ক্রীড়া ফেডারেশনের কোথাও বিখ্যাত ভারতীয় শিল্পীর গানের ওই কথাটা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অন্যান্য ক্রীড়া ফেডারেশনে তা স্পষ্ট হয়েছে আগেই। এবার সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সাম্প্রতিক ঘটনাচক্র।

ক্রিকেটে সফেদ-হৃদয়ের মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম। সাবেক ক্রিকেটার খেলাটিতে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিলেন, ছিলেন সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। রাষ্ট্র ক্ষমতার পালাবদলের হাওয়া দেশের অন্যান্য সেক্টরের মতো লেগেছিল ক্রিকেটেও। সে হাওয়ায় আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি ও জালাল ইউনুসকে বিসিবি পরিচালক পদ থেকে সরিয়ে দেয়। এনএসসি মনোনীত পরিচালক হিসেবে প্রেসিডেন্ট হন ফারুক আহমেদ, পরিচালক হন নাজমুল আবেদীন ফাহিমও। পরিবর্তনের পর অনেকেই নড়েচড়ে বসেছিলেন- নাজমুল হাসান পাপনের উদ্ভট কর্মকাণ্ড থেকে এই বুঝি বেরিয়ে এলো দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী খেলাটির পরিচালনা সংস্থা।

মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের আশঙ্কাও ছিল। সে আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিতে সময় লাগেনি। ২১ আগস্ট বিসিবি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে প্রধান কোচের পদ থেকে চণ্ডিকা হাথুরুসিংহেকে ছেঁটে ফেলেন ফারুক আহমেদ। ছাঁটাইয়ের যে প্রক্রিয়া ছিল, তা মোটেও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে ছিল না। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ব্যক্তি জেদ প্রতিফলিত হয়েছে- প্রকাশ্যে বলেছেন ক্রিকেট বিশ্লেষকরা। ফারুক আহমেদের মতো বড় কোনো ঘটনায় না জড়ালেও বোর্ড পরিচালক হওয়ার পর থেকেই নাজমুল আবেদীন ফাহিমকে ঘিরে নানা কানাঘুষা ছিল।

নতুনত্বের ঘোষণা দিয়ে শুরু হওয়া বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) চলাকালে শিরোনাম হলেন এ পরিচালকও। বোর্ড প্রেসিডেন্ট ফারুক আহমেদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে আলোচনায় নাজমুল আবেদীন ফাহিম হচ্ছেন সমালোচিত। বিসিবির প্রভাবশালী দুই কর্মকর্তার বিবাদের মাঝে ‘পক্ষ এবং বিপক্ষের প্রতিপক্ষ’ হিসেবে আবির্ভূত হন আরেক সাবেক ক্রিকেটার খালেদ মাহমুদ সুজন। দুজনকে একহাত নেন জাতীয় দলের সাবেক এ অধিনায়ক। নাজমুল আবেদীন ফাহিমের মাঝে না কি ‘লোভ-লালসা’ দেখতে পাচ্ছেন সুজন।

খেলাধুলায় ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছাপিয়ে ব্যক্তি স্বার্থ যখন ওপরে উঠে আসে; বিবাদ সেখানে অবধারিতভাবেই হাজির হয়। সে অবধারিত দৃশ্যই মঞ্চস্থ হচ্ছে দেশের ক্রিকেটে। সাম্প্রতিক সময়ের নানা ঘটনা বোর্ড সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, ক্রিকেটার এবং খেলাটির সঙ্গে জড়িত সবাইকে যে হতাশ করেছে- এটা বলার অবকাশ রাখে না। ক্রিকেটের বৃহত্তর স্বার্থে এ বিবাদ মিটিয়ে ফেলা জরুরি। অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে মতবিরোধ থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে নেয়া উচিত। অন্যথায় কর্মকর্তাদের মাঝে বাড়বে তিক্ততা, প্রকাশ্যে আসবে দ্বন্দ্ব। আর যাই হোক, এ বিষয়গুলো দেশের ক্রিকেটের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।

দর্শকদের কাছে আবেদন, আর্থিক অবস্থা, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বিচরণ- এমন অনেক মানদণ্ডে অন্যান্য ক্রীড়া ফেডারেশনের চেয়ে এগিয়ে আছে বিসিবি; কিন্তু দেশের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থার অভ্যন্তরের অবস্থা ‘হাস্যরসের খোরাক’ জোগাচ্ছে! বিশ্বব্যাপী খেলাধুলা ভ্রাতৃত্বের বন্ধন হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে এ কথা পুস্তকে খুঁজে পাবেন। বাস্তবতা যে তার উল্টো- তা নিয়মিতই দেখা যাচ্ছে। দেখা গেল ক্রিকেটেও। পিতা-মাতার বিবাদ যেমন সন্তানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, বোর্ড কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব দেশের ক্রিকেটের ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারে।

ফারুক আহমেদ এবং নাজমুল আবেদীন ফাহিম দৃশ্যপটে আসার আগে আলোচনায় ছিলেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (প্রেস সচিব হিসেবে পরিচিত) মো. মাহফুজুল আলম ভূঁইয়া। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, বিসিবি প্রেসিডেন্ট ফারুক আহমেদকে উদ্দেশ করে মাহফুজুল আলম ভূঁইয়া বলেছেন, ‘আপনি কীভাবে বিসিবি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, তা আমাদের জানা আছে।’ বিপিএলকে ঘিরে নানা অব্যবস্থাপনার অভ্যন্তরীণ বিষয় সংশ্লিষ্টদের মাঝে প্রচণ্ড ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। সে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল কথাগুলো।

বিপিএল উদ্বোধনীতে রীতিমতো লেজে-গোবরে অবস্থা ছিল। ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক লিগে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নিহত-আহতদের ঘিরে যে পরিকল্পনা ছিল, তা বাস্তবায়নের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। টিকিট নিয়ে বিশৃঙ্খলা ছিল। দর্শকদের বিনামূল্য পানি সরবরাহের জন্য ‘মুগ্ধ কর্নার’ প্রস্তুত ছিল না। অপ্রস্তুত ছিল ‘আবু সাঈদ কর্নার’। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে ১০০ জনের হাতে সঠিক সময়ে সৌজন্য টিকিট পৌঁছায়নি। এ নিয়ে ক্ষোভ ছিল। সে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় প্রেসিডেন্ট বক্সে ফারুক আহমেদ ও মাহফুজুল আলমের মধ্যকার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের ঘটনা। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে যে অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে; সেখানে এমন বিশৃঙ্খলা কেন হবে?

সরকারের তরফ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, ‘এবারের বিপিএল হবে বিগত আসরগুলো থেকে ভিন্ন’। এই হচ্ছে তার নমুনা! এবারের বিপিএল ঘিরে ‘তারুণ্যের উৎসব-২০২৫’ ঘোষণা করেছে বর্তমান সরকার। শোনা যাচ্ছে, উৎসব বাস্তবায়নের যে ফান্ড রয়েছে; সেখান থেকে বিপুল অর্থও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বিপিএল আয়োজকদের। বিপরীতে ‘তারুণ্যের উৎসব-২০২৫’ বাস্তবায়নে বিসিবির ভূমিকা কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে।

‘তারুণ্যের উৎসব-২০২৫’ ব্র্যান্ডিয়ে বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশন যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছে, তা থেকে শিক্ষা নিতে পারে বিসিবি! বিজয় দিবস কাবাডি প্রতিযোগিতা দিয়ে ব্র্যান্ডি শুরু। জাতীয় খেলায় সংশ্লিষ্টরা রীতিমতো মহাযজ্ঞ নিয়ে নামছে এ উৎসব বাস্তবায়নে। ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ এবং চূড়ান্ত পর্বের প্রতিযোগিতায় যুক্ত করা হচ্ছে কয়েক লাখ খেলোয়াড়কে। বালক এবং বালিকা- দুই বিভাগেই আয়োজনের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এ আয়োজন হতে তরুণ খেলোয়াড় বাছাই করার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পথচলা মসৃণ করতে চায় বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশন। কাবাডির এ আয়োজন তরুণদের মাঝে যে জাগরণ সৃষ্টি করবে, তার কয়েক গুণ বেশি সৃষ্টি করতে পারত ক্রিকেট। উল্টো বিবাদে জড়িয়ে নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হচ্ছে দেশের প্রভাবশালী খেলাটি।

মাহবুব সরকার: ক্রীড়া সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ