Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সংঘাত ও সহিংসতা

Md Shakhawat  Hossain

মো সাখাওয়াত হোসেন

বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩

রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তিত হয়, রাজনীতির মাধ্যমে নতুন নতুন ভাবনা-চিন্তার অবকাশ ঘটে থাকে। রাজনীতিকে বাদ দিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ অসম্ভব। অর্থাৎ রাজনীতি আমাদের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। সঙ্গত কারণেই রাজনীতি নিয়ে এ দেশের মানুষের আগ্রহও তুলনামূলকভাবে বেশি। রাজনীতি সচেতন মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে প্রতিনিয়ত।

মানুষ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সুবিধা হয় এবং সরকারও সুসংগঠিতভাবে সঠিক রাস্তায় চলতে পারে। তবে এ কথাও দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করতে হবে যে, রাজনীতির গতিপথকে কলুষিত করতে, রাজনীতির স্রোতধারাকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করতে একটি পক্ষ বরাবরই তটস্থ থাকে। যাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতায় আরোহণ করা, জনগণ তাদের কাছে তেমন গুরুত্ব পায় না। সে কারণেই এ পক্ষটি জনবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। মানুষকে অবমূল্যায়ন করে, অমর্যাদা করে কোন রাজনৈতিক দলই টিকে থাকতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। এ বিষয়গুলো প্রমাণিত এবং পৃথিবীর ইতিহাসে এর অনেক নজির রয়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জনগণই মুখ্য এবং মূল উপজীব্য। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জনগণের অসুবিধা করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ হিতে বিপরীত হয়ে থাকে।

তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সংঘাত, সহিংসতার ঘটনা একেবারে অমূলক নয়। বিভিন্ন সময়ে সংঘাত, সংঘর্ষের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে এ দেশের জনগণ। তবে বিগত এক দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকায় এ দেশের জনগণ নানাভাবে সুফল পেয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার পাতায় ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে দেখা গিয়েছে দেশের আপামর জনসাধারণ যে কোনো মূল্যে এ দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রত্যাশা করে। কেননা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ভূলুণ্ঠিত হলে নিরাপত্তা ঘাটতি দেখা যায়। মানুষের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়। একটি অনিরাপদ ও অস্থিতিশীল পরিবেশের কারণে জনগণের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের প্রভাব যে কেবলমাত্র দেশের অভ্যন্তরে পরিস্ফূটিত হয় বিষয়টি কিন্তু তা নয়। দেশের বাইরেও এর একটি ব্যাপক প্রভাব দেখা যায়, বিশেষ করে বিশ্ব মিডিয়াগুলোতে বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশিত হয়। দেশের ভাবমূর্তি ও পরিচ্ছন্ন ইমেজের সংকট তৈরি হয়। এককথায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বে একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।

দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। কেননা বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হলে ভুক্তভোগী হয়ে উঠে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এ ব্যাপারটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও হৃদয়বিদারক। কেবলমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। আবার এ বিষয়টি নির্বাচনকে ইস্যু করে সংঘটিত হয়ে থাকে এবং এর অসংখ্য নজির এ দেশে রয়েছে। কাজেই নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক কোনো বিরোধ কিংবা সংঘর্ষের সৃষ্টি হলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সর্বদা আতংক এবং ভয়ের মধ্যে থাকে। সুতরাং যে বা যাদের সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ফলশ্রুতিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে তারা কখনো এ সংঘাতের দায় এড়াতে পারে না।

বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অত্যাসন্ন। নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি দেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি আতঙ্ক ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছে। আতঙ্ক তৈরি হওয়ার একটি বড় কারণ হচ্ছে; অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কতিপয় রাজনৈতিক দল নির্বাচন আয়োজনে বাধাগ্রস্ত করার মানসিকতা থেকেই ধ্বংসাত্নক কর্মসূচির দিকে হাঁটছে। এ কথাটি এ কারণেই আলোচনায় এসেছে, সরকার বলছে সংবিধান মেনে নির্বাচন আয়োজন করা হবে। আবার ভিন্ন একটি প্ল্যাটফরমে বিএনপিসহ কয়েকটি সমমনা দল ঘোষণা দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। বর্তমানে যে বিধিবিধান ও শৃঙ্খলা রয়েছে সেখানে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন বিধান নেই। কাজেই সরকার কোনোভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দিকে হাঁটবে না। সরকার সংবিধান মেনেই নির্বাচন আয়োজনের সব আয়োজন সম্পন্নে কাজ করে যাচ্ছে।

২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে দেখা গেছে, ভোট আয়োজনে বাধাগ্রস্থ করতে ধ্বংসাত্মক সব ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। হরতাল, অবরোধের মতো জনবিরোধী কার্যক্রম দেখা গিয়েছে। আগুন সন্ত্রাসের কথা মানুষ এখনো ভুলে যায়নি। আগুন সন্ত্রাসে ক্ষতিগ্রস্তরা এখনো দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। আগুন সন্ত্রাসীদের হাত থেকে শিশু ও নারীরা রেহাই পায়নি। সরকারি বিভিন্ন অবকাঠামো ঐ জনবিরোধী আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যাচ্ছে, যারা নিয়ম মেনে নির্বাচন চায় না, তারা নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে ধ্বংসাত্নক কার্যক্রম গ্রহণ করবে। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ পক্ষটির সঙ্গে দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রের একটি গ্রুপ জড়িয়ে পড়েছে। কেউই জড়িয়েছে কেবলমাত্র বিরোধিতার জন্য আবার কেউ জড়াচ্ছে অনৈতিক বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে।

বাংলাদেশের সাধারণ জনতাও এ ব্যাপারে পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় সচেতন ও সজাগ। কেননা জনগণ প্রত্যাশা করে নির্বিঘ্নে ও নিশ্চিতে বসবাস করার অধিকারটুকু। সুতরাং যারা দেশবিরোধী ও জনগণবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত তাদের এ দেশের জনগণ কখনোই ম্যান্ডেট প্রদান করবে না। যারা জনগণের কথা ভাবে, জনগণ বিপদে আপদে যাদের পাশে পায়, জনগণ শুধু তাদেরই গুরুত্ব প্রদান করে, রাজনৈতিক সমর্থন প্রদান করে। জনগণের বাইরে গিয়ে বিদেশি প্রভুদের সহায়তায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে অভিভাবকত্ব করার দিন শেষ হয়ে এসেছে। রাজনীতি করতে হলে এ দেশের মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছা প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দিয়েই রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে হবে। বিদেশি বেনিয়াদের খুশি করে রাজনীতি করার দিন আর বাংলাদেশে নেই।

সুতরাং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোকে কৌশলী হয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না যেই সিদ্ধান্তের বিপরীতে দেশের জনতা অসন্তুষ্ট হয়। হরতাল অবরোধের মতো কর্মসূচি থেকে ফেরত আসতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে যেভাবে ক্রমান্বয়ে বিনিয়োগ করছে সেটি অব্যাহত থাকলে এ দেশের তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ যেভাবে তৈরি হবে ঠিক তেমনিভাবে দেশের অর্থনীতির চাকাও সচল থাকবে। আবার বিপরীত দিকে রাজনৈতিক সংঘর্ষ ঘটলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিবে। বাংলাদেশের সাধারণ জনতা কখনোই এটি প্রত্যাশা করে না। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি প্রণয়ন করা উচিত। তা ছাড়া রাজনৈতিক কোনো বাদানুবাদ থাকলে রাজনৈতিক সংলাপ আয়োজন করে সমস্যার সমাধান আনা যেতে পারে; কিন্তু কখনোই এ ক্ষেত্রে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করা যাবে না। কেননা বিদেশিরা কখনোই বাংলাদেশিদের সুবিধা বুঝবে না তারা কেবলমাত্র তাদের নিজেদের কিসে ভালো হয়, সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এ ব্যাপারগুলোও আমাদের রাজনীতিবিদদের মনে রাখা উচিত।

সর্বোপরী সংঘর্ষের রাজনীতি, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এ দেশের মানুষ কখনোই গ্রহণ করেনি। ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করে সাময়িক সময়ের জন্য লাভবান হলেও দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে যারা ষড়যন্ত্রের ওপর ভর করে রাজনীতি করে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। জনগণের কাছে তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয় এবং এমন নজির এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে রয়েছে। কাজেই কতিপয় রাজনীতিবিদের সংঘর্ষের রাজনীতি, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি, বিদেশনির্ভর রাজনীতি থেকে ফিরে এসে জনগণের কল্যাণের রাজনীতিতে বিশ্বাস রাখা উচিত।

লেখক: চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ