স্থানীয় নির্বাচন বনাম জাতীয় নির্বাচন
ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত না নিলে সংঘাত বাড়বে
কথা ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করবে; কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের মতানৈক্য বাড়ছে। এমনকি রাষ্ট্র সংস্কারের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়েও মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এরই মধ্যে সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত বেশ কয়েকটি কমিশন তাদের প্রস্তাব পেশ করলেও রাজনৈতিক মহলে তা নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। বরং কোনো কোনো রাজনৈতিক দল জুলাই-আগস্টের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবি তুলেছে। এ নিয়ে সরকারের মধ্যেও এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বেশ জোরের সঙ্গেই বলা হয়েছিল যে, প্রয়োজনীয় সংস্কারের পরেই দেশে নির্বাচন হবে; কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারকেও নির্বাচনের ব্যাপারে নমনীয় মনে হচ্ছে।
সম্প্রতি ‘জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের এমন বক্তব্যের পর জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে কি না, এ আলোচনা সামনে এসেছে। হিসাব মতে, অন্তর্বর্তী সরকার স্থানীয় নির্বাচন করতে চাইলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই করতে হবে। সংসদ নির্বাচন করার পর তারা আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার সুযোগ পাবে না। যদিও জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে খুব একটা সমর্থন মেলেনি। তাদের ভাষ্য, সংসদ নির্বাচনের আগে যে কোনো নির্বাচন দেশের রাজনীতিতে সংকট তৈরি করবে। জন আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দেয়ার কথাও বলছেন তারা। এ পরিস্থিতিতে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন করা আদৌ সম্ভব হবে মনে হয় না। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য ছাড়া স্থানীয় নির্বাচনের আয়োজন করলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিপদে পড়তে পারে।
স্থানীয় নির্বাচনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কড়া ভাষায় বলেছেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’ শুধু বিএনপি নয়, বিএনপির সমমনাসহ প্রায় সব দলই বলছে, স্থানীয় নয়, জাতীয় নির্বাচন চায় তারা। বিএনপি নেতৃবৃন্দ মনে করেন, অতিপ্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে জাতীয় নির্বাচন করাও একটা বড় সংস্কার। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে যখন প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্যের, সে সময়ে নানা ইস্যুতে দলগুলোর বিপরীতমুখী অবস্থান জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে বিএনপি এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আর সময় দিতে চাইছে না। এর আগে দলটি প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল; কিন্তু সম্প্রতি তারা এই অবস্থান থেকে সরে এসে আগামী জুলাই-আগস্টের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের জোর দাবি জানাচ্ছে।
গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক কমিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছে। জামায়াতে ইসলামীও প্রচ্ছন্নভাবে আগে স্থানীয় নির্বাচনকে সমর্থন করছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের নজির না থাকলেও নবগঠিত ইসি বলছে, প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা; কিন্তু বিএনপি আপসহীন। দলটির মধ্যে একটি অদৃশ্য ভয় কাজ করছে। ক্ষমতায় যেতে না পারার ভয়। তারা প্রায় ১৮ বছর ধরে দলটি ক্ষমতার বাইরে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে এখন তারাই সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। এখন নির্বাচন হলে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় যাবে, এ ব্যাপারে তারা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। তাদের মধ্যে শঙ্কা: জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন দিয়ে কালক্ষেপণ করা হলে দেশে ভিন্ন কিছু ঘটে যেতে পারে। ছলে-বলে কৌশলে আবারও তাদের ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হতে পারে। সে জন্য তারা জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যদিও মুখে তারা এসব কথা স্বীকার করছে না।
বিএনপির নেতারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনা করে সম্প্রতি বলেছেন, সরকার নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির পরিবর্তে সংস্কারের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, এতে জনগণের দুর্ভোগ আরও বাড়ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্থানীয় নির্বাচন করার ম্যান্ডেট নেই। আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। নির্বাচিত সরকারই স্থানীয় নির্বাচনের আয়োজন করবে। স্থানীয় নির্বাচনের আয়োজন হবে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার অভিপ্রায় ও মূল বিষয় থেকে দৃষ্টি সরানোর চেষ্টা।
শুধু তাই নয়, বিএনপি মনে করছে, এ মুহূর্তে দেশে স্থানীয় সরকারের কাঠামো নেই। জনপ্রশাসন শক্তিশালী নেই। তৃণমূলের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যোগাযোগ নেই। সংসদ নির্বাচন হলে তখন একটি কাঠামো তৈরি হবে। নির্বাচিত সরকার স্থানীয় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেবে। বিএনপির এই সিদ্ধান্ত অবশ্য অন্য দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন মনে করে, কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ছাড়া তড়িঘড়ি নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে আত্মঘাতী। এর মধ্য দিয়ে আগের ফ্যাসিবাদী শাসন ফেরার পথ সুগম করবে। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনই স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার পক্ষে রয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ আরো কয়েকটি দল।
তারা বিবিএসের সাম্প্রতিক জরিপের ফলাফলকে যৌক্তিক বলে মনে করছে। বিবিএসের জরিপ বলছে, দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন চান। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের সব স্তরের নির্বাচন করার পক্ষে মত দিয়েছেন ৬৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ মানুষ। বিপরীতে ২৯ শতাংশ মানুষ জাতীয় নির্বাচনের পরেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন চান। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় করার পক্ষে মত দিয়েছেন প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ। আর দলীয় প্রতীকে এই নির্বাচন করার কথা বলেছেন প্রায় ২৮ শতাংশ।
এ কথা ঠিক যে স্থানীয় সরকারের সেবাবঞ্চিত মানুষজনের কাছে স্থানীয় নির্বাচনের গুরুত্ব অসীম। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বিগত সরকারের আমলে নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী সিটি ও পৌরসভার মেয়র-কাউন্সিলরদের বরখাস্ত করা হয়। ভেঙে দেয়া হয় জেলা ও উপজেলা পরিষদ। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যরা এখনো বহাল থাকলেও তাদের বেশিরভাগই পলাতক বা কাজে অনুপস্থিত। এ অবস্থায় সারা দেশে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে নাগরিক সেবা নেই বললেই চলে। মানুষ জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, নাগরিকত্বের সনদ ও অন্যান্য নাগরিক সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কিছু কিছু ইউনিয়ন পরিষদেও প্রশাসক হিসেবে ইউএনও বা সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
অল্পসংখ্যক সরকারি কর্মকর্তা কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে রুটিন কার্যক্রম সচল রেখেছেন। তবে এতে কাউন্সিলর, সদস্য ও অন্যান্য জনপ্রতিনিধির শূন্যতা পূরণ হচ্ছে না। প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে নাগরিক সেবা কার্যক্রম। একজন চেয়ারম্যান নাগরিক সনদ, জন্ম নিবন্ধনসহ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ জনকে এই সেবা প্রদান করে থাকেন। একজন ইউএনও বা সরকারি কোনো কর্মকর্তার পক্ষে এই সেবা দেয়া সম্ভব না। ইউএনওদের কাছে সই নিতে উপজেলায় যেতে হয়। তা-ও আবার যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা সই দেন না। আগে সেক্রেটারির কাছে জমা দিতে হয়, তার সেক্রেটারি সম্মতি দিলে এক দিন বা দুই দিন পরে তিনি সই দেন। ফলে মানুষের ভোগান্তি যেমন বেড়ে যায়, তেমনি উপজেলায় যাওয়ার-আসার খরচও বাড়ে। এ অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণ প্রয়োজন বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ।
তারপরও জাতীয় নির্বাচন আগে হবে, না স্থানীয় নির্বাচন- বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। বস্তুত জাতীয় সংসদের চেয়েও স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনেক জটিল এবং সেখানে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ থাকে। নির্বাচন কমিশন এবং মাঠ প্রশাসনের প্রস্তুতিতে অনেক সময় লাগে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও প্রস্তুতি নিতে হয়। তাছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচন পুরোপুরি সংঘাতমুক্ত করা অত্যন্ত বড় একটা চ্যালেঞ্জ। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন করলে তার মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে নতুন করে সংঘাতের বীজ বপন করা হবে কি না- সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে