ঈদে অপরাধ প্রবণতা
ঈদুল ফিতর আয়োজন উপলক্ষে বিভিন্ন শ্রেণি পর্যায়ের মানুষের দীর্ঘদিন ধরে সুপ্ত বাসনায় বিভিন্ন রকমের পরিকল্পনা থাকে। এ পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের নিমিত্তে বছরব্যাপী কর্মযজ্ঞ থাকে জনসাধারণের মধ্যে। আপনি যদি ব্যবসায়ীদের কথাই সামনে নিয়ে আসেন, তাহলে দেখা যাবে ফুটপাতের ব্যবসায়ীসহ অন্য সব শ্রেণি-পেশার ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ঈদকে উপজীব্য করে ব্যবসার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে নবরূপ দিতে চেষ্টার কমতি রাখে না কেউই। ব্যবসায়ীসহ অন্য সব পর্যায়ের জনসাধারণের মধ্যে ঈদকে প্রাণবন্ত করার মানসে কর্মকাণ্ডের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সে জায়গা থেকে বাংলাদেশের নিরীহ, সহজ-সরল আপামর জনসাধারণকে লক্ষ্য করে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি (অতিমাত্রায় লাভ, পণ্যের কারসাজি) লালনের চেষ্টা করে একটি বিশেষ শ্রেণি। একই ধারাবাহিকতায় অপরাধীরা ঈদকে টার্গেট করে থাকে তাদের অপরাধ সংঘটনের লক্ষ্যে, কারণ ঈদ মৌসুমে অর্থনীতির চাকা বিস্তৃত হয় এবং অর্থনীতির সচল রূপকে কাজে লাগিয়ে তাদের মধ্যে অপরাধ করার মনোবাসনা ব্যাপৃত হয়।
ঈদের আগে কিংবা পরে সাধারণ যাত্রীদের কাছ থেকে অবৈধ উপায়ে ভাড়া ও যানবাহন ইস্যুতে হয়রানি করা হয়। ভাড়ার ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ফি খুব অল্পসংখ্যক পরিবহন অনুসরণ করার চেষ্টা করে, অধিকাংশ পরিবহনের ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় দেখা যায়। আবার গাড়ির ক্ষেত্রে দেখা যায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি, রুট পারমিটবিহীন গাড়ি, ড্রাইভারের লাইসেন্স না থাকা কিংবা লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি পরিসরে যারা যাত্রীদের যাত্রায় বাধ্য করে তারা মূলত সঠিক তথ্য গোপন রেখে যাত্রী সাধারণের সঙ্গে প্রতারণা করে থাকে। এগুলো মূলত গুরুতর রকমের অপরাধ; কিন্তু সমস্যাটি হচ্ছে এ ধরনের অপরাধকে আমলে নেয়ার নজির দেশে তেমন একটা দেখা যায় না। তবে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সময় এসেছে, একবার প্রতিবাদ করার সংস্কৃতি চালু হয়ে গেলে পরে এ ধরনের অপকর্ম করার সাহস করতে পারবে না কেউ।
আবার ঈদকে লক্ষ্য করে যত্রতত্র মার্কেট গড়ে ওঠার একটি আয়োজন বরাবরই লক্ষ্য করা যায়। জানা যায়, এ ধরনের মার্কেটের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। অর্থাৎ যারা ব্যবসা করে থাকে, তারা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের চাঁদা প্রদান করে প্রভাবশালীদের। সঙ্গত কারণেই ঈদকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য লক্ষ্য করা যায় এবং এটা অনেকটা প্রকাশ্যেই হয়ে থাকে। অবশ্য যারা এর ভুক্তভোগী তারা ক্ষুণাক্ষরে এর প্রতিবাদ করছে না। তাদের মধ্যে সহ্য করার একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তারা মনে করে ঈদে ব্যবসা করার সময় একটি বিশেষ অংশ চাঁদাবাজদের প্রদান করতে হয়। এ ধরনের নৈরাজ্যের চিত্র কিংবা খবরাখবর প্রকাশ্যে তেমন আসে না, তবে মোটামুটি সবাই এ বিষয়ে অবগত। অস্থায়ী ভিত্তিতে নির্মিত বাজারে ব্যবসা করতে মোটা অঙ্কের টাকা প্রভাবশালীদের প্রদান করতে হয়। এ জায়গা থেকেও আমাদের বের হয়ে আসতে হবে কেননা একটি সভ্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সামাজিক অপরাধ ও রাষ্ট্রীয় অপরাধ কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না।
ঈদে পরিবহন খাতে ব্যাপক নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। স্থানীয় ভিত্তিতে চলমান লেগুনা, সিএনজি, অটোটেম্পো, অটো রিকশার ড্রাইভারদের বিভিন্ন মোড়ে তথা পয়েন্টে নির্দিষ্ট বলয়ের শ্রেণিকে চাঁদা প্রদান করতে হয়। এটি একটি চলমান বিষয় এবং বাংলাদেশের সব জেলাতেই এ বিশেষ শ্রেণিটির উৎপাত লক্ষ্য করা যায়। এদের বয়কট করে পরিবহন পরিচালনা অত্যন্ত দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন ইউনিয়ন ও উন্নয়নের নামে শ্রমিকদের বাধ্য করে চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। ঈদ মৌসুমে চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যায় এবং ড্রাইভাররা এ অতিরিক্ত চাঁদার উসুল তুলে যাত্রীদের কাছ থেকে। ১০ টাকার ভাড়া ২০ টাকা এবং ২০ টাকার ভাড়া ৫০ টাকা হয়ে যায় ঈদ আবহে। কাজেই এ ধরনের অতিরিক্ত এবং অনাহূত নৈরাজ্যময় পরিস্থিতিতে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য লক্ষ্যণীয়। এদের একটি বিশেষ কোরাম রয়েছে যেখানে দেখা যায় বিভিন্ন মহলে কোরাম থেকে চাঁদার রেট নির্ধারিত হয়ে থাকে এবং সেভাবেই দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে।
হাইওয়ে রোডগুলোতে নিরাপত্তায় নিয়োজিতদের ব্যাপারে ঘুষ গ্রহণের সংস্কৃতির বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। বিআরটিএ থেকে শুরু করে যারাই রাস্তার পরিবহন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে নিরাপত্তা প্রদানের জন্য নিয়োজিত তাদের দায়িত্বহীনতা ও ঘুষ গ্রহণের কারণে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, রুট পারমিটবিহীন গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন পরিবহন, লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভার প্রভৃতি বিষয়ে যাদের নজরদারির কথা তাদের বিরুদ্ধে কেবলমাত্র উৎকোচের কারণে দায়িত্বহীনতার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যার পরিপ্রেক্ষিতে রাজপথে দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে এবং মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্রত্যেক বছর অসংখ্য মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় এবং ঈদ মৌসুমে দুর্ঘটনা-পরবর্তী হতাহতের সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ একটির সঙ্গে অন্যটির যোগসূত্র রয়েছে; অপরাধের বহুমাত্রিকতা কিংবা বৈচিত্র্যতা একটি সাইকেল তথা চেইনের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়।
ঈদে যেহেতু একটি ট্রানজিশন পিরিয়ড তৈরি হয় সেক্ষেত্রে শহর থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রামের বাড়িতে আত্মীয় পরিবার-পরিজনের সঙ্গে আনন্দের সময় কাটাতে যায়। এ সুযোগটিকে কাজে লাগাতে চায় অপরাধীরা, বিশেষ করে যারা পুলিশের ভয়ে আত্মগোপন করে থাকে কিংবা অপরাধ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মূলত তারা এ সময়টাকে কাজে লাগাতে চায়। ঈদ মৌসুমে নিরাপত্তার দায়িত্বে বেসরকারিভাবে যাদের রাখা হয় তাদের অনেকেই ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। এক কথায় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কিছুটা হলেও ঢিলেঢালা ভাব পরিলক্ষিত হয়। উপর্যুক্ত পরিস্থিতির কারণে অপরাধীরা লাভ-ক্ষতির হিসাবকে বিবেচনায় নিয়ে বাড়ি ঘরে চুরি করে, লুট করে নিয়ে যায় স্বর্ণালংকারসহ অতিপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য ও দামি আসবাবপত্র।
ট্রানজিশন পিরিয়ড তৈরি হওয়ায় দাগি আসামি, সন্ত্রাসী ও সংঘবদ্ধ অপরাধ গ্রুপের একটি সক্রিয়তা প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করে। আবার সীমান্তবর্তী অপরাধগুলোর আধিপত্যও লক্ষ্যনীয়। সাম্প্রতিককালে কেএনএফের উপর্যুপরি হামলায় প্রশাসন স্বাভাবিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা ও তিনটি পার্বত্য জেলার সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে তৎপরতা দেখাবে। এই সুযোগে অন্যান্য জেলা ও উপজেলাতে আগ্রাসী গ্রুপগুলো সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তাদের সর্বশক্তি দিয়ে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড ঘটানোর পাঁয়তারা করবে। তা ছাড়া গুজব অপপ্রচারে বাঙালি জাতির অভ্যস্ততাকে কাজে লাগাতে পারে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। কেএনএফের অতিমাত্রার তৎপরতা বিশেষ করে শান্তি আলোচনা চলাকালে ব্যাংকের হামলার ঘটনায় নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা উদ্বেগ জানিয়েছেন। তারা বলবার চেষ্টা করেছেন, কেএনএফকে এ দেশের অনেক সন্ত্রাসী গ্রুপ সহযোগিতা করছে এবং গ্রুপটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগসূত্র রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিরোধী গ্রুপ মূলত কেএনএফকে সমর্থন প্রদান করছে এবং উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজও করেছে কেএনএফ। মিজেরাম থেকে অস্ত্র লুটের একটি অংশ এ গ্রুপের কাছে থাকার সম্ভাবনা প্রবল।
কাজেই আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে সারা দেশে যারা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী, তারা কেএনএফের সাইনবোর্ডকে কাজে লাগিয়ে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করতে পারে। এ সব বিষয়ে সচেতন মহলসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। কেএনএফের একজন শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং নাথান বমের খোঁজে তৎপরতা দেখিয়ে চলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সে জায়গা থেকে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপটি তাদের সর্বস্ব দিয়ে পরিস্থিতিকে টালমাটাল করে দিতে পারে। কাজেই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কাজে লাগিয়ে দেশের অন্যান্য জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সন্ত্রাসী হামলা, সংঘবদ্ধ অপরাধ, লুটতরাজ, খুন, নিরীহ জনতাকে গুরুতর আঘাত করাসহ চাঁদাবাজির ব্যাপকতা বাড়তে পারে।
ঈদকে কেন্দ্র করে যে অপরাধপ্রবণতা, সেসব থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার লক্ষ্যে প্রথমত কাজ হচ্ছে সাহসিকতার সঙ্গে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে দেখা যায়, অপরাধের কিছু নমুনায়ন ভাইরাল হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষ সংঘবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করায় সমস্যার সঙ্গে জড়িত অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার হচ্ছে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, অন্যায় কিংবা অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাধ্যমেই অপরাধীদের প্রতিহত করা সম্ভব। প্রতিবাদহীন থাকার কারণেই দীর্ঘদিন ধরে অসংখ্য অপরাধকে আমরা জিইয়ে রেখেছি। জিইয়ে রাখার কারণে আরও অসংখ্য অপরাধ আমাদের আক্রান্ত করছে। কেননা অপরাধকে সহ্য করার কারণে অপরাধীরা আগের তুলনায় আগ্রাসী ও বিধ্বংসী হয়ে উঠছে এবং বহুমাত্রিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের আপামর জনসাধারণ এবং রাষ্ট্রও অনেকভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে। দ্বিতীয় কাজটি হচ্ছে প্রতিবেশীর নিরাপত্তায় প্রতিবেশীকেই এগিয়ে আসতে হবে এবং দায়িত্ব নিতে হবে। তৃতীয়ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ঘটনার আলামত সম্পর্কে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করতে হবে। চতুর্থত, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে সমাজকে, যেখানে প্রত্যেকেই নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারে। শেষতক, অপরাধী যেই হোক না কেন, তার যথাযথ শাস্তি নিশ্চিতে রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে