১৪ দলের সংকট ও প্রাসঙ্গিকতা
দীর্ঘদিন পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের নিয়ে সভা করেছে। এ সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও উপস্থিত ছিলেন। মূলত আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর পর ১৪ দলের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। মাঝে অনলাইনে কয়েকটি বৈঠক হলেও তাতে জোটকে উজ্জীবিত করা যায়নি। গত ২২ মের সভার পর ১৪ দলের শরিকদের কেউ কেউ আশার আলো দেখছেন। আবার অনেকে জোট নিয়ে এখনো হতাশ। তাদের কথা, আওয়ামী লীগ দুর্দিনে বা সমস্যায় পড়লে জোটের কথা বলে। আর সুদিন দেখলে কেবল নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করে। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে জোট শরিকদের মন্তব্যে সত্যতা আছে। আসলে নিজেদের সুদিনে কেউই ছোটদের কথা মনে রাখে না।
ছোট ছোট শক্তিও যে অনেক সময় বড় বিপদের দিনে ভরসার স্থল হতে পারে, এটা আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা খুব একটা উপলব্ধি করেন না। আমাদের দেশে মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত দুটি জোটের অস্তিত্ব আছে। এই দল দুটির ক্ষমতায় যাবার আগে ভালো ভালো কথা ও অঙ্গীকার, একত্রে পথ চলার ব্যাপারে নমনীয়তা থাকে; কিন্তু ক্ষমতায় গিয়েই ভিন্ন চেহারায় অবতীর্ণ হয়। তখন নীতি-আদর্শ-অঙ্গীকার যেমন ঠিক থাকে না, পাশাপাশি বড় দল-সুলভ অহমিকাও প্রকট হয়ে দেখা দেয়। এতে শরিকরা জোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এক ধরনের অভিমান নিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তাতে করে নামমাত্র জোট থাকলেও এর কার্যকারিতা হারিয়ে যায়।
যেমন কার্যকারিতা হারিয়েছে ১৪ দলীয় জোটের অস্তিত্ব। নির্বাচন ও সরকার গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে প্রায় দেড় যুগ আগে যাত্রা শুরু করে ১৪-দলীয় জোট। যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ক্ষমতায় আনা; অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে ২৩ দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত হয় এ জোট। ওই সময় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে জোটের নেতাদের সরব উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়; কিন্তু টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় জোটের মধ্যে এখন দেখা দিয়েছে হতাশা। শরিকদের অভিযোগ, রাজপথে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় এখন আর জোটের প্রয়োজন দেখছে না ক্ষমতাসীন দল। এ নিয়ে শরিক নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। তারা বলছেন, আন্দোলনের সময় জোটের প্রয়োজন ছিল আওয়ামী লীগের কাছে। ওই সময় তারা কে ছোট, কে বড় তা বিচার করত না; কিন্তু টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটি এখন আখের গোছাতে ব্যস্ত।
নীতি-আদর্শ থেকেও দলটি ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। আর ছোট দল হিসেবে শরিকদের মূল্যায়ন করারও প্রয়োজন বোধ করছে না। জোট শুধু নামেই আছে, কাজে নেই। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় জোটের শরিকদের মধ্যে এখন দেখা দিয়েছে হতাশা। শরিকদের অভিযোগ, রাজপথে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় এখন আর জোটের প্রয়োজন দেখছে না ক্ষমতাসীন দল। এ নিয়ে শরিক নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। যদিও তারা বলছেন, ১৪ দলীয় জোট হলো আদর্শিক। এর প্রয়োজন এখনো আছে। এখনো সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীকে পুরোপুরি নির্মূল করে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। ফলে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামে ১৪ দলের ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই ১৪-দলীয় জোট গঠিত হয়। তবে এর প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০২ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের পর। ওই সময় সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের চেষ্টায় ১৪-দলীয় জোট গঠন করা হয়। তৎকালীন বাম দলগুলোর ১১-দলীয় জোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, জাসদ ও ন্যাপ যোগ দেয়। নাম দেয়া হয় ১৪-দলীয় জোট; কিন্তু এ জোটে ১১-দলীয় জোটের শরিক সিপিবি যোগ দেয়নি। ২০০৭ সালের বাতিল হওয়া ‘২২ জানুয়ারির নির্বাচন’ ঘিরে জাতীয় পার্টি, এলডিপি, বিকল্পধারা, গণফোরামকে নিয়ে নির্বাচনি মহাজোট গঠিত হয়। একই সময় ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ‘ফতোয়া চুক্তি’ নিয়েও ১৪ দলে টানাপোড়েন তৈরি হয়। পরে নির্বাচনী জোট থেকে দলগুলো বের হয়ে গেলেও ১৪-দলীয় জোট বলবৎ আছে এখনো। বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে বর্তমানে জোটের দলগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন প্রকাশ্যে আসে।
জোটের শরিক নেতাদের ভাষ্য হচ্ছে, আমরা জোটগতভাবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিলাম। ওই সময় আওয়ামী লীগ ছাড়াও শরিক দলের অনেক নেতা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এরপর ১৪-দলীয় জোটের সমর্থনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় আসার পর জঙ্গিবাদবিরোধী আন্দোলন ও আগুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি আমরা। তখন আমাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যোগাযোগ ছিল নিয়মিত; কিন্তু এখন রাজনৈতিক মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ক্ষমতাসীন দলটি আমাদের আর মূল্যায়ন করছে না। এখন তারা বলছে আমরা ছোট দল। একথা ঠিক যে, আদর্শিক কারণে ১৪ দলীয় জোট গঠন করা হয়েছিল, তা থেকে জোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগ অনেক দূরে সরে গেছে।
একটি জবরদস্তি ও কারসাজির নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। যেখানে জনমত প্রতিফলনের কোনো সুযোগ নেই। দেশে সুশাসন নেই। এক ধরনের লুটপাটতন্ত্র কায়েম হয়েছে। টাকা পাচার হচ্ছে অবাধে। দুর্নীতি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হু-হু করে। চাকরির বাজার সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে না। নতুন বিনিয়োগও আসছে না। ঋণ করে, সুদের টাকা পরিশোধ করে সরকারের জেরবার অবস্থা। এক ধরনের কূপমণ্ডূকতা ও মৌলবাদী ধ্যানধারণা পুরো সমাজে ছড়িয়ে গেছে। ক্রীড়া-সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রে চলছে খরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও ক্রমেই অবক্ষয়ের শিকার হয়ে পড়েছে।
বছরের পর বছর একই দল ক্ষমতায় থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো ‘জি-হুজুর’দের দখলে চলে গেছে। ক্ষমতাসীন দলকে তোষণ ছাড়া কোথাও কোনো নতুন স্বর ও সুর নেই। নেই কোনো আশাজাগানিয়া সৃজনশীল উদ্যোগ। অথচ জোটকে সক্রিয় করে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ ছিল। সুযোগ ছিল সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার চেতনাকে ছড়িয়ে দেবার। অন্ধবিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণের বদলে জ্ঞানভিত্তিক বিজ্ঞান ও যুক্তির সমাজ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হওয়ার; কিন্তু আওয়ামী লীগ সেসবের কিছুই করেনি। করার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করেনি। সবার ‘আত্মিক’ উন্নয়নের পরিবর্তে কিছু সুবিধাবাদী মানুষের ‘আর্থিক’ উন্নয়নই আওয়ামী লীগের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে। নিজে পাওয়া এবং বশংবদ কিছু মানুষকে পাইয়ে দেয়ার নেশা জোটকে একটা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে পরিণত করেছে।
এমনকি করোনা মহামারির মতো বৈশ্বিক সংকটকালেও জোটগতভাবেও কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। বিরোধী দলকে নানা কৌশলে দুর্বল করে এক ধরনের অহমিকা আওয়ামী লীগকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এই অহমিকায় তারা সংখ্যা দিয়ে সব কিছু পরিমাপ করছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেশ দম্ভ নিয়েই বলেন: ‘১৪ দল থেকে এত মন্ত্রী বানানো হয়েছে, অথচ তাদের অনেকে মন্ত্রিত্ব তো দূরের কথা কোনো নির্বাচনেই বিজয়ী হতে পারতেন না। তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হতো। আর একবার যিনি মন্ত্রী হয়েছেন, তাকে যদি এর ওপরে ছাড়া নিচে কিছু দেয়া হয়, তখন তো তিনি বিদ্রোহ শুরু করেন।’
এমন মানসিকতা নিয়ে মহৎ কিছু করা সম্ভব নয়। অথচ ১৪ দলীয় জোটকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে দেশের জন্য টেকসই কিছু করার সুযোগ ছিল। যদি কেন্দ্রে এবং তৃণমূল পর্যায়ে ১৪ দলীয় জোটকে সক্রিয় করা যেত, একটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সারা দেশে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করা যেত, তবে এর সুফল আওয়ামী লীগের ঘরেই যেত; কিন্তু আওয়ামী লীগ এতদিন এই রাস্তায় হাঁটেনি। তারা নিজেরাই সব কিছু কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেছে। এতে করে যত ক্ষুদ্র দলই হোক, জোটের শরিকরা সমালোচনা শুরু করেছে। এটা আগামী দিনে সরকারের জন্য মোটেও কোনো সুফল বয়ে আনবে না।
আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র দাপটে দেশে তো এখন একটি রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে। যদিও সবসময় এ শূন্যতা থাকবে না। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী এ শূন্যতা একসময় কেউ না কেউ দখল করবে। ক্ষমতাসীন দলটি যদি রাজনৈতিকভাবে সচল এবং জনগণের মাঝে থাকতে পারত, তাহলে এ শূন্যতা তৈরি হতো না। তারা একটা ফাঁদে আটকে গেছে। এর থেকে বের হওয়া কঠিন।
লেখক: কলামিস্ট
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে