দেশের নারী ফুটবলে মেঘের ঘনঘটা
বিশ্বকাপে নাম লেখানো যে কোনো দেশের ফুটবলারদের কাছে স্বপ্নের বিষয়। স্বপ্ন দেখছিলেন জাম্বিয়ান ফুটবলাররাও। ১৯৯৪ সালের যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপ বাছাইয়ে দেশটি অসাধারণ ফুটবল খেলছিল। ১৯৯৩ সালের ২৭ এপ্রিল জাম্বিয়া জাতীয় ফুটবল দল বিশেষ বিমানে সেনেগাল যাচ্ছিল অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে। ভয়াবহ দুর্ঘটনায় বিমানে থাকা সব যাত্রীর সলিলসমাধি ঘটে, হাওয়ায় মিলিয়ে যায় প্রতিভায় ঠাসা একটি ফুটবল প্রজন্ম। ১৯৮৮ সালের অলিম্পিকে ইতালিকে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত করা জাম্বিয়া কিন্তু এখনো বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বাদ নিতে পারেনি।
৩২ বছর আগের জাম্বিয়ার ফুটবল ট্র্যাজেডি টেনে আনা বাংলাদেশ নারী দলের কারণে! বর্তমান দলটা বাংলাদেশ ফুটবল ইতিহাসের সেরা- এ নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। বয়সভিত্তিক ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সকল পর্যায়ে সাফল্যের স্বাদ পাওয়া হয়ে গেছে। টানা দুটি সাফ জয়ের মাধ্যমে এ অঞ্চলের সেরা দল বাংলাদেশ। বয়সভিত্তিক সাফল্য আছে এশিয়ার মঞ্চেও। সেই বাংলাদেশ দলটাই যদি আমূল বদলে ফেলা হয়! আপনি হয়তো হিসাব মেলাতে পারছেন না, কিন্তু তেমন আশঙ্কাই কিন্তু করা হচ্ছে!
দল আমূল বদলে ফেলার শঙ্কা আসলে প্রধান কোচ পিটার বাটলারকে ঘিরে নারী ফুটবলার এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) কর্মকর্তাদের টানাপোড়নের কারণে করা হচ্ছে। সিনিয়র ফুটবলাররা ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলারকে চান না- এটা পরিষ্কার; কিন্তু বাফুফে ৫৮ বছর বয়সি বাটলারকেই নারী দলের প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। খণ্ডকালীন দায়িত্ব পেয়ে বাংলাদেশকে সাফ জিতিয়েছেন পিটার বাটলার। তার আগে এ কোচের বাংলাদেশে আসা বাফুফে এলিট একাডেমির প্রধান কোচ হয়ে। এলিট একাডেমির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষে পিটার বাটলারকে নারী দলের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। সম্প্রতি দেশে আসেন এ কোচ। দায়িত্ব গ্রহণের আগে খেলোয়াড়দের সঙ্গে মিটিং করতে চেয়েছিলেন। জটিলতার সূত্রপাত ওখানেই।
নারী ফুটবলাররা মিটিং বয়কট, অনুশীলন বয়কট করে যদি নিজেদের জেদ প্রতিষ্ঠিত করতে চান, বিপরীত দিক থেকে বাফুফে কর্মকর্তারাও যদি কঠোর অবস্থান নেয়; সংঘাত অবধারিত। সে সংঘাত নারী জাতীয় দলে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। বিদ্রোহ করা সিনিয়র ফুটবলাররা কঠোর অবস্থান নিলে প্রয়োজনে তাদের বাদ দিয়ে বিকল্প জাতীয় দল গঠনের ভাবনাও না কি আছে! দলের এক কোচিং স্টাফ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, বাফুফে থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে- ‘সব মেয়ের সঙ্গে কথা বলুন। তারা স্বাভাবিক কার্যক্রমে থাকতে চায় না কি, নিশ্চিত করুন।’ এ কথাতেই কেমন যেন বারুদের গন্ধ! সিনিয়র দলে বড় পরিবর্তনের আশঙ্কা আসলে সে কারণেই।
জাতীয় দল-সংক্রান্ত জল যেভাবে গড়াতে শুরু করেছে, তা কোথায় গিয়ে থামবে- সময়ই বলতে পারে; কিন্তু বিষয়গুলো যে বাংলাদেশ ফুটবলের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না- এটা বুঝতে তো আর পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। বর্তমানে জটিলতা এমন এক পর্যায়ে রয়েছে, যে কোনো একটা পক্ষকে কঠোর অবস্থান ত্যাগ করতে হবে। তাতেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে দেশের নারী ফুটবল; কিন্তু দুপক্ষ যদি নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকে- তা অশনিসংকেত হয়ে আসতে পারে। সে সংকেত নিশ্চয়ই দেশের ফুটবলামোদিরা চাইবেন না।
এমন এক সময় দেশের নারী ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অস্থিরতা শুরু হলো; যখন তৌহিদী জনতার বাধায় নারী ফুটবলের আয়োজন পণ্ড হওয়ার খবর আসছে। দিনাজপুরের হাকিমপুর, জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে একই ঘটনা দেখা গেছে। মৌলবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। এমন আরও কত ঘটনা যে দেখতে হয় কে জানে! তৃণমূলে জটিলতা, জটিলতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে। দেশের নারী ফুটবল হঠাৎ করেই কালো মেঘে ঢেকে গেল! নিকট অতীতে নারী ফুটবল কিন্তু মুঠোভরে দিয়েছে বাংলাদেশকে।
এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ এশিয়ান আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। দুবার অনূর্ধ্ব-১৭ বয়স বিভাগে এশিয়ার শীর্ষ আটে-এ জায়গা করে নিয়েছিল লাল-সবুজরা। সেটা এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ বাছাইয়ে নিজেদের গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাধ্যমে। সাফ বয়সভিত্তিক সব শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। ২০২২ সালের আগ পর্যন্ত আক্ষেপ ছিল সিনিয়র সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে। গোলাম রাব্বানী ছোটনের কোচিংয়ে সেটা দূর হয়েছে। বাংলাদেশ ২০২৪ সালের সাফ শিরোপা ধরে রাখে পিটার বাটলারের কোচিংয়ে।
এ সাফল্যর আগেই ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলারের সঙ্গে সিনিয়র নারী ফুটবলারদের টানাপোড়ন প্রকাশ্যে আসে। সেটা গেল অক্টোবরে, নেপাল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে। সূচনাটা অবশ্য আরও চার মাস আগে, জুনে চাইনিজ তাইপের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে। বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায় প্রথম ম্যাচে সাবিনা খাতুনকে একাদশে রাখলেও বিরতির পর মাঠে নামাননি পিটার বাটলার। দুই ম্যাচ সিরিজের পরের ম্যাচে তো সাবিনা খাতুনকে বেঞ্চে রেখে একাদশ সাজিয়ে ছিলেন ব্রিটিশ কোচ। সবিনাকে ওভাবে একাদশের বাইরে ঠেলে দেয়াটা ছিল বার্তা- নাম কিংবা তারকা খ্যাতি নয়, খেলতে হলে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে।
আধুনিক ফুটবলে এভাবেই চলে। সেখানে কোচের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। ইংলিশ লিগের হাডার্সফিল্ড টাউন, ওয়েস্টহ্যাম ইউনাইটেড, ওয়েস্টব্রমউইচ আলবিওনে খেলা বাটলারও সেভাবে চালাতে গিয়েছিলেন; কিন্তু এটা যে সব সম্ভবের দেশ, বাংলাদেশ। গেল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে সিনিয়রদের উপেক্ষা করেছিলেন প্রথম ম্যাচে। মাঠের বাংলাদেশ ছিল যাচ্ছে তাই! পাকিস্তানের বিপক্ষে হারতে হারতে কোনোক্রমে ড্র করার পর নিজের চেয়ারই নড়বড়ে! খেলোয়াড়রাও বলতে শুরু করেন, ‘কোচ সিনিয়রদের দেখতে পারেন না।’ পরের ম্যাচে সিনিয়রদের নিয়েই মাঠে নামে বাংলাদেশ, নৈপুণ্যেও ছিল বেশ। ভারতকে ৩-১ গোলে উড়িয়ে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে লাল-সবুজরা। পরের গল্পটা সকলেরই জানা- সাফ মকুট ধরে রেখে নেপাল থেকে দেশে ফিরেছে দল।
শিরোপা জয়। ছাদ খোলা বাসে করে শিরোপা উদযাপন। পরবর্তীতে সংবর্ধনা। এসব ঘটনার আড়ালে ছিল কোচ এবং ফুটবলারদের টানাপোড়ন। সেটা সামনে আসে নতুন মেয়াদে নারী দলের প্রধান কোচ হয়ে পিটার বাটলার ফিরে আসার পর। ৫৮ বছর বয়সি কোচ ঢাকায় ফিরে তার সাপোর্টিং স্টাফদের পরিষ্কার বার্তা দেন- অতীতে যা হয়েছে তা ভুলে যাও। আমরা নতুন সূচনা করতে যাচ্ছি। ২৮ জানুয়ারি, মঙ্গলবার ফুটবলারদের টিম মিটিংয়ে ডাকা হয়েছিল; কিন্তু তাতে সাড়া দেননি কোনো ফুটবলার। দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে মিটিংয়ের নির্ধারিত সময়ে কোচিং স্টাফরা মিটিং রুমে গেলেও যাননি ফুটবলাররা। ৩০ মিনিট অপেক্ষার পর মিটিং রুম ছেড়ে যান কোচিং স্টাফরা।
মেয়েদের টিম মিটিং বয়কট করার মাধ্যমেই পরিষ্কার হয়, জুনে শুরু হওয়া টানাপোড়েন এতদিন তুষের আগুন হয়ে ছিল। সে আগুন দৃশ্যত জ্বলতে শুরু করার পর কড়া বার্তা দিয়েছেন বাফুফের নির্বাহী কমিটির সদস্য কামরুল ইসলাম হিল্টন। তার কথার সারমর্ম হচ্ছে, ‘কোচ নিয়োগ দিয়েছে বাফুফে। বাফুফের কথা মাফিকই সবকিছু চলবে। খেলোয়াড়দের মর্জিতে টিম ম্যানেজমেন্ট চলবে না।’ বার্তা পরিষ্কার- পিটার বাটলারের অধীনে খেলতে কারোর আপত্তি থাকলে তাকে ক্যাম্প থেকে অপসারণ করা হবে।
শোনা যাচ্ছে, ওই ঘটনায় ফুটবলারদের কারণ দর্শাও নোটিশ দেয়া হবে। নোটিশের জবাবে জাতীয় দল থেকে একযোগে অবসরের ঘোষণা দিতে পারেন ফুটবলাররা- এমনটাও শোনা যাচ্ছে। ২০২২ সালে প্রথম সাফ মুকুট মাথায় তোলার ১৯১ দিন পর নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হয়েছিল বাংলাদেশ। সেটা নারী দলকে অলিম্পিক বাছাই খেলতে না পাঠিয়ে। অর্থ সংকটের কথা উল্লেখ করে অলিম্পিক বাছাইয়ে দল পাঠায়নি বাংলাদেশ। এবার লাল-সবুজরা নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হলো ২০২৪ সালের সাফ শিরোপা নিশ্চিত করার ৯১ দিন পর!
মাহবুব সরকার: ক্রীড়া সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে