Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বাড়তি আয় বন্ধ তাই বাড়তি কাজও বন্ধ

সুপ্রিম কোর্টের সেকশনে ঘুষ বন্ধ হতেই কাজে স্থবিরতা

Hira  Talukder

হিরা তালুকদার

সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ম্প্রতি সরকার পরিবর্তনের পর দেশের সব প্রতিষ্ঠানেই চলছে সংস্কার কার্যক্রম। ব্যতিক্রম হয়নি সুপ্রিম কোর্টও। এরই মধ্যে প্রধান বিচারপতিসহ বিগত সরকারের সময় আপিল বিভাগে থাকা সব বিচারপতিই পদত্যাগ করেছেন। নিয়োগ দেয়া হয়েছে নতুন প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগে আরও ৭ বিচারপতিকে। দ্রুত এই আমূল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে সুপ্রিম কোর্টের প্রতিটি সেকশনের চিত্রও। যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে সেকশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন। যে কারণে সেখানে অনেকটাই উধাও হয়ে গেছে ‘ঘুষবাণিজ্য’। আর ঘুষ বন্ধ হওয়ার পর মামলা প্রস্তুতের কাজ কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে।

গত ৫ আগস্টের আগে প্রতি কার্যদিবসে হাজারেরও বেশি মামলা সেকশন থেকে হাইকোর্ট বেঞ্চে পাঠানো হলেও এখন তা গড়ে আসছে ৩শ থেকে ৪শ। সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন সেকশনে অনুসন্ধান করে এমনটাই তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে যেসব শাখায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- রুল শাখা (ঢাকা বিভাগ), রিট শাখা, ফাইলিং শাখা, সংস্থাপন শাখা, ক্রিমিনাল মিসেলিনিয়াস শাখা, ডেসপাস শাখা, ক্রয় শাখা ও ক্রিমিনাল আপিল শাখা।

আপিল বিভাগের এফিডেভিট শাখা ও পেপারবুক শাখার বিরুদ্ধেও দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে ক্রিমিনাল রিভিশন, সিভিল রিভিশন, প্রথম আপিল, জেল আপিল, ডেথ রেফারেন্স, ডিক্রি, বেঞ্চ, লাইব্রেরি, মোশন, পেপারবুক, নজির, সাধারণ ও সংস্থাপন, প্রশাসন, বিচার, স্টেশনারি, আদিম দেওয়ানি (কোম্পানি ম্যাটার) ও কোর্ট কিপিং শাখায় কিছুটা কম দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বেশ কিছু বেঞ্চে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, মামলার ধরনের ওপর নির্ভর করে সেকশন ও বেঞ্চে ঘুষের পরিমাণ কম-বেশি হয় । হাইকোর্টে একটি রিট মামলায় সিলের জন্য ৫০ থেকে ২০০, টেন্ডার নম্বরের জন্যও একই রেট, হলফনামার জন্য ২০০ থেকে ১০০০, পিয়নকে ৩০০ থেকে ৪০০, কোর্টে মামলা জমা দেওয়ার জন্য ২০০০ থেকে ৬০০০, আদেশ টাইপের জন্য ১০০০ থেকে ২০০০, আদেশ সাইন করানোর জন্য (আরদালি বা পিয়নকে) ৩০০ থেকে ৪০০, কোর্ট থেকে সেকশনে পাঠাতে প্রায় ৫০০, সেকশনে আদেশ টাইপ ও সার্টিফায়েড কপির জন্য ১০০০ থেকে ৫০০০ এবং সব শেষ ডেসপাসে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ঘুষ দিতেই হতো বিচার প্রার্থীকে।

আর এই প্রক্রিয়ায় গত ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত প্রতি কার্যদিবসে ১ হাজারের কাছাকাছি মামলা সেকশন থেকে হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানির জন্য আসতো। ওই সময় পর্যন্ত সেকশন ও বেঞ্চে ঘুষবাণিজ্যও ওপেন সিক্রেট; কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে ঘুষ লেনদেন। সেই সঙ্গে আশঙ্কাজনভাবে কমে গেছে মামলা প্রস্তুতের কাজ। জানা গেছে ৫ আগস্টের আগে সুপ্রিম কোর্টের সেকশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিকেল ৫টায় অফিস ছুটি হলেও তারা রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত কাজ করতেন। রিট সেকশনের এক সেকশন অফিসার ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, আগে কিছু বাড়তি আয় ছিল তাই মামলা প্রস্তুতের কাজও দ্বিগুণ হতো।

এখন বাড়তি আয় বন্ধ তাই বাড়তি কাজও বন্ধ। এখন বিকেল ৫টায় অফিসের গাড়িতে করেই বাসায় চলে যাই। তামাদি মামলার সেকশনের কর্মকর্ত মো. ইমরান হোসেন বলেন, ‘এখন আর আগের মতো ঘুষ চলে না সুপ্রিম কোর্টের কোনো সেকশনে। তাই সেকশনের অনেক কর্মকর্তা কর্মচারি তাদের দৈনন্দিন কাজ কমিয়ে দিয়েছেন।’

অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে বলেন, ‘ঘুষ বন্ধ হওয়ার পর সেকশনে কাজ কমে গেছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে তা আমিও শুনেছি। দেখেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সুপ্রিম কোর্টের শাখা ও বেঞ্চের দুর্নীতি ছিল সীমাহীন। এটা একটা ট্র্যাডিশন হয়ে গিয়েছিল। টাকা ছাড়া ফাইল নড়তো না। লিস্টে তুলতে টাকা লাগত, অর্ডার বের করতে টাকা লাগত। না দিলে পড়ে থাকত। বিচারপতিরাও এতে বিব্রত হতেন। সতর্ক করতেন। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি। দুর্নীতি চলছিলই। এখন নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায়। ঘুষবাণিজ্যও এখন উধাও হয়ে গেছে সুপ্রিম কোর্টের সব বেঞ্চ ও সেকশন থেকে। আর এই রাগে সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ কমিয়ে দিয়েছেন। বিষয়টি আমরা প্রধান বিচারপতিকে জানাব।’

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিভিন্ন সেকশনে এখন ঘুষবাণিজ্য বন্ধ। আর এর জন্য এসব সেকশনের অনেকেরই কাজে অনীহা বলে জানতে পেরেছি।’ তিনি বলেন, ‘দেশের আদালতগুলোতে বর্তমানে ৪০ লাখের বেশি মামলা ঝুলছে। এই অস্বাভাবিক মামলার জট নিরসনের ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে বিচার ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের শুধু আস্থাই হারিয়ে যাবে না; বিচার ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে। এ অবস্থায় সেকশনের এমন কাণ্ড পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাবে। তাই এ ব্যাপারে দ্রুত অ্যাকশনে যেতে হবে।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ