Views Bangladesh Logo

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার স্থির করতে হবে

বাংলাদেশের জনগণ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করার পরও এরা বাংলাদেশের স্বতন্ত্র জাতীয় সংস্কৃতির কথা ভাবতে পারেন না। তাদের দৃষ্টি অতীতমুখী, বাংলাদেশের লেখক, শিল্পী, রাজনীতিবিদদের অপর একটি অংশে দেখতে পাই ভারতের সংস্কৃতির বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির প্রতি ভীষণ বিরূপ মনোভাব। এরা বাংলাদেশের জনগণের সংস্কৃতির উৎস খুঁজেন মধ্য যুগের মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতিতে বিশেষ করে ইসলাম প্রচারের ইতিহাসে। এরা বাংলার ইতিহাসে বখতিয়ার খিলজির লক্ষণাবতি ও গৌড় জয়ের আগে যেতে চান না। আরবে ইসলাম প্রচার থেকে আরম্ভ করে বাংলার তুর্কি, পাঠান, মোগল শাসকদের শাসনকাল অতিক্রম করে ওহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের ধারা ধরে দ্বিজাতিতত্ত্ব ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা এবং পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে আসেন। তারা জোর দেন দ্বিজাতিতত্ত্বে। এই সেদিন, মনে হয় ২০০৪ সালে, বখতিয়ার খিলজির লক্ষণাবতি জয়ের আটশ বছর পূর্তি উপলক্ষে একদল বুদ্ধিজীবী সতেরটি ঘোড়া নিয়ে পল্টন ময়দানে সমবেত হয়ে অনুষ্ঠান করেছেন এবং প্রচার মাধ্যমে তা বিপুল প্রচার লাভ করেছে। বাংলাদেশের লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ রবীন্দ্রভক্ত এবং অপর একটি অংশ নজরুলভক্ত।

এই দুই ভক্ত-সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা ঠান্ডা লড়াই চলমান দেখতে পাই। রবিভক্তরা নজরুলভক্তদের প্রতি এবং নজরুলভক্তরা রবিভক্তদের প্রতি অপ্রসন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। দুই পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক সহিষ্ণুতার মনোভাব দুর্লভ। এই দুই পক্ষের রাজনীতিবিদদের মধ্যে গত ছত্রিশ বছর ধরেই বিরাজ করছে অসহিষ্ণু আচরণ, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মনোভাব ও আচরণ নয়। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৬ সালের জাতীয় সংসদগুলোতে সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর আচরণ আলোচনা করলে জানা যায়, কী দারুণ অসহিষ্ণুতা দুই পক্ষের মধ্যে বিরাজমান। বর্তমান জরুরি অবস্থার চাপে দুই পক্ষ নির্দ্বন্দ্ব সহাবস্থানে আছে বটে; কিন্তু জরুরি অবস্থা উঠে গেলে হয়তো ছয় মাসও যাবে না, দুই পক্ষ জরুরি অবস্থার আগেকার অবস্থানে চলে যাবে। সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও সংস্কৃতি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে যে ভিন্নতা, তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে দুই পক্ষের স্বার্থের বিরোধ- যাতে ঁহরঃু ধহফ ংঃৎঁমমষব ড়ভ ড়ঢ়ঢ়ড়ংরঃরবং খুঁজে পাওয়া যায় না। দুই পক্ষের কোনোটিতেই জাতীয়তাবোধ বা জাতীয় ঐক্যের চেতনা নেই। তাদের এক পক্ষ অন্য পক্ষকে চিরকালের জন্য শেষ করে দিতে চায়। এর মধ্যে তৃতীয় একটি পক্ষ আত্মপ্রকাশ করেছে। যা বাংলাদেশের সব কিছুর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বসেছে। এই তৃতীয় পক্ষ একান্ত ইংরেজি-ভক্ত, এরা ইউরো-মার্কিন ‘আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি’র অন্ধ অনুসারী বিশ্বব্যাক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি ইত্যাদিকে এরা দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন-সহযোগী বলে অভিহিত করেন এবং তাদের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তকে নিরঙ্কুশ আনুগত্যের সঙ্গে গ্রহণ করে নেন।

এনজিওপতি ও সিভিল সোসাইটি সংগঠনের বুদ্ধিজীবীরা এই ধারার অন্তর্গত। তাছাড়া আমলা, মিলিটারি আমলা, সাংবাদিক, ডক্টর, প্রফেসর, জাস্টিস, ব্যারিস্টার, বিজনেস এলিট অধিকাংশ এই ধারায় আছেন। বাংলাদেশে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল দ্রুত বেড়েছে এবং এখনো বাড়ছে। এগুলোর পাঠ্যসূচিতে বাংলাদেশ নেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মোটামুটি এই ধারায় চলার চেষ্টা করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সংস্কৃতির আধিপত্যশীল ধারা এটি। এই ধারার অনুসারীরা বিশ্বায়ন নিয়ে অত্যন্ত উৎসাহী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নানা ধারা-উপধারায় এতটাই বিভক্ত যে, তা জাতীয় ঐক্যের কিংবা জনগণের ঐক্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। এনজিওগুলো এই বিভক্তিকে বাড়িয়ে চলছে। কয়েকটি এনজিও মূল জাতির সঙ্গে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলার বিরোধী কর্মনীতি নিয়ে ভীষণভাবে সক্রিয়। নারীবাদী কর্মসূচি ও মৌলবাদবিরোধী কর্মসূচিও জনগণের ঐক্যের পরিপন্থি। এরা ধর্ম সম্পর্কে নানারকম উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার করে পরিস্থিতিকে অত্যন্ত জটিল ও সংকটাপন্ন করে তুলেছে। আমাদের দেশে জনজীবনের বৈচিত্র্য নিয়ে বলা হতো ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’। তাতে ‘বৈচিত্র্য’ এবং ‘ঐক্য’ দুটোতেই যথোচিত গুরুত্ব দেয়ার কথা ভাবা হতো এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় এবং সমাজে মানুষের তৈরি কৃত্তিম বৈষম্যগুলো দূর করার চেষ্টা করা হতো। সবকিছু যে ঠিক মতো করা হতো কিংবা পারা যেত, তা নয়; বিশ শতকে দীর্ঘ সময় ধরে বাংলা ভাষার দেশে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার রক্তাক্ত কাল গেছে। তারপরও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অপসারণ করা হয়েছে ব্রিটিশ শাসন এবং প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে মুক্ত করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, যদিও বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি সব দল- আজ রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এবং সমন্বয়ের মধ্যে সমাধান’- এই নীতির মধ্য দিয়ে জনগণের শক্তির প্রমাণ আমরা পেয়েছি; কিন্তু পরে এই নীতি আর রক্ষা করা হচ্ছে না- জনগণের ঐক্য আর রক্ষা পেল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হলো বিপন্ন। পরে ইউরো-মার্কিন আধিপত্য থেকে যে নীতি এদেশে কার্যকর করা হলো তা প্রাণী সংস্কৃতির বহুত্ববাদ বা পুরালিজম। জাতীয় সংস্কৃতি ও জাতীয় ঐক্যের ধারণাকে এর মাধ্যমে বাতিল করে দেয়া হলো। সংস্কৃতির বহুত্ববাদের তত্ত্ব দিয়ে জাতির ভেতরকার বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যকার বিরোধগুলোকে উস্কে দিয়ে জাতীয় ঐক্যকে ভেঙে দেয়া হলো।

আমাদের সংস্কৃতির ভিত্তি, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও সংস্কৃতি নিয়ে মতপার্থক্য থাকবে তা স্বাভাবিক। সবাই এক চিন্তা করবেন, তা ভাবা যায় না। কিন্তু বর্তমানে পূর্বোক্ত ধারাগুলোর মধ্যে যে দৃষ্টিভঙ্গি, যে চিন্তা ও আচরণ দেখা যাচ্ছে তার কোনোটির মধ্যেই সুস্থতা নেই, স্বাভাবিকতা নেই, সত্যনিষ্ঠাও নেই। যারা সততার সঙ্গে চিন্তা করবেন এবং সৎভাবে জীবনযাপনে প্রয়াসপর হবেন তাদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য জাতীয় সংস্কৃতি নিয়ে, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে মোহমুক্ত, পূর্বধারণামুক্ত স্বাধীন বিচারপ্রবণ মন নিয়ে গোটা ব্যাপারটাকে নতুনভাবে বিচার করা।

আমাদের ভুললে চলবে না, বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের আগেও, বখতিয়ার খিলজির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার আগেও, জনপ্রবাহ ছিল এবং জনগণের মধ্যে জৈন, বৌদ্ধ, শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যাদি নানা ধর্ম ছিল। তখনো একীভূত হিন্দু ধর্ম গড়ে উঠেনি। ওইসব ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়েই লোকে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছে। তুর্কি-পাঠান-মোগল শাসকদের সঙ্গে অল্প লোকই এদেশে এসেছে। এরা ভাগ্যান্বেষী হিসেবে এসেছে- ধর্ম প্রচারের জন্য আসেনি। সেকালে বাংলার মুসলমান সমাজ সাতশ বছর ধরে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আশরাফ-আতরাফে বিভক্ত ছিল। আশরাফদের সঙ্গে আতরাফদের, আতরাফদের সঙ্গে আশরাফদের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল না, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল না। বাংলাদেশের মুসলমান সমাজের ক্রমবিকাশ আছে- ভেতরে-বাইরে নানা পরিবর্তন আছে। ব্রিটিশপূর্ব আমলে, ব্রিটিশ আমলে এবং উত্তরকালে বৈষয়িক জীবন এবং মানসিক জীবন, শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-আচরণ এক ধরনের নয়। এতে কি কোনো সন্দেহ আছে যে, বখতিয়ার খিলজির আগের ইতিহাস বাদ দিয়ে আমাদের ইতিহাস অপূর্ণ? সেন রাজাদের কাল, পাল রাজাদের কাল, সেন ও পাল রাজাদের বাইরে অবস্থিত ছোট ছোট রাজ্য সেগুলোকে বাদ দিলে আমাদের ইতিহাস অপূর্ণ থাকে এবং তাতে উন্মেষপর্ব ও বিকাশপর্বের ইতিহাস সম্পূর্ণ বাদ পড়ে যায়।

পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, সাভার-ধামরাই-বিক্রমপুর, ময়নামতি-লালমাই-চান্দিনা-চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত, বৌদ্ধ যুগের যেসব প্রত্ন নিদর্শন আজও বিরাজ করছে সেগুলোকে কেন্দ্র করে যে ইতিহাস, যে সংস্কৃতি তাকে বাদ দিয়ে আমাদের ইতিহাস-সংস্কৃতি ঐতিহ্যের কথা ভাবা মারাত্মক ভুল। সেসব না ধরলে আমরা ছিন্নমূল হয়ে যাই। এটাও আমাদের বুঝতে হবে যে, আরব দেশের, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও ইসলামের আত্মপ্রকাশের আগে মানুষ ছিল, সেই মানুষরাই ইসলামে দীক্ষা নিয়ে-পূর্বপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছে এবং মুসলিম সমাজ গঠন করেছে। সেসব দেশের ইসলাম-পূর্বকালের সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে তাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে চিন্তা করলে ভুল করা হবে। ইসলামকে বুঝতে হলে তৎকালীন আরবের বাস্তবতাকে বুঝতে হবে। কুরআন, হাদিস সবই তৎকালীন আরব দেশে মক্কা-মদিনার প্রত্যক্ষ পটভূমিতে বোধগম্য। কুরআনের তাফসির, হাদিসের ভাষ্য তারই প্রমাণ দেয়। আরবের ইসলাম প্রচারকালের ইতিহাসকে সমন্বিত করতে হবে আবহমানকালের বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে এবং তারপর বাংলায় ইসলাম প্রচারের এবং বাঙালি মুসলমান সমাজের গড়ে ওঠার ও বিকাশের ইতিহাসকে হৃদয়াঙ্গম করতে হবে। বাংলা বাদ দিয়ে কেবল আরবের দিকে তাকিয়ে থাকলে ভুল করা হয়। ইতিহাসের জ্ঞান ছাড়া কোনো জ্ঞানই পূর্ণাঙ্গ হয় না। এ কথা বাংলার মুসলমান-সমাজ গড়ে ওঠাকে বোঝার প্রয়োজনেও বুঝতে হবে। ভবিষ্যৎকে নতুন করে গড়তে হলে, গতানুগতিক থেকে মুক্ত হতে হলে, অবশ্যই অতীত সম্পর্কের ধারণাকেও পুনর্গঠিত করতে হবে। অতীত সম্পর্কে পুরাতন ধারণায় বন্ধ থেকে গতানুগতিকই সম্ভব, উন্নতি সম্ভব নয়। যারা ভারতীয় সংস্কৃতির বিশেষ অনুরাগী তাদের এসব বুঝতে হবে, উগ্রতার পরিচয় দিলে ভুল করা হবে। বাংলাদেশের স্বতন্ত্র ইতিহাস ও স্বতন্ত্র জাতীয় সংস্কৃতিকে বুঝতে হবে এবং রূপ দিতে হবে। এর অন্যথা করলে সুফল হবে না। যারা ইউরো-মার্কিন সংস্কৃতির অন্ধ অনুসারী তাদেরও সাবধান হওয়া দরকার আছে। তাদের আচরণ লোকে পছন্দ করছে না। আমরা ইউরোপ-আমেরিকার দর্শন-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে জানব, বুঝব এবং আমাদের প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী সেগুলোকে গ্রহণ করব, আত্মস্থ করব। আধিপত্যবাদীরা তাদের আধিপত্যলিন্সা চরিতার্থ করার জন্য যা-কিছু আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয় তাই গ্রহণ করা আমাদের জন্য আত্মঘাতী। ইউরোপ-আমেরিকার দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস-তাদের কূটনীতি, গোয়েন্দানীতি, প্রচারনীতি, সুদের ব্যবসা এবং আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি থেকে আলাদা।

প্রসঙ্গত মোতাহের হোসেন চৌধুরীর একটি উক্তি মনে পড়ছে। ‘রেনেসাঁস গোড়ার কথা ও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন: ‘নজরুল ইসলাম যে হিন্দুর ঐতিহ্য নিয়ে লিখলেন, আর রবীন্দ্রনাথ যে মুসলিম ঐতিহ্য নিয়ে লিখলেন না, তার কারণ সোজা; হিন্দুর ঐতিহ্যে মুসলমান তথা নজরুলের উত্তরাধিকার রয়েছে; কিন্তু মুসলিম ঐতিহ্যে হিন্দুর তথা রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার নেই। প্রাণের যোগ নেই বলে বহিরাগত ধর্ম ও সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করা কষ্টসাধ্য; কিন্তু দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এক প্রকার জলবায়ুর মতোই সহজ এবং একে বোঝা কঠিন নয়, তা জানতে হয় না, সে নিজেই নিজেকে জানিয়ে যায়, আর আমরা জেনেও টের পাই না যে, জেনেছি। এই দিনের আলোর মতো সহজ সত্যকে যারা অস্বীকার করেন, মাটির বাঁধনকে যারা স্বীকার করতে চান না, শুকিয়ে মরা তাদের ভাগ্যলিপি।’

মোতাহের হোসেন চৌধুরী আরও লিখেছেন: ‘হিন্দুর উত্তরাধিকার যে মুসলমানেরও উত্তরাধিকার তার প্রমাণ, হিন্দুর অনেক কিছুই আমরা জানি, বুঝি ও উপভোগ করি...। এই জানার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে: ১. সব মুসলমান আরব কি ইরান-তুরান থেকে আসেনি। শতকরা অন্তত পঞ্চাশ জন হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছে। ২. বিদেশাগত বাকি পঞ্চাশ জনের প্রত্যেকে যে স্বদেশ থেকে পত্নী নিয়ে এসেছিলেন এমন মনে করা বাতুলতা। অন্তত বিশ জন দেশি পত্নী গ্রহণ করেছিলেন। ৩. হিন্দু ধর্ম উৎসবময়, আর উৎসব ছোঁয়চে। হিন্দুর নানা উৎসবের সংস্পর্শে এসে, বিশেষ করে যাত্রা, পাঁচালি, কবিগান ইত্যাদিতে যোগ দিয়ে মুসলমান বেমালুম হিন্দু ধর্মের অনেক কিছু জেনেছে ও পেয়েছে। ৪. কালচারের ব্যাপার হয়ে হিন্দু ধর্ম সাধারণত লাভ করেছে, আর তারই ফলে তা মুসলমানের মনে প্রবেশপথ খুঁজে পেয়েছে। সাহিত্য তথা আমাদের বস্তু হয়ে (কাব্য কাহিনীময় বলে) তা আমাদের হৃদয়ের দুয়ারে আঘাত করেছে আর আমরা বেদরদির মতো দ্বাররুদ্ধ করে থাকতে পারিনি। মুসলমান ধর্ম ও সাহিত্য তথা আনন্দের ব্যাপার হয়ে হিন্দুর অবচেতনে স্থান নিতে পারত; কিন্তু সে প্রচেষ্টা আজও বিশেষ হয়নি। আরবি ও ফারসি ভাষার সিন্দুক থেকে মাতৃভাষার সূর্যালোকে ইসলামকে মুক্তি না দিলে তা সম্ভব হবে না। সে জন্য ইসলামপ্রীতির পাশাপাশি স্বদেশপ্রীতিও প্রয়োজন। কেননা রুগী-প্রীতি ব্যস্ত্রীতাঃ চিকিৎসকের স্বার্থকতা অসম্ভব। কিন্তু যেরূপ আরবি-ফারসি মিশ্রিত রচনার জন্য উৎসাহ দেয়া হচ্ছে, তাতে সে ভরসা হয় না। মনে হয়, রচনাগুলো কেবলই আরবি, ফারসি জানা মুসলমান পাঠকদের জন্য লেখা হচ্ছে, সাধারণ বাঙালি পাঠকদের জন্য নয়।

মোতাহের হোসেন চৌধুরী আরও লিখেছেন: ‘এইসব কারণে হিন্দুর উত্তরাধিকার অনেকটা মুসলমানেরও উত্তরাধিকার। অসূয়া-পরবশ হয়ে মুসলমান জোর করে তা অস্বীকার করতে পারে; কিন্তু তাহলেই তা মিথ্যা হয়ে যাবে না। আজও বাঙালি মুসলমান খাঁটি মুসলমান হয়নি- এই দুঃখের ভিতরেই আমাদের কথার সত্যতা জাজ্বল্যমান।’

এ লেখা সম্ভবত ব্রিটিশ শাসনকালের। তারপর অনেক কিছুই বদলে গেছে। পুরাতন সমস্যা অতীত হয়েছে, নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। আজও হিন্দুর সংস্কৃতির প্রতি এ দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারি। তা ছাড়া বাঙালি হিন্দুর সংস্কৃতিতে বিভিন্ন যুগে যা কিছু ভালো আছে তার স্পর্শে বাঙালি মুসলমানের মনমানসিকতাকে উন্নত করবে। মোতাহের হোসেন চৈাধুরী ‘শতকরা অন্তত পঞ্চাশ জন হিন্দু থেকে মুসলমান’ হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। এ অনুমান ঠিক নয়। আসলে বৌদ্ধ, শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যাদি ধর্ম থেকে মুসলমান হয়েছে- আরও অনেক বেশি, হয়তো শতকরা নব্বই ভাগেরও বেশি।

মানবজাতির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলে আমরা দেখতে পাই কালো মানুষ (প্রধানত আফ্রিকার মানুষ), হলদে মানুষ (প্রধানত জাপান, চীন, কোরিয়া, ইন্দোচীনের দেশসমূহের মানুষ), সাদা মানুষ (প্রধানত ইউরোপের মানুষ)- এই তিন বৃহৎ মানবগোষ্ঠীর লোকদের নানারকম মিলন-মিশ্রণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দেশে নানারকম জনগোষ্ঠী বা এথনিক গ্রুপ। বাংলাদেশের মানুষ পূর্বোক্ত বৃহৎ মানবগোষ্ঠীগুলোর কোনোটির মধ্যেই পড়ে না। স্মরণাতীতকাল থেকে এদেশে দুটি মানবগোষ্ঠীর লোক বসবাস করছে কালো মানুষ ও হলদে মানুষ। রামায়ণ-মহাভারতের নিষাদ (কালো মানুষ) ও কিরাত (হলদে মানুষ) জাতির কথা উল্লেখ আছে। তা ছাড়া সাদা মানুষদের সামান্য মিশ্রণ আছে- যাকে বলা যায় সমুদ্রে বারিবিন্দুবৎ। বাংলাদেশের জনগণের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য যারা সন্ধান করেছেন তারা সবাই এই জনগোষ্ঠীকে মিশ্র বা সঙ্কর বলে অভিহিত করেছেন। এই মিশ্রতা বা সাঙ্কর্য হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবার মধ্যেই দৃষ্ট হয়। এই মিশ্রতা বা সাঙ্কর্য নগণ্য উপজাতীয়দের মধ্যে। হিন্দু সমাজে জাতিভেদ প্রথা ছিল এবং আছে। মুসলমান সমাজে আশরাফ-আতরাফ ব্যবধান ছিল - যদিও তা ধর্মের দ্বারা অনুমোদিত নয়। এসবের প্রভাব মানুষের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পাওয়া যায় না। এর কারণ, স্মরণাতীতকাল থেকে যে রক্তসাঙ্কর্য ঘটে আসছে তাতে কেউই আর কোনো ধরনের রক্ত বিশুদ্ধতা দাবি করতে পারে না। নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে বাংলাদেশের হিন্দুতে ও মুসলমানে কোনো পার্থক্য পাওয়া যায় না।

এসব কিছুর বিবেচনাই আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বিবেচনার সময়ে আমাদের সামনে আসে। আমরা এসবের কোনোটিকে বিবেচনা থেকে বাদ দিতে পারি না। গোঁড়ামি ও জেদাজেদি ভালো নয়। নীতির সঙ্গে নমনীয়তা দরকার। প্রকৃতপক্ষে ঐতিহাসিক ঘটনাবলি যেভাবে ঘটেছে তা বিবেচনা করেই আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার স্থির করতে হবে।

আবুল কাসেম ফজলুল হক: চিন্তাবিদ ও সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ