চারিদিকে কষ্ট; বন্যায় ভাসলো দেশ, এমনকি ক্রিকেট বিজয়
ওই অঞ্চলটা আমার পূর্বপুরুষের ভিটামাটি। কয়েকশ বছর আগে তারা আসেন এই অঞ্চলে মোগলদের পড়ন্ত বেলায় বহুদূর থেকে। এখানেই তাদের ব্যবসা, জমিদারি, পরিবার, বংশবৃদ্ধি- সব ঘটে; কিন্তু শত খানেক বছর আগে পরিস্থিতি একটু পাল্টাতে থাকে। লেখা পড়া শেখাটা তখন জমিদারি চালানোর চেয়ে বেশি লাভজনক হয় ইংরেজ আমলের মাঝ পথে এসে। জমিদারি ব্যবস্থা যে কোনোদিনই অর্থনৈতিকভাবে সফল ছিল না, সেটা ইতিহাসের ছাত্ররা বাদে কেউ বেশি বলে না। বড়লোক জমিদারগুলোও টাকা কামাত নানা ধরনের তেজারতিতে, সেটা সুদের ব্যবসাই হোক বা লবণের। আমার পূর্বপুরুষরা যেতে থাকে চাকরিতে, ওকালতিতে ও শিক্ষায়। আর এসব তো গ্রামের পেশা নয়, তাই সবাই শহরমুখী মানে কলকাতামুখী হয়।
আমার বাবাও বড় হয় কলকাতায়, নোয়াখালীর রায়পুরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়। আমরা ‘দেশের বাড়ি’ বলতে ঢাকা শহর বোঝাই। সেখানে জীবনে গেছি একবার মাত্র। আমাদের গ্রাম নেই। তাই এবারের বন্যায় আমার নিজস্ব ‘দেশ-গ্রামের’ জন্য কষ্ট হয়নি, বাংলাদেশের একটি অঞ্চল অর্থাৎ দেশের একটি অঞ্চলের জন্য ভীষণ খারাপ লেগেছে। যেহেতু কোনো মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ নেই তাই এই বন্যার কষ্টটা ছিল কিছুটা হলেও দূরের কোনো ঘটনা, আমাকে ঠিক ছোঁয়নি। আমার চেনাজানা কেউ নেই, সেখানে কিন্তু সব পাল্টে গেল এক টেলিফোনে। হঠাৎ ‘মো’ ফোন করে। ‘ভাইয়া, ভালা আসেননি? খবর নিতে পারি নাই। এখানে খুব বন্যা, ঘরে থাকতে পারি নাই, ঘরের উপরে আছি।’
হঠাৎ করে সবটাই অন্যরকম হয়ে গেল। যে মানুষটা ফোন করেছিল সে আমাদের বাসার ‘কাজের লোক ছিল’ অনেক আগে। মনে হয় প্রথমে আছে ৬০ বছর আগে, গ্রামের এক বালক। ছিল একটানা, মাঝখানে এক বছর বাদে- আমার মা মারা যাওয়া পর্যন্ত। ১৯৭১ সালে মুক্তি বাহিনীর অনুরোধে সে নৌকায় করে পাকিস্তান আর্মির ক্যাম্পের কাছে গিয়ে বোমা পুঁতে রেখে ব্লাস্ট করে। তারপর গ্রাম ছেড়ে পালায়, ঢাকায় ছিল বাকিটা কাল। মা মারা যান ২০১০ সালে। শেষ সেবা পায় তার হাতেই। হঠাৎ করে বন্যার কষ্টটা আমার ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। গ্রামের যে দরিদ্র শ্রেণি থেকে সে এসেছে, তারা সবসময় শহরে অভিবাসনের ওপর নির্ভর করেছে।
আজকাল গৃহকর্মীর সংখ্যা কম, ফুল টাইম হলে বুয়া হয় বেশি। গ্রামে নারী গৃহশ্রমিকদের দাম বেশি, গার্মেন্টস কর্মীদের দাম আরও বেশি। তবে ৬০ দশকের দিকে গৃহশ্রমিকের পেশায় অনেক বালক শ্রমিক ছিল, ঘরের মানুষ হয়েই থাকত, যেমন ‘মো’। তার ভাইয়ের মারফত আসে ঢাকায়, কেটেছে ঢাকায়, বিয়েশাদি করে স্ত্রীকে এনেছে ঢাকায়। তখন বাড়ির লাগোয়া আলাদা ঘর থাকত এদের জন্য, তাতেই সংসার। একসময় ছেলেমেয়েরা বৃদ্ধি পেলে সংসার ‘দেশে’ মানে গ্রামে রেখে আসে। মা মারা যাবার পর আমরা ভাইরা টাকা তুলে তার জন্য ঘর তোলার ব্যবস্থা করি, কয়েকটি গরু কিনে দিই। তাতেই চলত, প্রয়োজনে সহায়তা দিতাম সবাই। সে ফোনে জানাল এই বন্যায় ঘর-গরু দুইটাই গেছে। ও আমার বয়সী মানে বাহাত্তর। নতুন করে পারবে শুরু করতে?
সন্তানরা আছে, কাজ-চাকরি করে; কিন্তু তেমন কিছুই না। গ্রামে দারিদ্র্য বিমোচনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার অভিবাসন, বিদেশে শ্রমিক হওয়া; কিন্তু তাতেও টাকা লাগে। ওর সেটা নেই অথবা এই খবর জানে না; কিন্তু তা হবে না বোধহয়, গ্রামে সবাই জানে, গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক স্বস্তির পথ অভিবাসন। গ্রাম থেকে ঢাকা ভালো কিন্তু ঢাকার চেয়ে ওমান, জেদ্দা এমনকি মালয়েশিয়া অনেক ভালো। সে অসুস্থ, তার স্ত্রী অধিক, এই রোগ রোগী মারবে কিন্তু যাবে না। সামাল দিতে টাকা লাগে। বন্যা তো চলে যাবে সবার কষ্ট বাড়িয়ে; কিন্তু এই বয়স্ক মানুষের শেষ কালের কষ্ট অনন্ত বন্যার পানির মতোই বাড়ে, বাড়তেই থাকে, না আছে ত্রাণ না আছে পরিত্রাণ। কেবল মৃত্যু ছাড়া।
ওর টেলিফোনটা এসেছিল যখন মনটা হাজারো ঝামেলার মধ্যে প্রসন্ন হয়ে উঠেছিল। বিষয়টি বাংলাদেশের ক্রিকেট বিজয় পাকিস্তানকে প্রথমবার হারিয়ে। যখন খেলতে শুরু হয় মনে হয়নি এমন রেজাল্ট হবে। আমরা তো হারি বেশির ভাগ খেলায়, পাকিস্তানের সঙ্গে একবার জেতা হয়নি। ওটা তাদের হোমগ্রাউন্ড যাতে বল জোরে চলে আর পাকিস্তান তো পেস বোলিংয়ে ওস্তাদ। শাহীন আফ্রিদির নাম শুনলেই নাকি সবাই দোয়া দরুদ পড়ে। আর আমাদের ব্যাটাররা যে কি বস্তু সেটা, সবার জানা; কিন্তু অসম্ভবটাই হলো। সাদমান, মুশফিক, শান্ত, লিটন দাশ এমন ব্যাট কবে করেছিল! আর পাকিস্তানিরা দ্বিতীয় ইনিংসে যা দেখাল মেহেদী আর সাকিবের বলের সামনে তা বলাই বাহুল্য আমাদের কাছ থেকে ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। শেষ পর্যন্ত জিতেই গেলাম। এমন দিনও দেখা গেল।
একসময় এরকম ঘটনা ঘটলে ফেসবুক ভরে যেত পোস্টে কিন্তু এবার তেমন উচ্ছ্বাস নেই কারও। না হবারই কথা। ক্ষতিগ্রস্ত হোক আর না হোক, সবার মনে কষ্ট। কিছু পোস্ট এসেছে, আমিও পাকিস্তানের পরাজয় নিয়ে একটা বিদেশ ব্যাঙ্গচিত্র কপি পেস্ট করলাম। এর বেশি কিছু নয়। খুব অদ্ভুতভাবেই রবীন্দ্রনাথের একটা লেখার কথা মনে পড়ে। তার এক সন্তান মারা যায়। তার মৃত্যুর পর তিনি ট্রেনে ফিরছিলেন, দেখেন অপূর্ব জ্যোৎস্না চারদিক, তার মনেও ছোঁয়া লাগে। তিনি লেখেন, তার সন্তানের মৃত্যু অসম্ভব কষ্টের; কিন্তু এই জ্যোৎস্নাকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। দুটিই সত্য, বাস্তব, একসঙ্গে থাকে। এটাই জীবন। সবাইকে শুভেচ্ছা।
আফসান চৌধুরী: কথাসাহিত্যিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, লেখক ও শিক্ষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে