সংকটে পুলিশ, এ সুযোগে তৎপর অপরাধীচক্র
বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অনৈতিক আর্থিক লেনদেন, বদলি এবং পদোন্নতি বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বিভিন্ন ঘটনায় আগে থেকেই সমালোচিত ছিল পুলিশ বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্যরা নতুন করে ইমেজ সংকটে পড়েছে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নির্বিচারে অস্ত্র ব্যবহারের কারণে। এ সময় তাদের বিতর্কিত ভূমিকা পালনের জন্য ক্ষোভের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় পুলিশ বাহিনী। বিভিন্ন স্তরে পুলিশ কর্মকর্তা এবং সাধারণ সদস্যদের বেপরোয়া আচরণের ফলে তাদের প্রতি একদিকে জনগণের আস্থা নষ্ট হয়েছে, অন্যদিকে তারা নিজেরাও পড়েছে চরম সংকটে।
জুলাই-আগস্টে আন্দোলন চলাকালে হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ চালানো হয় সদর দপ্তরসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা ও যানবাহনে। হত্যা করা হয় অন্তত ৪০ পুলিশ সদস্যকে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানা ও ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। আত্মগোপনে চলে যায় কয়েকশ সদস্য, ভেঙে পড়ে এই বাহিনীর কাঠামো। এই অবস্থায় জনবল স্বল্পতা এবং মনোবলহীনতার ফলে জননিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে না বাংলাদেশ পুলিশ। বিশেষ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।
জনবল সংকট
রাজধানীর বিভিন্ন থানা ঘুরে এবং পুলিশ কর্মকর্তা, সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় সরকারের পতনের পরে থানাগুলোতে এখনো পর্যাপ্ত পরিদর্শক নিয়োগ দেয়া যায়নি। ডিএমপির বিভাগীয় এলাকায় সংকট রয়েছে অতিরিক্ত এবং পুলিশের সহকারী উপপুলিশ কমিশনারেরও। এদিকে ডিএমপির সূত্র বলছে, লালবাগ, যাত্রাবাড়ী, মিরপুরসহ ডিএমপির অধিকাংশ থানাই অভ্যুত্থানের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৫১টি থানার মধ্যে অক্ষত ছিল কেবল তিনটি থানা। এর মধ্যে কঙ্কালসার অবস্থা অন্তত ২০টি থানার। নাজুক রূপ নিয়েছে মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, আদাবর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, ভাটারা ও উত্তরা পশ্চিম থানা।
রাজধানীর মিরপুর, পল্টন, মোহাম্মদপুর, আদাবর, পল্লবী, শেরেবাংলাসহ বেশ কয়েকটি থানা সরেজমিন দেখা যায় পরিদর্শক পদমর্যাদার তিন কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করার কথা; কিন্তু জনবল সংকটের ফলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একজন করে পরিদর্শক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে পরিদর্শক (তদন্ত) অতিরিক্ত হিসেবে অপারেশনের দায়িত্ব পালন করবেন। জনবল সংকটের কথা স্বীকার করে তেজগাঁওয়ের উপ-পুলিশ কমিশনার রুহুল কবির ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, জনবল কম থাকায় থানাগুলোতে একাধিক পদের দায়িত্ব (তদন্ত, অপারেশন) পালন করছেন একজন কর্মকর্তা।
মনোবল সংকট
তারা একদিকে যেমন প্রশাসনিক এবং জনবল সংকটে ভুগছেন আবার অন্যদিকে তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি তাদের মানসিক অবস্থাকে সঙ্গীন করে তুলেছে। পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এই বাহিনীর সদস্যরা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না আতঙ্কের রেশও। সাধারণ পুলিশ সদস্যরা বলছেন, স্বাধীনতার পরে একসঙ্গে এরকম ঘটনায় এত পুলিশ সদস্য হামলা এবং হত্যার শিকার হননি। এসব ঘটনায় তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতির সঞ্চার হয়েছে ফলে স্বাভাবিক কার্যক্রমে হয়েছে ছন্দপতন। স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে আরও সময় লাগবে তাদের বলে জানান তারা।
এদিকে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, সহকর্মীদের মনোবল ফেরাতে এবং মানসিক সাপোর্ট বাড়ানোর দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছেন তারা। পুলিশের মানসিক শক্তি বাড়িয়ে মাঠে ঘুরে দাঁড়াতে কারিগরি সহায়তা ছাড়াও নানা রকম কৌশল নিচ্ছেন তারা। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘আমাদের পুলিশ সদস্যদের মনোবল উজ্জীবিত করে জনগণকে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে চাই।’
পুলিশ যখন অভিযুক্ত
আন্দোলনে গুলি করে মানুষ হত্যার অভিযোগে এখন পর্যন্ত ৯৫২ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে এসব মামলা হয়। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৮ পুলিশ সদস্য। আসামির তালিকায় ছয়জন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক, সাবেক ৩৬ অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক, ৫ জন অতিরিক্ত আইজিপি, সাবেক ও বর্তমান বেশ কয়েকজন ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সহকারী পুলিশ সুপার, পরিদর্শক, উপপরিদর্শক, কনস্টেবল ছাড়াও বিভিন্ন পদ-পদবির সদস্য রয়েছেন।
বদলি আতঙ্ক
রাজধানীর একটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, জনবল সংকটের পাশাপাশি পুলিশের মধ্যে বদলি আতঙ্কও রয়েছে। ফলে, কাজের পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। জানা গেছে, গতবছরের শেষ চার দিন এবং নতুন বছরের প্রথম তিন দিন, এই সাত দিনে বদলি করা হয়েছে পুলিশের ৯৪ কর্মকর্তাকে। এর মধ্যে বছরের প্রথম দিনেই পুলিশের ৬৫ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে একযোগে বদলি করা হয়। দুই দিনে দুই দফায় সদর দপ্তরের নির্দেশে বদলি করা হয় ৮৭ জনকে।
গত ২ জানুয়ারি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার ১৮ জন কর্মকর্তাকে বিভিন্ন ইউনিটে বদলি করা হয়। এদিকে গত বছরের শেষ দিন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বদলির নির্দেশ দেয় এসি পদমর্যাদের সাত কর্মকর্তাকে। বদলি হওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তারা রয়েছেন। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবু সাঈদ। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, ৫ আগস্টের আগে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে যে অরাজক অবস্থা তৈরি হয়েছিল, তাতে পুলিশে নেতৃত্বের পরিবর্তন অনিবার্য ছিল।
সুযোগ নিচ্ছে অপরাধী চক্র
পুলিশ বাহিনীর নাজুক অবস্থার কারণে দেশে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে চুরি, ডাকাতি এবং হত্যাসহ গুরুতর অপরাধ। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বেড়েছে খুন, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশে খুনের শিকার হয়েছেন ৫৮৩ জন, অক্টোবর মাসে ৩৯৯ জন ও নভেম্বরে ৩৩৭ জন। রাজধানী ঢাকায় গত বছরের নভেম্বরে খুনের মামলা হয়েছে ৫৫টি, অক্টোবরে ৫৭টি ও সেপ্টেম্বরে ১৪৮টি।
পুলিশের তথ্য বলছে, খুন ছাড়াও ছিনতাই, ডাকাতি, দস্যুতা, শিশু নির্যাতন, অপহরণ, সিঁধেল চুরির ঘটনা অনেকে বেড়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর দুই মাসে ডাকাতির মামলা করা হয়েছে ১১১টি, শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে ৫২৯টি, দুই মাসে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ১৬১টি। এ ছাড়া শুধু ঢাকাতে গত চার মাসে গণপিটুনিতে মারা গেছে ৫৭ জন। হত্যার ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে অপরাধবিদরা বলছেন, আলোচিত সন্ত্রাসীদের জামিনে বেরিয়ে যাওয়া আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে, যা থেকে উত্তরণের আশু প্রয়োজন। সক্রিয় হতে থাকা পেশাদার অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যৌথ বাহিনীর তৎপরতা থাকলেও তা উল্লেখযোগ্য নয়। তারা বলছেন, এ কারণেই ৫ আগস্টের পর ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা বাড়ছে। পুলিশ বলছে সরকার পতনের পরে প্রথম দিকে দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা আপাতদৃষ্টিতে ভেঙে পড়ছে মনে হলেও খুব শিগগির উন্নতি পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে চুরি, ডাকাতি, মাদক সরবারহসহ বহুমাত্রিক অপরাধ আগের থেকে কম, তা কোনো অবস্থাতেই বলা যাবে না। বরং কিছু ক্ষেত্রে বেশি বলে তারাও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাই রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকা এখনো অনিরাপদ। কিছু ক্ষেত্রে পুলিশকে যৌথ বাহিনীর ওপর নির্ভরশীলও হতে হচ্ছে।
সমাজবিজ্ঞানীদের বক্তব্য
পুলিশের এ সংকট নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক, অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে শতভাগ সক্রিয় থাকার কথা থাকলেও তার বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে না। অভ্যুত্থানের সময়ে পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের অস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া সেসময় পুলিশের ওপর হওয়া হামলায় তারাও আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে দিন অতিবাহিত করছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশের মাঝে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, তার ফায়দাও তুলছে অপরাধীরা। অপরাধীরা যখন জানে অপরাধ করে পার পাওয়া সম্ভব এবং তাদের অপরাধকে আইনানুগভাবে যারা প্রশ্ন করবেন, তাদের যখন দৃশ্যমান সংকট আছে, তখন অপরাধীরা এটাকে তাদের সুযোগ মনে করে। বর্তমানে দেশে সেই পরিস্থিতি বিদ্যমান।
দ্রুত উন্নতির আশা
পুলিশের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই সংকট কাটিয়ে দ্রুতই আরও ভালোর দিকে যাবে পুলিশ বাহিনী। তারা বলছেন, সব সমস্যা কাটিয়ে পুলিশ এখন পুরোদমে কাজ করছে। ট্রাফিক এবং থানার কার্যক্রমে গত দুই মাসে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ঘিরে পুলিশের ১ হাজার ৭৪টি গাড়ি ও ৪৯৭টি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতোমধ্যেই সেগুলো মেরামত করা হয়েছে। পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে আনা হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির শুরুতে পুলিশের আভিযানিক কাজ বন্ধ থাকলেও ইতোমধ্যেই চাঙা মনোভাব নিয়ে তারা অভিযান চালচ্ছে। দ্রুতই পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।
শৃঙ্খলা ফেরাতে পদোন্নতি
তবে ভালো খবর হচ্ছে, পুলিশ বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত দুই মাসে ৯৭৫ জন পুলিশ সদস্যের পদোন্নতি হয়েছে। এদের মধ্যে অতিরিক্ত আইজি (গ্রেড-১) একজন, ডিআইজি ৮০ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি ৪৮ জন, ৩০০ এসপি এবং ৬৪ পুলিশ পরিদর্শক আছেন। কনস্টেবল থেকে এসআই পদমর্যাদার ছয়টি পদে ৭৫৩ জন পুলিশ সদস্যের পদোন্নতি হয়েছে গত দুই মাসে। এদের মধ্যে টিএসআই ছয়জন, এসআই (স.) ১৫ জন, এসআই (নি.) ১৮ জন, এএসআই (নি.) ১২ জন। কনস্টেবল থেকে নায়েক হয়েছেন ৬৭৭ জন।
পুলিশ সংস্কার কমিশন
গত অক্টোবরে জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে। ৩ অক্টোবর পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠনের পর গত ৩১ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং ওই কমিশনের সদস্যসচিব আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত ‘কেমন পুলিশ চাই’ শিরোনামে জনমত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এতে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে পুলিশ সংস্কারের বিষয়ে কমিশনের ওয়েবসাইটে মতামত চাওয়া হয়।
এতে জনবান্ধব, জবাবদিহিমূলক, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ আধুনিক, নিত্যনতুন অপরাধ শনাক্তে উন্নত প্রশিক্ষণ, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, নিরপেক্ষ আইনের শাসনের প্রতি অনুগত পুলিশ বাহিনীর বিষয়ে মতামত পাঠিয়েছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রায় ২০ হাজার মানুষ। আশা করা যাচ্ছে এসব মতামতের ওপরে ভিত্তি করে নতুন বছরে পুলিশ বাহিনীর সংস্কারে আসবে নতুন পরিকল্পনা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে