চবির সমাবর্তন: উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি আক্ষেপও
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন হয়ে গেল বর্ণাঢ্য আয়োজনে। ৯ বছর পর অনুষ্ঠিত হওয়া এই বহুপ্রত্যাশিত অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা ভিড় জমিয়েছিলেন প্রিয় ক্যাম্পাসে। আনন্দ, আবেগ ও গর্বে ভরপুর দিনটি রাঙিয়ে তুলেছিলেন পরিবারের সদস্যরাও। তবে নিখুঁত আয়োজনের মধ্যেও কিছু অসঙ্গতি চোখ এড়ায়নি অনেকের। সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের একাংশ অনুষ্ঠান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন—বিশেষ করে ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকা নিয়ে।
বুধবার (১৪ মে) দুপুর ২টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। আয়োজনের শুরু থেকেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে সমাবর্তনে অংশ নেয়ার উচ্ছ্বাস ছিল শিক্ষার্থীদের চোখেমুখে। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ক্যাম্পাসজুড়ে চলেছে ছবি তোলার প্রতিযোগিতা। শহীদ মিনার, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, বুদ্ধিজীবী চত্বর, সেন্ট্রাল ফিল্ড—সব জায়গাতেই যেন ছিল উৎসবের রঙ।
গ্রাম থেকে বাবা-মা ও আত্মীয়দের সঙ্গে নিয়ে অনেকেই এসেছিলেন, কেউ বাবার গায়ে পরিয়ে দিয়েছেন গাউন, মায়ের মাথায় দিয়েছেন সমাবর্তনের টুপি—ছবিতে ধরেছেন জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটি।
তবে আনন্দময় এই দিনেও শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা ছিল মিশ্র। কেউ কেউ জানালেন, তাদের অনুভূতি প্রকাশের সুযোগই দেয়া হয়নি। পরিবহন সংকট, পানি ও খাবারের সমস্যা ও অতিরিক্ত ভিড়। অভিযোগ উঠে পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে কেবলমাত্র মনোযোগ দেয়া হয় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি— ড. মুহাম্মদ ইউনূস—কে ঘিরে।
৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সালাউদ্দিন আফরান বলেন, ‘কোনো শিক্ষার্থীকে অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ দেয়া হয়নি। যাতায়াতের জন্য যে গাড়ির ব্যবস্থা করার কথা ছিল, সেগুলো সকালে ছাড়া আর দেখা যায়নি।’
গ্র্যাজুয়েট সাদেকুর রহমান বলেন, ‘এতোদিন ভেবেছিলাম প্রশাসন ছাত্রবান্ধব। কিন্তু আজ মনে হলো, তারা তৈলমর্দনকেই মূল লক্ষ্য ধরে নিয়েছেন। পুরো অনুষ্ঠানের ৮০ শতাংশ ব্যবস্থাই ড. ইউনূসকে ঘিরে ছিল। শিক্ষার্থীদের জন্য যেটুকু বরাদ্দ থাকা উচিত ছিল, সেটি উপেক্ষিত হয়েছে।’
চবির গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী আদরিত সাদ আয়োজকদের উদ্দেশে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে আসা ২৫-৩০ হাজার মানুষের জন্য যানবাহনের কোনো বাস্তবিক ব্যবস্থা তো করেননি। চক্রাকার বাস ব্যবহার করা যেত। ছাত্রদের এক সপ্তাহের লোডশেডিংয়ের কষ্ট মেনে নিয়ে সমাবর্তনের প্রস্তুতি নিতে হয়েছে—তবুও তারা আশা করেছিল একদিন অন্তত ভালোভাবে কাটবে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আপনারা নিজেই ডিলিট হয়ে গেছেন।’
এই বিষয়ে প্রশাসনের প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর তানভীর হায়দার আরিফ বলেন, ‘সমালোচনাগুলো যৌক্তিক। আমিও চাই ভবিষ্যতে যেন এসব বিষয় সামনে আসে এবং আমরা আরও ভালোভাবে সবকিছু করতে পারি।’
তবুও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সমাবর্তন ঘিরে প্রাণের আবেশ ছড়িয়ে পড়ে সবুজ ক্যাম্পাসজুড়ে। কনভোকিদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিতে এসেছিলেন তাদের প্রিয়জনেরা। একজন অভিভাবক সামিয়া বলেন, ‘৩৩ বছর আগে আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম। তখন সমাবর্তন পাইনি। আজ মেয়ের সমাবর্তনে অংশ নিতে এসে নিজের অতীতকেও ছুঁয়ে দেখতে পারছি।’
সমাবর্তনের দিন শহীদ মিনারে দেখা মেলে আরেক নারী গ্র্যাজুয়েটের। তিনি জানান, সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে এসেছেন এই দিনটির সাক্ষী হতে। ছবি তুলে স্মৃতিতে ধরে রেখেছেন অনন্য মুহূর্তগুলো।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিকে সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। একইসঙ্গে ২২ জন গবেষককে পিএইচডি এবং ১৭ জনকে এমফিল ডিগ্রি প্রদান করা হয়। সরকারের চারজন উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন আয়োজনে।
গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে উপাচার্য অধ্যাপক ইয়াহিয়া আখতার বলেন, ‘তোমাদের অর্জিত জ্ঞান যেন শুধু সমাজে আলো ছড়ায় তা নয় বরং প্রথমেই নিজের অন্তরকে আলোকিত করুক। মানবিক, অসাম্প্রদায়িক ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলবে।’
তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান বিশ্বে শিক্ষার্থীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যেই প্রযুক্তি মানবকল্যাণে ব্যবহার করার কথা, সেই প্রযুক্তি যেন তোমাদেরকে ব্যবহার না করে। সময়কে সৃষ্টিশীল কাজে ব্যয় করো।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে