এই মুহূর্তে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বেশি জরুরি
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) জন্য এটি ছিল দ্বিতীয় এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে প্রণীত প্রথম মুদ্রানীতি। বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই প্রস্তাবিত মুদ্রানীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। বর্তমান বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রবণতাকালে কেমন মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয় তা নিয়ে সবারই আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। প্রায় তিন বছর ধরে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে।
করোনা-পরবর্তী সময়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন উত্তরণ পর্যায়ে ছিল ঠিক তখনই শুরু হয় ইউক্রেন যুদ্ধ। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী অর্থনীতিতেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রবণতা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে দেশটির মূল্যস্ফীতির বিগত ৪০ বছরের রেকর্ড অতিক্রম করে ৯ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফেড) একাধিকবার পলিসি রেট বৃদ্ধি এবং অন্যান্য নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বিশ্বের অন্তত ৭৭টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশ এর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট এক সময় ছিল ৫ শতাংশ। বর্তমানে তা ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে; কিন্তু তারপরও উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আসার কোনো সুস্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট বারবার বৃদ্ধি করলেও ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার কিছুদিন আগ পর্যন্তও ৯ শতাংশে নির্দিষ্ট করে রেখেছিল। ফলে পলিসি রেট বৃদ্ধির মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে প্রচেষ্টা তা ফলপ্রসূ হয়নি। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ পলিসি রেট ১০ শতাংশে উন্নীত করে। এই সঙ্গে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করা হয়। ফলে উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ আগের তুলনায় ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ অন্যদিকে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৫/১৬ শতাংশ অতিক্রম করে গেছে। উদ্যোক্তা এবং সাধারণ ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা অনেকটাই কমে গেছে। এতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বন্ধ্যত্ব সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আহরিত হয়েছে ১০ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। এই সময়ে বিদেশে বিনিয়োগ এসেছে ৯৬ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার। আর বিদেশি উদ্যোক্তারা ৮৬ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ফলে নিট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। একই সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৬ শতাংশ। কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিও কমেছে ব্যাপক হারে। এসব পরিসংখ্যান এটাই প্রমাণ করে যে দেশে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ নেই। ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। আর আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪১৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। বর্তমানে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন।
অর্থনীতির এই বাস্তবতায় প্রণীত মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক হবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাস্তবতাকে মাথায় রেখেছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই মুহূর্তে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনাটাই জরুরি। এই বাস্তবতায় আমি এই বক্তব্য গ্রহণ করতে রাজি আছি যে, এই মুহূর্তে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা বেশি জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট বাড়িয়েছে; কিন্তু শুধু ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানোর মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এটা আমার কাছে তেমন একটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। সুদের হার বাড়ালে ব্যক্তি খাতে ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি পাবে। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ আগের তুলনায় ব্যয়বহুল হবে। উদ্যোক্তা আগের মতো ঋণ গ্রহণ করতে পারবে না। অর্থাৎ বিনিয়োগে স্থবিরতা নেমে আসবে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হলে উৎপাদন হ্রাস পাবে। কর্মসংস্থানের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। বেকার সমস্যা বেড়ে যাবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে দেশের দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম বিঘ্নিত হবে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো হলে ঋণের চাহিদা কমবে কিন্তু ঋণ সরবরাহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
আমাদের দেশে যারা বিনিয়োগ করেন তাদের বেশিরভাগই অর্থায়নের জন্য ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে থাকেন। কারণ তাদের সামনে তহবিল সংগ্রহের কোনো বিকল্প উৎস এখনো গড়ে উঠেনি। দেশের শেয়ারবাজার সেভাবে বিকশিত হয়নি। ফলে উদ্যোক্তাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকে না। অথচ উন্নত দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য শেয়ারবাজারের ওপর নির্ভর করা হয়। ব্যাংকিং সেক্টর থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গ্রহণ করা হলে সেখানে নির্ধারিত সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। হয়তো একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৬ মাস সময় নির্ধারিত আছে; কিন্তু সেই প্রকল্প হয়তো বাস্তবায়ন করতে এক থেকে দেড় বছর সময় লেগে গেল। ফলে প্রকল্পটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করার আগেই তার ওপর বিরাট অঙ্কের ঋণের বোঝা চেপে বসে। প্রকল্পটি যাত্রা শুরু করে বিরাট ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে; কিন্তু শেয়ারবাজার থেকে অর্থায়ন সংগ্রহ করা হলে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরির কোনো সুযোগ থাকে না। বিভিন্ন সময় শেয়ারবাজারের উন্নয়নের জন্য নানা কথা বলা হলেও এখনো শেয়ারবাজার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। দেশে যেসব বড় বড় শিল্পকারখানা আছে তাদের বেশিরভাগই এখনো শেয়ারবাজারের বাইরে রয়ে গেছে। উদ্যোক্তারা মনে করেন, শেয়ারবাজারে গেলে প্রতিষ্ঠানের ওপর তাদের পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষুণ্ন হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন আইনকানুন মেনে চলতে হবে। তারা এ ধরনের আইনি বাধ্যবাধকতায় যেতে রাজি নন।
দেশের বিভিন্ন খাতে যেসব শিল্প প্রকল্প আছে তাদের উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানোর জন্য দাবি জানিয়ে আসছেন। কারণ তারা মনে করছেন, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের কারণে তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এতে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্য অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেল ইত্যাদি আবশ্যিক উৎপাদন উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির কারণে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উৎপাদন কার্যক্রম চালাতে পারছে না। বিভিন্ন স্থানে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে। শিল্প খাতসহ বিভিন্ন উৎপাদন সেক্টর যদি স্বাভাবিকভাবে তাদের কার্যক্রম চালাতে না পারে তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, আগামী ২/৩ মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭/৮ শতাংশে নেমে আসবে; কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেলে শিল্প মালিকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বাড়াতে বাধ্য হবেন। এতে স্থানীয়ভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হতে পারে। এমনকি বাজারে রপ্তানি বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোক্তারা তুলনামূলক কম মূল্যে গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য ক্রয় করতে চান। বাংলাদেশের পণ্যের মূল্য যদি বৃদ্ধি পায় তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারের ভোক্তারা অন্য দেশের পণ্য ক্রয়ে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন চীন, ব্রাজিল এবং কানাডা থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর বর্ধিত হারে শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য আরও বেশি হারে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে; কিন্তু আমরা যদি পণ্যের গুণগতমান নিশ্চিত করার পাশাপাশি তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে না পারি তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অধিক হারে পণ্য রপ্তানির সুযোগ কাজে লাগানো সম্ভব নাও হতে পারে। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেয়া জিএসপি সুবিধা স্থগিত রেখেছে। নানাভাবে চেষ্টা করেও বিগত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করতে পারেনি। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন, ব্রাজিল ও কানাডার রপ্তানি পণ্যের ওপর বর্ধিত হারে শুল্কারোপ করলেই দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে এটা প্রত্যাশা করা যায় না। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যেতে পারে। কাজেই তারা আগের তুলনায় পণ্য ক্রয় কমিয়ে দিতে পারে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে এনে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে সহনীয় করে তোলা। সাধারণ মানুষ আজ বড়ই অসহায় অবস্থায় দিন যাপন করছে। যদিও এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছে; কিন্তু তা থেকে উত্তরণের জন্য তাদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু মুদ্রানীতির মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতি রোধ করা যাবে না- এর পাশাপাশি অন্যান্য উপযোগী এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে পরিবহন সেক্টরের ব্যাপক চাঁদাবাজি এবং বাজারে তৎপর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিটি সেক্টরের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা।
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে