চিন্তা প্রকাশের ক্ষেত্রে আমি গদ্যকবিতা লিখি
কবি সৌম্য সালেক এ প্রজন্মের প্রতিভাবান কবি। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে আত্মদগ্ধ ও আত্ম-উন্নয়ন করেন নতুন ভাবনায়। কবিতা লেখা ছাড়াও সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ লিখেন। তিনি নিতান্তই বালক বয়স থেকে কবিতা রচনা শুরু করেন। এ পর্যন্ত তার ৫টি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেইসঙ্গে একটি প্রবন্ধগ্রন্থ ও একটি ভ্রমণ কাহিনিও প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে অফিসার পদে কর্মরত আছেন। তিনি ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ সালে চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার তেতৈয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বইমেলা উপলক্ষে তার শিল্পজীবন ও কবিতাবোধ নিয়ে কথা হলো ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ভিউজ বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক কামরুল আহসান।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার লেখালেখি কেমন চলছে?
সৌম্য সালেক: আমি তো আসলে কবিতা লিখি। কবিতা যখন আসে, যখন ভর করে তখন লেখা হয়। খুব ঝামেলার মধ্যে থাকলে একটু নোট নিয়ে রাখি, পরবর্তীতে সেটা সম্পূর্ণ রূপ পায়। আর কিছু প্রবন্ধ লেখার চর্চা আমি করছি দীর্ঘদিন যাবৎ। সাময়িক ব্যস্ততার জন্য সেখানে একটু গাফিলতি যাচ্ছে। আশা করি সেই চর্চটাও চলবে সামনে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার লেখালেখির শুরু কবে থেকে?
সৌম্য সালেক: বলতে গেলে শৈশব থেকেই। ক্লাস সেভেনে থাকার সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই একটি ছড়া লিখেছিলাম। ‘এখনকার ছেলেরা জিজ্ঞাসা করিলে বলে সব পারি’, পরের লাইনটা এখন আর মনে নেই। মিলিয়ে মিলিয়ে লেখা আর কি। পাঠ্যপুস্তকের ছড়া-কবিতা পড়ে প্রভাবিত।
ভিউজ বাংলাদেশ: কখন বুঝলেন যে আপনি কবি হবেন?
সৌম্য সালেক: কবি হওয়া বোঝা বা আমি কবি হয়ে গেছি, এই ব্যাপারগুলো একটু অমীমাংসিত ব্যাপার। আমার কবিতা লেখার যে প্রেরণা এটা আসছে আমার মামার কাছ থেকে। নূরুল ইসলাম বিএসসি। তার আগে একটু বলি, আমার নানি ছোটবেলায় অনেক ছেলে ভোলানো ছড়া শোনাতেন। ঘুম পাড়ানি গান, বারোমাসী গান। আর কবিতার যে চেতনা, তা আমার মামার কাছ থেকেই পাওয়া। তিনি স্কুলশিক্ষক ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম তিনি কবিতা আবৃত্তি করেন। বিশেষ করে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা তিনি অসামান্য আবৃত্তি করতেন। কাণ্ডারি হুঁশিয়ার, বিদ্রোহী, দারিদ্র্য, কামাল পাশা ইত্যাদি কবিতা। আর কী আবৃত্তি! দরাজ কণ্ঠস্বর! তার আবৃত্তি আমার ভেতরে এক অনিন্দ্য আবেদন তৈরি করত। ওই আবেদনের ফলেই কবিতার প্রতি ভালোবাসার জন্ম হয়। ফলে নিজের অজান্তেই এইট, নাইন, টেনে পড়ার সময় অনেক কবিতা লিখি। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে কলেজে পড়ার সময় একজন প্রিয় শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। মঞ্জুরুল ইসলাম স্যার। তিনিও কবিতা ভালোবাসতেন। ছন্দ ভালো জানতেন। আমি কবিতা লিখি শুনে একদিন বললেন, পরীক্ষা শেষ হলে তুমি আমার বাসায় এসো। তোমাকে ছন্দটা শিখিয়ে দেব। ধরতে গেলে প্রাইভেট পড়ানোর মতো করে তিনি আমাকে হাতে-কলমে ছন্দ শিখিয়ে দিলেন। ছন্দ শেখানোর পর তিনি বললেন, এবার ছন্দ ভুলে যাও। তিনি আমাকে গদ্য কবিতা লেখার পরামর্শ দিলেন। স্যার খুব আধুনিক মানুষ ছিলেন। তিনি বুঝতেন আধুনিক কবিতা গদ্যেই লেখা হয় বেশি।
ভিউজ বাংলাদেশ: এখন অধিকাংশ কবিতাই ছন্দ এড়িয়ে গদ্যে লেখা হয়। এতে এ সময়ের কবিতায় কী ধরনের পরিবর্তন ঘটছে বলে আপনি মনে করেন?
সৌম্য সালেক: ছন্দজ্ঞান একজন কবির দক্ষতাকে ফুটিয়ে তুলে বটে, তবে; ছন্দের একটা সীমাবদ্ধতা হচ্ছে ভাবনার যথার্থ স্ফূরণ ঘটে না। ইমেজের খেলাগুলো ঠিক মতো খেলে না। কারণ ছন্দরক্ষা করতে গিয়ে মাত্রাজ্ঞান, এবং অন্তমিলও অনেক সময় খেয়াল রাখতে হয়। গদ্যকবিতার একটা ভালো দিক হচ্ছে অনেক কথা এখানে অল্পতে বলা যায়। যা বলতে চাই তা বলা যায়। ছন্দের কবিতা অনেক আড়ষ্ঠতা তৈরি করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে একটা চপলতা এনে দেয়। ভাব-গাম্ভীর্যটা ঠিক বজায় থাকে না। চিন্তা যে একটা গভীর বিষয়, চিন্তার ক্ষেত্রে এই চাপল্য পরিহার্য। চিন্তাপ্রকাশের ক্ষেত্রে আমি গদ্যকবিতা লিখি। আবার আমার বেশ কিছু কবিতা আছে ছন্দে লেখা। তবে, একটা কথা এখানে বলতেই হয়, শুধু গদ্য লিখে গেলে, বাক্যের পর বাক্য লিখে গেলেই তা কবিতা না। গদ্যের মধ্যেও একটা ছন্দ থাকে। আজকাল অনেক কবির গদ্যকবিতা পত্রিকার প্রতিবেদনের মতো মনে হয়।
ভিউজ বাংলাদেশ: সাম্প্রতিক কবিতার কী বৈশিষ্ট্য আপনার চোখে পড়ছে, যে এ-সময়ের কবিতা এরকম একটা বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে।
সৌম্য সালেক: আমার কাছে মনে হয় সমসাময়িক কবিদের মধ্যে পুরোনো কবিদের প্রভাব এখনো খুব বেশি। বিশেষ করে জীবনানন্দ দাশের। আর গত বিশ বছরের কবিতার মধ্যে ভাষার ক্ষেত্রে এক ধরনের নিরীক্ষা চলছে। কিছু কবিতায় এক ধরণের ভাস্কর্য নির্মাণের প্রয়াস চলছে। মাইকেলেঞ্জেলো যে-ধরণের ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন, পাথরের মধ্য দিয়ে তিনি কথা বলিয়েছেন। সাম্প্রতিক কবিতায় এ-প্রবণতাটা আছে, পাথরে প্রাণ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটা, নির্জীব বস্তুও কেমন যেন কথা বলে। আমাদের সঙ্গে কমিউনিকেট করে। এখন ইমেজ তৈরির প্রয়াসটা অনেক বেশি। কবিতার মধ্যে দুটি বিষয় থাকে: বক্তব্য ও অনুভূতি। অনেক অনুভূতির কোনো গল্প নাও থাকতে পারে। ভাষার তো একটা সীমাবদ্ধতা আছে। অনেক চিন্তা ও অনুভূতিকে ভাষায় প্রকাশ সম্ভব না। আমার মা মারা গেছে, এই হারানোর বেদনা আমি কোনো ভাষা দিয়ে প্রকাশ করতে পারব! তাও, কবিরা এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে চান। এরকম এক ভাষা সৃষ্টি করেন, ইমেজ, প্রতীক সৃষ্টি করেন, যা ওরকম সংবেদনশীল মানুষ না হলে বুঝতে পারেন না। সাধারণ মানুষের কাছে তা দুরূহ হয়ে যায়। কবিদের অধিকার আছে স্বাধীনতার, স্বেচ্ছাচারিতার। সেটা কবিরা করবেই। তবে, আমি আমার কবিতার ক্ষেত্রে একটা স্মারক সাক্ষর রাখার চেষ্টা করি। যেন পাঠকের সঙ্গে এক ধরনের মেলবন্ধন তৈরি করতে পারি।
ভিউজ বাংলাদেশ: এক সময় তো কবিদের প্রতি ধারণা ছিল তারা ছন্নছাড়া, ভবঘুরে; কিন্তু, অনেক আধুনিক কবিদের দেখছি, করপোরেট ধ্যান-ধারণার। আপনিও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির বড় অফিসার। আপনার কবিজীবন কীরকম?
সৌম্য সালেক: আমার হৃদয়ের বৃত্তি হচ্ছে আমার ভাবনা, লেখালেখি। প্রত্যেকটা মানুষের ভাবলোকের মধ্যেই একটা মরমি ব্যাপার আছে। অনেক বেশি কৃত্রিমতা ও চাকচিক্যের মধ্যে যখন মানুষ ঢুকে যায় তখন তার ভেতর থেকে এই মরমি ব্যাপারটা মরে যায়। লেখালখি এক প্রকার মরমিভাবের ব্যাপার। আমি আমার ভাবনার জগতে সেই মরমি ব্যাপারটা সব সময়ই লালন করি। এটাই আমার জীবনের ব্রত। অবকাশ পেলে নিজের ভেতরে আমি ডুব দেয়ার চেষ্টা করি। একদিন সম্পূর্ণ অবকাশ পেলে নিজের মতো করেই বাঁচব। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা। এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করেই বাঁচতে হয়। রুটিরুজির চেষ্টা করতে হয়। নিজের আওতায় যদি আমি বাঁচতে পারতাম তাহলে আমি চারটা কাজ করতাম। ভ্রমণ, ভাবনাচিন্তা, পঠন-পাঠন ও আমার লেখালেখি। এই চারটি বাইরে আমি আর কিছুই করতাম না। আর পারিবারিক দায়িত্ব তো পালন করতেই হয়, করতেই হবে; কিন্তু, আমার জীবনের চূড়ান্ত আত্মনিয়োগ এই চারটা বিষয়ের মধ্যেই।
ভিউজ বাংলাদেশ: অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে একজন কবি, লেখক এগিয়ে যান। অর্থবিত্ত তো দূরের কথা, অনেকে কেমন স্বীকৃতিও পান না। তারপরও সাহিত্য সৃষ্টির পেছনে আপনার অনুপ্রেরণার জায়গাটা কোথায়?
সৌম্য সালেক: এটা আমাদের একটা দুর্ভাগ্য আমাদের লেখা নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে একটা বই বেরোনোর এক বছর পরেই সেটা হারিয়ে যায়। সেটা ভালো হলো না মন্দ হলো তা নিয়েও কেউ কিছু বলে না। ১৭ কোটি মানুষের দেশে বই বিক্রি এত কম, সেটা দুর্ভাগ্যজনক। এটা একটা হতাশা তৈরি করে বটেই। তারপরও আমার প্রেরণার জায়গা আমার ভাবনা, আমার মানসলোক, চিন্তার জগত। র্যনে দেকার্ত যেমন বলেছেন, আমি চিন্তা করি তাই আমি আছি। আমারও তেমন মনে হয়, আমার চিন্তার মধ্য দিয়ে আমি বর্তমান থাকি। কে আমার চিন্তা পড়ল তা আমি জানি না। দু-চারজন পড়ে। কেউ যদি বলে ভালো লেগেছে ভালো লাগে; কিন্তু, আমার লেখার মধ্য দিয়ে আমি নিজেকে খুঁজে পাই, এটাই আমার বড় পাওয়া।
ভিউজ বাংলাদেশ: কবিরা তাদের সারা বছর ধরে লেখা বিচ্ছিন্ন কবিতাগুলোই কাব্যগ্রন্থ হিসেবে প্রকাশ করেন। কোনো সুপরিকল্পনা নেই। এটাকে কবিতার সংকলন বলা যায়, কাব্যগ্রন্থ বলা যায় না। এ ক্ষেত্রে আপনার বইগুলো কতটা দায়ী?
সৌম্য সালেক: এটা তো সত্যই সময়ের অভাবে সঠিক পরিকল্পনা করা হয় না। কোনো বিষয়, ভাব ধরে কবিতা লেখা হয় না। যখন সে অনুভূতি জাগ্রত হয় সেভাবে বিচ্ছিন্নভাবে আমরা কবিতা লিখে থাকি এখন। আগের কবিদের মতো বিষয় ধরে একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে কবিতা লেখা হয় না। এর কারণ সময়টাই বিচ্ছিন্নতার। সময়ের পার্থক্যের কারণেও এটা হয়েছে। অনেকের মতো আমার কবিতার বইগুলোও অনেকটা এমন। তবে, বিচ্ছিন্ন হলেও আমার কবিতাগুলোর মধ্যে আমি একটা সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা করি। বইয়ের নামের ক্ষেত্রে সেই সামঞ্জস্যটা বজায় থাকে।
ভিউজ বাংলাদেশ: বাংলা সাহিত্যে আপনার টিকে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু? আপনার আত্মবিশ্বাস কীরকম?
সৌম্য সালেক: এটা তো আসলে বলা যায় না আমার কবিতা কতদিন টিকবে। আমার জ্ঞান, প্রজ্ঞা যতটুকুই আছে তার সর্বোচ্চটুকু আমার লেখালেখির মধ্য দিয়ে প্রকাশের চেষ্টা করি। আমার কবিতা যদি মানুষের কাছে পৌঁছে তা আমার জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার হবে। আমার কবিতা কতদিন থাকবে সেটা সময়ই বিচার করবে। যদি মানুষের কাছে নাও পৌঁছে থাকি আমি এটাকে দুর্ভাগ্য মনে করব না। আমার একটা কবিতা আছে এরকম: ‘বনের গভীরে কিছু পাখি আছে, কেউ জানে না তারা গান গায়, তারা গান গায় আপন আনন্দে’। আমার চর্চাটাও সেরকম। আত্মসুখের জন্য আমি আমার চর্চা চালিয়ে যাব। সেখান থেকে যদি কেউ হৃদ্ধ হয় সেটা হবে আত্মতৃপ্তির।
ভিউজ বাংলাদেশ: এবারের বইমেলায় আপনার কোনো বই প্রকাশিত হচ্ছে না, এ নিয়ে কোনো দুঃখ আছে?
সৌম্য সালেক: না। আমি মনে করি না প্রতি বছরই বই প্রকাশ হতে হবে। আমার আগের বইগুলো তো মেলায় আছে। পরবর্তী বইয়ের জন্য আমি খুব ভালো করে প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রবন্ধের একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি থাকা সত্ত্বেও আমি বই করিনি। আরও কিছু প্রবন্ধ লিখে, আগের লেখা প্রবন্ধগুলো রি-রাইট করে পরে আস্তে-ধীরে করব।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে