উদ্ভট উটের পিঠে চলছে ক্রিকেট!
নাজমুল আবেদীন ফাহিমের কথায়, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে অধিনায়ক গড়ে ওঠে না, গড়ে তুলতে হয়।’ টাইগারদের অধিনায়ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়ল মাত্র ৮ মাসের মাথায়। নাজমুল হোসেন শান্ত চট্টগ্রাম টেস্টের পরই সব ফরম্যাটের অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন- গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এমনটাই জানাচ্ছে। হুট করে সামনে আসা উটকো ঝামেলা মোকাবিলায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) কি করতে যাচ্ছে- সেটা সময়ই বলবে; কিন্তু বোর্ড পরিচালক নাজমুল আবেদীন ফাহিম সমস্যা নিয়ে যা বলছেন, তা দেশের ক্রিকেটের অভ্যন্তরীণ জটিলতাকে ইঙ্গিত করছে!
শান্ত ইস্যুতে বোর্ড পরিচালকদের মধ্যে প্রথম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম। ক্রিকেট বিশ্লেষক হিসেবে সমাদৃত এ বোর্ড পরিচালকের কথায়, ‘আমার মনে হয় ওর (শান্তর) পাশে থাকা, ওকে সমর্থন দেয়া খুব প্রয়োজন ছিল। সে বাংলাদেশের মতো একটা দলের অধিনায়ক। এই দল খুব অধারাবাহিক। সে নিজেও তরুণ খেলোয়াড়। ওর ব্যাপারে আরেকটু সহানুভূতিশীল হওয়া প্রয়োজন ছিল।’ এ পরিচালকের কথায় অধিনায়ক ইস্যুতে বোর্ডের অভ্যন্তরে টানাপোড়েন কি স্পষ্ট হচ্ছে না?
বাস্তবে যদি তেমন কিছুর অস্তিত্ব থেকেই থাকে, তবে তো শামসুর রহমানের আলোচিত কাব্যগ্রন্থ ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ’-এর মতো করে বলতে হচ্ছে, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে ক্রিকেট।’ যেখানে সমর্থকদের প্রত্যাশা এভারেস্টকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো আকশচুম্বি; কিন্তু বাস্তবতার জমিন হচ্ছে ছন্নছাড়া। দেশের ক্রিকেটের নানা ক্ষেত্রে ছন্নছাড়া অবস্থা ধারাবাহিকভাবেই ফুটে উঠছে। একটা সমস্যা সামনে আসার পর সমাধান খোঁজার আগেই আরেকটা এসে হাজির হচ্ছে।
প্রধান কোচ ছাঁটাই সংক্রান্ত আলোচনা-সমালোচনা বন্ধ হওয়ার আগেই সামনে এলো অধিনায়ক ইস্যু। বাংলাদেশ ক্রিকেট যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে চলছে না- এটা বুঝতে তো পাণ্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন নেই। নড়বড়ে তৃণমূল কাঠামো, ক্রিকেট প্রশাসনে অস্বচ্ছতা, অনিয়ম-দুর্নীতি, পাতানো ম্যাচের মতো একগুচ্ছ জটিলতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে দেশের ক্রিকেট। বোর্ডের শীর্ষ পদে রদবদলের পর নতুন সূচনার যে স্বপ্ন দেখা হচ্ছিল; কোচ অপসারণ ইস্যুতে অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তে সেটা বড় ধাক্কা খেয়েছে। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে স্বয়ং বোর্ড সভাপতি স্বপ্নটাকে বড় ধাক্কা দিয়েছেন! সে কম্পন থামার আগেই সামনে এল শান্তর অধিনায়কত্ব থেকে ‘পালিয়ে বাঁচা’ ইস্যু!
নাজমুল আবেদীন ফাহিম অধিনায়ক শান্তর পাশে দাঁড়ানো ইস্যুতে যা বলেছেন, তা দিয়ে বোধকরি সমর্থকদের ইঙ্গিত করেননি। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে সমালোচনার খরস্রোতের বিপরীতেও সাবলীল থাকতে দেখা গেছে এ ক্রিকেটারকে। ব্যাট হাতে প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারার পরও দলে টিকে থাকার কারণে একসময় সমর্থকরা শান্তকে ‘নাজমুল হাসান পাপনের পুত্র’ কিংবা ‘হাথুরুসিংহের ঘেঁটু’ বলতেও বাদ রাখেনি। সে তুলনায় নিকট অতীতে তেমন সমালোচনা কিন্তু লক্ষ্য করা যায়নি, এখনো যাচ্ছে না। অধিনায়ক কিংবা দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের নিয়ে দর্শক-সমর্থকদের এমন সমালোচনাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখা হয়। বিষয়টাকে যে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছেন- সেটা অতীতে শান্ত নিজেও জানিয়েছেন। তার ওই কথার পর কিন্তু দর্শক-সমর্থকদের সমালোচনার প্রসঙ্গ বড় ইস্যু হয়ে আসছে না। তবে কি অধিনায়ক ইস্যুতে অন্তর্দহন চলছে দেশের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থায়!
শান্তর অধিনায়কত্ব ছাড়তে চাওয়ার কারণ না কি ‘ব্যক্তিগত’। পদত্যাগে ‘ব্যক্তিগত’ শব্দটা কমন। গভীরের কারণ খুঁজতে গেলে দৃষ্টি দিতে হয় তার ব্যক্তিগত নৈপুণ্যর দিকে। অধিনায়কত্বের চাপে ব্যক্তিগত নৈপুণ্য খারাপ হচ্ছে না তো? এক ঝলকে দেখে নেয়া যাক। টেস্টে শান্তর ক্যারিয়ার গড় ২৮ দশমিক ৬৮; অধিনায়ক শান্তর গড় ২৫ দশমিক ৭৬। সাদা পোশাকের ফরম্যাটে কিন্তু খুব বেশি তফাৎ নেই। একদিনের ম্যাচে এ ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার গড় ৩৩ দশমিক ২৯; অধিনায়ক শান্তর গড় ৫২। এখানে দেখা যাচ্ছে, অধিনায়কত্ব তাকে তাতিয়ে দিয়েছে। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ক্যারিয়ার গড় ২২ দশমিক ৮৫, অধিনায়ক হিসেবে খেলা ম্যাচগুলোতে গড় ১৮ দশমিক ৭৬।
তিন ফরম্যাটের পরিসংখ্যানে কিন্তু অধিনায়কত্বকে শান্তর জন্য বোঝা মনে হচ্ছে না। তারপরও কেন দীর্ঘমেয়াদে অধিনায়কের দায়িত্ব পালনের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে ৮ মাসের মাথায় পালিয়ে বাঁচতে চান শান্ত? এ সময়ের মধ্যে তার ব্যাটিং নিয়ে নানা কথা শোনা গেলেও অধিনায়কত্ব নিয়ে কোন প্রশ্ন শোনা যায়নি। বরং তার অধিনায়কত্ব প্রশংসিত হয়েছে।
মিরপুরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট পর্যন্ত শান্তর অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ দল ৯ টেস্ট খেলেছে। ম্যাচগুলোতে ৩ জয়ের বিপরীতে হার সংখ্যা ৬। এ ওপেনারের নেতৃত্বে ৯ ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। এখানেও জয়-পরাজয়ের সংখ্যা টেস্টের মত- ৩ এবং ৬। শান্তর নেতৃত্বে ২৪ টি-টোয়েন্টি খেলেছে বাংলাদেশ। যার ১০ ম্যাচে জয় এসেছে। তিন ফরম্যাটে অধিনায়কত্বের পরিসংখ্যানেও এমন কিছু লক্ষ্য করা যাচ্ছে না যে, হায়... হায়... রব তুলতে হবে। বরং বাংলাদেশের মজ্জাগত উত্থান-পতনের স্বভাবটা শান্তর নেতৃত্বেও স্পষ্ট। তবে কি অদৃশ্য চাপের বিপরীতে রণে ভঙ্গ দেয়ার সিদ্ধান্ত এটা!
শান্তর নেতৃত্ব ছাড়তে চাওয়ার পর সেটা বিসিবি কর্তৃক গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে নতুন এক সমস্যা সামনে এসে দাঁড়াবে নিশ্চিত। তা হল, শান্তর উত্তরসূরি কে? তিন ফরম্যাটে দায়িত্ব নেয়ার মতো একজনকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। চটজলদি যাতে সমাধান খোঁজা হচ্ছে, তা হল টেস্ট এবং এক দিনের ক্রিকেটে মেহেদী হাসান মিরাজকে অধিনায়ক করা। টি-টোয়েন্টিতে দায়িত্বটা তাওহীদ হৃদয়কে দেয়া। এটা ধারনা মাত্র, এ ধারণার সঙ্গে বিসিবি কর্মকর্তাদের ভাবনা মিলে যাবে- বিষয়টি এমনো নয়। শান্তর দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানো, বিকল্প হিসেবে অধিনায়ক চূড়ান্ত করার জন্য অপেক্ষার বিকল্প নেই। এ জন্য বিসিবির দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।
মাহবুব সরকার: ক্রীড়া সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে