ছাগলকাণ্ড
মতিউরের দুর্নীতি আর ক্ষমতার কাছে পরাজিত হলেন বদিউর রহমান
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমানকে নিয়ে দেশ টেলিভিশনে শেখ বদিউর রহমানের কথা শুনছিলাম। বদিউর রহমান সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘অফিসার ক্লাস ওয়ান’ পদে যোগ দিয়েছিলেন, পরে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডার সার্ভিসে চলে যান। তাকে আমার মেজো ভাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব মহিউদ্দিন আহমদের বাসায়ও দেখেছি, তাদের আড্ডায় তাকে মুড়ি ছাড়া আর কিছু খেতে দেখিনি।
বদিউর রহমান এনবিআরের চেয়ারম্যান হয়েই ঘুষখোর মতিউরকে চট্টগ্রাম বন্দর কাস্টমস থেকে বদলি করেন রাজশাহীতে। মতিউরকে না ঘাটাতে এনবিআরের চার সদস্য চেয়ারম্যান বদিউর রহমানকে সতর্ক করেছিলেন; কিন্তু অধস্তন মতিউরের ক্ষমতাকে সচিব বদিউর রহমান গুরুত্ব দেননি। মতিউরের রাজশাহীতে বদলি ঠেকানোর জন্য সেনা কর্মকর্তাদের তরফ থেকে তদবির আসতে থাকে, তদবির করেন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদও। বদিউর রহমান কারও তদবির শোনেননি, শুনেননি বলেই এনবিআর থেকে বদিউর রহমানকে বদলি করে দেয়া হয়, তিনি এমন অপমানজনক পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। এভাবে অধস্তন কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ঘুষ, দুর্নীতি আর ক্ষমতার কাছে পরাজিত হলেন সৎ, দক্ষ ও আপোষহীন কর্মকর্তা বদিউর রহমান।
নতুন চেয়ারম্যান মোহাম্মাদ আবদুল মজিদ এনবিআরে যোগ দিয়েই মতিউরকে রাজশাহী থেকে পুনরায় চট্টগ্রাম পোর্টে বহাল করেন। ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দেয়ার আগে আবদুল মজিদও বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করতেন। দুর্নীতি রোধে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশংসা করে এর আগে আমি একটি কলাম লিখেছিলাম, আমার ধারণা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবাজদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়া হলেও মাঠ পর্যায়ে ঘুষ-দুর্নীতি কম ছিল। আমার ধারণার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আশরাফ আলী উল্লেখ করেন যে, ‘ফখরুদ্দিন আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সমসাময়িক একই হলের বাসিন্দা। অনিয়মতান্ত্রিক সরকার কখনো কোথাও কোনো দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে এনেছে বলে শোনা যায় না।’
সচিব বদিউর রহমানের কথা শোনার পর আশরাফ আলী স্যারের কথাটি বিশ্বাস না করে উপায় নেই। তবে মতিউর রহমান শুধু সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি, তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও এম সাইফুর রহমানের সঙ্গে; তাদের বেড রুমেও মতিউরের সহজ যাতায়াত ছিল; কথাটি আমার নয়, এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর রহমানের। ঘুষ ও দুর্নীতির বিনাশ নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি স্লোগান হচ্ছে, ‘পিস্তল ঠেকিয়ে সন্ত্রাসীদের টাকা আদায়, আর ফাইল ঠেকিয়ে ঘুষ নেয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোনো সরকার প্রধান তার আমলের দুর্নীতির কথা স্বীকার করেননি। ২০০১ থেকে ২০০৫ সন পর্যন্ত পরপর পাঁচবার বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, তারপরও বিএনপি তাদের আমলের দুর্নীতির কথা স্বীকার করেনি।
ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি দুর্নীতির রিপোর্টদাতা টিআইবিকে বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর পর আওয়ামী লীগ সরকারও তাদের আমলের টিআইবির প্রতিবেদনকে ধোলাই করেছে, তাদের আমলের দুর্নীতির কথা স্বীকার করেনি। দুর্নীতি নিয়ে প্রকাশিত টিআইবির প্রতিবেদনকে শুধু অস্বীকার করা হয়নি, সব সরকারের আমলে চ্যালেঞ্জও করা হয়েছে। টিআইবির প্রতিবেদনকে চ্যালেঞ্জ করে প্রতিটি সরকার দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে। অন্যদিকে ঘুষ, দুর্নীতি জায়েজ করার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী একজোট। দুদক থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়কর বিভাগ ও কাস্টম বিভাগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে বহুবার; এনবিআরের দুর্নীতির ব্যাপকতা নিয়ে দুদক থেকে অভিযোগ করার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া দুর্নীতির পাল্টা অভিযোগ দিয়ে দুদককে থামিয়ে দেন।
মিডিয়ায় ঘুষ আর দুর্নীতির কথা ওঠলেই জোটবদ্ধ বাদ-প্রতিবাদ শুরু হয়; এই বাদ-প্রতিবাদের কারণে দুর্নীতির অনুসন্ধান থেমে যায়। সাবেক আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বনের অনুরোধ করা হয়েছে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে। পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের এই বিবৃতি স্বাধীন গণমাধ্যম ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতাচর্চার পরিপন্থি বলে মত প্রকাশ করেছে সম্পাদক পরিষদ। একই ঘটনা ঘটেছিল সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও; বাংলাদেশ ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১১ জন সাংবাদিক নেতার ব্যাংক হিসাবের যাবতীয় লেনদেনের তথ্য চাইলে আন্দোলনে নেমেছিল সাংবাদিকদের ৬টি সংগঠন; ব্যাংক হিসাব তলবের চিঠি প্রত্যাহারের দাবি ছিল তাদের।
মাঝে মাঝে হেফাজত নেতাদেরও আয়কর নথি যাচাইয়ের কথা ওঠে, হেফাজত নেতারা শান্ত থাকলে আয়কর নথিও শান্ত থাকে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অভিযোগ করে বলেছেন, রাজনীতিকদের পরিকল্পিতভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। ফেনী-১ আসনের সাংসদ আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম সংসদে বক্তব্য প্রদানকালে দুর্নীতি রোধে সরকারের ক্রয়নীতি বা পিপিআর সংশোধনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। তার মতে, ক্রয়নীতির ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে বাজার মূল্য থেকে তিন-চার গুণ বেশি দিয়ে দুর্নীতিবাজরা তাদের নির্দিষ্ট সরবরাহকারীর কাছ থেকে পণ্য কিনছে, দরপত্রে অপ্রয়োজনীয় শর্ত আরোপ করে প্রতিযোগিতা সীমাবদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, খুলনা ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ১০ কোটি টাকার দুটি এমআরআই মেশিন সরবরাহের পর থেকেই নষ্ট অবস্থায় গোডাউনে পড়ে আছে। এমন অভিযোগ অহরহ সরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে ওঠে; কিন্তু প্রতিকার নেই।
প্রতিকার কোথাও নেই। ঘুষ-দুর্নীতির জগতে মতিউর একা নন, চট্টগ্রাম বন্দর কাস্টমসের হয়রানি ও ঘুষ না থাকলে পোশাক শ্রমিকদের বেতন আরও বাড়ানো সম্ভব বলে খোলা মাঠে বক্তব্য দিয়েছে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমএইএ। কাস্টমস কর্মকর্তাদের ঘুষ না দিলে পণ্যের এইচএস কোড বদলে যায়, তথ্য-উপাত্ত যাচাই, পুনঃযাচাই-বাছাই করার অজুহাত দিয়ে সময়ক্ষেপণ করা হয়, ফলশ্রুতিতে আমদানিকারককে লাখ লাখ টাকা ড্যামারেজ চার্জ দিতে হয়। অবশ্য ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেও পণ্যের মিথ্যা ঘোষণা ও অর্থ পাচারের পাল্টা অভিযোগ রয়েছে। ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এই সুযোগটি কাজে লাগায়, কাজে লাগায় বলেই সৎ ব্যবসায়ীরাও হয়রানির সম্মুখীন হতে চায় না, ঘুষ দিয়ে হয়রানি থেকে মুক্তি নেয়। মতিউর রহমানের গুণের শেষ নেই, প্রয়াত রাজনীতিবিদ কাজী জাফরের মতো মতিউরও অভিনয়ে পারদর্শী। এরশাদ সাহেবের মায়ের মৃত্যুতে কাজী জাফর যেভাবে বুকে হাত রেখে কান্নাকাটি করেছিলেন মতিউরও নাকি অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর কবরে গিয়ে কান্নাকাটি করেছেন।
মতিউরের আরও গুণ আছে; ২০২২ সালে শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ যখন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব তখন মতিউর সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের পরিচালক হন। সোনালী ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার জন্য মতিউরকে যিনি খুঁজে বের করেছেন তার সম্পদের খোঁজ নেয়া দরকার। মতিউরের সম্পদের হিসাব নেয়া হচ্ছে, এখন দরকার তার পৃষ্ঠপোষকদের সম্পদের হিসাব। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন জনপ্রশাসনকে ধ্বংস করে ফেলেছে। হারাম রুজি দিয়ে হালাল খাওয়ার প্রতিযোগিতা শুধু বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যেই দেখা যায়। একাত্তরে প্রবাসী সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি আবু সাঈদ চৌধুরীর বিশেষ সহকারী রাজিউল হাসান রঞ্জু আমার কাছে মতিউরের কোরবানির ছাগল নিয়ে লেখা একটি কবিতা পাঠিয়েছেন, কবিতার শিরোনাম ‘ছাগলটা ইতিহাস গড়িল’। কবিতার মর্মার্থ হচ্ছে, ‘দুদক পারেনি যাহা/ছাগলে তা করিল/এভাবেই ছাগলটা ইতিহাস গড়িল।’
এই বছর কোরবানির গরু-ছাগল সত্যিই ইতিহাস গড়েছে। ১৫ লাখ টাকা মূল্যের কোরবানির ছাগলের সঙ্গে মতিউরের ছেলে ছবি তুলে ইতিহাস গড়েছে। শুধু মতিউর রহমানের ছাগল কেন, এবার প্রায় প্রতিটি গরুর দর ছিল লাখ টাকা। এবারের কোরবানির বহর দেখে মনে হয়নি মধ্যবিত্ত কর্মজীবীর কোনো অভাব আছে। এবার গরুর বিশালত্ব দিয়ে কোরবানিদাতার আয়ের বৈধতা নিরূপণ করা সম্ভব হয়েছে। এনবিআরের নির্বাহী প্রধানরা মতিউরকে চিনতে না পারলেও কোরবানির ছাগল তাকে চিনতে পেরেছে। মতিউর রহমানের বিপুল সম্পদের প্রাথমিক অনুসন্ধানের কৃতিত্ব কার? ছাগলের।
লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক এমডি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে