Views Bangladesh Logo

আন্দোলনের পরে নীরবতা, নীরবতার ফাঁকে দুর্নীতি

Rahman  Mridha

রহমান মৃধা

আমরা এক অদ্ভুত জাতি- জেগে উঠতে পারি, প্রতিবাদে ফেটে পড়তে পারি, রাজপথে দাঁড়াতে পারি। কিন্তু সেই আন্দোলনের প্রাপ্তি কি শুধু ব্যানার, পোস্টার আর পুলিশের লাঠিচার্জে সীমাবদ্ধ? আমরা বারবার প্রমাণ করেছি, ‘আমরা পারি’; কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি- আমরা ঠিক কী পারি? আর কী পারি না? কেন পারি না? বছরের পর বছর ধরে আমরা দেখে আসছি- বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ কখনো কোটা সংস্কারের দাবিতে, কখনো শিক্ষার বৈষম্যের বিরুদ্ধে, কখনো আবার বেতনবৈষম্য, ভর্তি দুর্নীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, কিংবা আবাসিক সমস্যার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব কিংবা চট্টগ্রামের আন্দোলনস্থলগুলো এসব আন্দোলনের নীরব সাক্ষী।

২০১৮ সালে দেশের বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় আঞ্চলিক বৈষম্য ও আর্থ-সামাজিক অবস্থান নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল। অনেক শিক্ষার্থী অভিযোগ তোলে- বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ঘরভাড়াভিত্তিক প্রশ্ন’, ভিআইপি কোটা, এমনকি রাজনৈতিক দলের অনুগতদের জন্য অঘোষিত সংরক্ষণ চালু আছে। এসব কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়ে, ভর্তি হয় না যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও। এ প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এক সপ্তাহের লাগাতার আন্দোলন চালায়। অনেক মিডিয়ায় বিষয়টি আসে, প্রশাসন আশ্বাস দেয় তদন্তের; কিন্তু কী হলো এরপর? কিছুদিন পর আন্দোলন ম্রিয়মাণ হয়, সংবাদমাধ্যম অন্য ইস্যুতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও, কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। আজও সেই একই দুর্নীতি, একই বৈষম্য- অদৃশ্য চক্রের অভ্যন্তরীণ দখলদারিত্ব অটুট রয়েছে।

আমরা আন্দোলন করি; কিন্তু সংস্কার হয় না কেন? এর পেছনে কয়েকটি গভীর কাঠামোগত কারণ রয়েছে:
১. চেতনার সীমাবদ্ধতা: আমরা ক্ষণিকের আবেগে আন্দোলন করি; কিন্তু দূরদৃষ্টি ও কৌশলগত পরিকল্পনা আমাদের নেই। আন্দোলনের ফলোআপ, চাপ বজায় রাখা, সংগঠিত দাবি উপস্থাপন- এগুলো আমাদের আন্দোলনের সংস্কৃতিতে অনুপস্থিত।

২. নেতৃত্বের দুর্বলতা ও বিভক্তি: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছাত্র আন্দোলনগুলো দলীয় রাজনীতির ছায়াতলে পড়ে। ফলে আন্দোলন শক্তি হারায়, বিভক্ত হয়ে পড়ে, আর আদর্শের জায়গায় স্থান নেয় গোষ্ঠীগত স্বার্থ।

৩. রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া: সরকার আন্দোলনকে দমন করতে ব্যস্ত থাকে, সমাধান দিতে নয়। নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহারের মাধ্যমে ছাত্রদের ভয় দেখানো, গ্রেপ্তার বা নজরদারি- এসব পদ্ধতি বৈষম্য দূর করার পরিবর্তে গণচেতনাকে দমিয়ে রাখে।

৪. সুশাসনের অভাব: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনের মধ্যে জবাবদিহির অভাব থাকায় কেউ এই অনিয়মের দায় নেয় না। যখন প্রশাসন নিজেই রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন তারা চুপ থাকে কিংবা সমস্যা ঢেকে রাখে।

প্রশ্নটা এখন খুব স্পষ্ট, আমরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলি; কিন্তু কেন আমরা বৈষম্য দূর করতে পারি না? কারণ, আমরা প্রতিপক্ষকে চিহ্নিত করি; কিন্তু কাঠামো পরিবর্তন করি না। আন্দোলন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে হয়; কিন্তু দুর্নীতিবাজ ব্যবস্থাকে ঘাঁটি গেড়ে রাখে।

আমরা পরিবর্তনের দাবি জানাই; কিন্তু নিজে পরিবর্তনের প্রস্তুতি নেই। ফলে আন্দোলনের পর আসে নীরবতা, আর নীরবতার ফাঁকে দুর্নীতির নতুন রূপ গজিয়ে ওঠে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে যদি সত্যিকার অর্থে ফলপ্রসূ করতে হয়, তবে তার চারটি স্তম্ভ থাকতে হবে:
* জ্ঞানভিত্তিক প্রস্তাবনা: কেবল স্লোগানে নয়, পরিসংখ্যান ও নীতিগত বিকল্প দিয়ে আন্দোলনকে সমৃদ্ধ করতে হবে।
* দীর্ঘমেয়াদি কৌশল: আন্দোলন যেন ক্ষণস্থায়ী না হয়, তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব গঠনের প্রয়োজন।
* সামাজিক ঐক্য ও চাপ: শিক্ষার্থীরা যদি সমাজের অন্য অংশকে জড়াতে না পারে, তবে রাষ্ট্র সহজেই আন্দোলনকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে।
* স্বচ্ছ নেতৃত্ব: রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও আদর্শিক নেতৃত্ব ছাড়া কোনো আন্দোলনই তার মূল লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না।
আজকের বাংলাদেশে বৈষম্য শুধু শিক্ষায় নয়- স্বাস্থ্য, চাকরি, বিচার, এমনকি মৌলিক অধিকারেও রয়ে গেছে। আর তাই প্রশ্নটা আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে।

আমরা যদি জানি, কী নিয়ে আন্দোলন করছি- তবে কেন জানি না, কীভাবে তা দূর করতে হয়? তাই সময় এসেছে আন্দোলনের পাশাপাশি পরিবর্তনের প্রক্রিয়া বোঝার, কাঠামো ভাঙার এবং সত্যিকারের মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার সংগ্রাম শুরু করার। নয়তো আমরা চিরকালই বলতেই থাকব- ‘আমরা পারি; কিন্তু দূর করতে পারি না।’

আমরা সমস্যার বিরুদ্ধে গর্জে উঠি; কিন্তু সমাধানের পথে দাঁড়িয়ে পড়ি নিজেদের সুবিধার মুখোমুখি হয়ে। কারণ, আমরা কেবল দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রে নয়- একটি দুর্নীতিকে সহনীয়, এমনকি গ্রহণযোগ্য হিসেবে মানিয়ে নেয়া জাতিগত মানসিকতায় বড় হয়েছি। যেই মুহূর্তে সংগ্রামের বদলে সুযোগ আসে, আমরা আদর্শ নয়, স্বার্থকেই বেছে নিই। মুষ্টিভর্তি অর্থ, প্রভাবশালী পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা সাময়িক নিরাপত্তার লোভে আমরা আন্দোলনকারীর মুখোশ খুলে অপরাধীর হাত ধরতে দ্বিধা করি না। এই আত্মবিক্রয়ের সংস্কৃতি আমাদের সবচেয়ে বড় পরাজয়- এ কারণেই আমরা পারি; কিন্তু কখনোই ‘দূর’ করতে পারি না।

আমরা আজ প্রায় ১৮ কোটি বাংলাদেশি। আমাদের সময়ের এই ‘দূর করতে না পারা’র কারণ জানার পরেও, আমরা কিছু না করে, নির্বিকারভাবে চলে যাচ্ছি। এই সত্যটা আমাকে গভীর হতাশায় নিমজ্জিত করে। আপনাকে কি করে না?

রহমান মৃধা: গবেষক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ