বাংলাদেশে বজ্রপাতের ভয়াবহতা ও রক্ষার উপায়
প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের পর বৃষ্টি প্রশান্তি না এনে বজ্রপাতের আতঙ্ক নিয়ে এসেছে। বৃষ্টি আর ঝড় হলেই বজ্রপাতে একাধিক ব্যক্তির মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। গত ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের ছয়টি উপজেলায় এক দিনে বজ্রপাতে ৯ জন প্রাণ হারান। এরপর ২৭ এপ্রিল এক দিনে ছয় জেলায় আটজন বজ্রপাতের ফলে প্রাণ হারিয়েছেন। গত ১৮ মে এক দিনেই দেশের তিন জেলায় বজ্রপাতে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। ওই দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাতে নরসিংদীতে চারজন, টাঙ্গাইলে দুইজন ও গাজীপুরে একজনের মৃত্যু হয়। এর আগে ২০২২ সালের ঠিক একই দিন অর্থাৎ ১৮ মে এক দিনেই সারা দেশে বজ্রপাতে মারা যায় ১৯ জন। বজ্রপাতের এমন ভয়াবহতা আমাদের দেখতে হচ্ছে প্রতি বছরই; কিন্তু কেন বেড়ে গেল বজ্রপাতের প্রবণতা? এর থেকে রক্ষার উপায়ই বা কী?
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে বজ্রপাত। এর কারণে কয়েক বছরে প্রাণহানি বড়েছে উদ্বেগজনক হারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির দায় সর্বাধিক। তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের আশঙ্কা ১০ শতাংশ বাড়ে। বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তাপমাত্রা স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রার চেয়ে বেশি থাকে। এ কারণে এ সময় বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটে। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে দশমিক ৭৪ শতাংশ তাপমাত্রা বেড়েছে। তাদের মতে, বাংলাদেশে বজ্রপাতে যারা মারা যাচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই মাঠে বা নদীতে কাজ করে। বাংলাদেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে গড়ে ১৬৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়; কিন্তু বজ্রপাত প্রতিরোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। আর প্রকল্পের নামে অর্থের অপচয় হলেও বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।
ডিজাস্টার ফোরাম নামে একটি সংগঠনের গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে ১ হাজারের কিছু বেশি মানুষের মৃত্যু হলেও ২০১০ থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ১০ বছরে ২ হাজার ৭৭৪ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শিশু ৫২৬, নারী ৪০১ ও পুরুষ ১ হাজার ৮৪৭ জন। গত ১০ বছরের মধ্যে ২০১০ সালে সবচেয়ে কম ১২৩ জন আর ২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি ৩৫০ জন নিহত হয়। বাকি বছরগুলোতে ২০০ থেকে ৩০০-এর মধ্যে এই সংখ্যা ওঠানামা করে। ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মারা গেছে ২৯৬ জন। ২০১৮ সালে নিহতের ঘটনা ২৭৭টি। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ২৮১, ২০২০ সালে ২৭৩, ২০২১ সালে ২৯০, ২০২২ সালে ৩২১ ও ২০২৩ সালে ৩০৪ জনের মৃত্যু হয় বজ্রপাতে। বজ্রপাতের ভয়াবহতা ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় ২০১৬ সালের ১৭ মে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার।
বজ্রপাত আসলে কী ও কেন বেড়েছে?
আকাশে বিজলি চমকালে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় আর আমরা সাধারণত যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি, তা আলাদা কিছুই নয়। যখন আকাশে অনেক মেঘ করে তখন জলীয়বাষ্পগুলো এত ঠান্ডা হয়ে যায় যে, তা বরফের আকার ধারণ করে এবং এগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়। এসব সংঘর্ষের ফলে ইলেকট্রিক চার্জের উৎপত্তি হয়। এভাবে চলতে চলতে একসময় মেঘের ওই পুরো এলাকাটুকুই চার্জে পূর্ণ হয়ে যায়। মেঘের ওপরে পজিটিভ চার্জ আর নিচে সৃষ্টি হয় নেগেটিভ চার্জ। এরা ঘুরতে ঘুরতে পরস্পরের আকর্ষণে মিলিত হলেই বিকট শব্দে বিদ্যুতের চোখ অন্ধকার করা ঝলকানিসহ বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। একটি সাধারণ বজ্রপাতের ফ্ল্যাশ প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ভোল্ট এবং প্রায় ৩০ হাজার এম্পিয়ারের বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কালো মেঘের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ বৃষ্টি ও বজ্রপাতের পরিমাণও বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তন, লম্বা গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, আকাশে কালো মেঘের পরিমাণ ও মেঘে মেঘে ঘর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, যেখানে-সেখানে মোবাইল ফোনের টাওয়ার বসানো ও তাপমাত্রা বৃদ্ধিও বজ্রপাতের উল্লেখযোগ্য কারণ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে, প্রাকৃতিক কারণেই বজ্রপাত হয়। তবে গত এক দশকে বাংলাদেশে বজ্রপাত প্রায় ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশে বজ্রপাতের শিকার কারা বেশি:
বাংলাদেশে বজ্রপাতে যারা মারা যান, তাদের ৭০ ভাগই কৃষক বা যারা খোলা মাঠে কাজ করেন। এ ছাড়া বাড়ি ফেরার পথে ১৪ শতাংশ এবং গোসল ও মাছ ধরার সময় ১৩ শতাংশের বজ্রপাতের ফলে মৃত্যু হয়েছে। ফিনল্যান্ডভিত্তিক বজ্রপাতবিষয়ক গবেষণাসংস্থা ভাইসালার তথ্য এটি। বিশ্লেষকদের মতে, শহরে বেশিরভাগ ভবনে বজ্রনিরোধক দণ্ড থাকায় বজ্রপাতে মৃত্যু তেমন হয় না; কিন্তু গ্রামে তা না থাকা ও বড় গাছপালা কমে গিয়ে খোলা মাঠের কারণে সেখানে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। তাদের কথা দেশের হাওর এলাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। কারণ সেখানকার বেশিরভাগ ফসলি জমিতে বড় কোনো গাছ নেই। বজ্রপাতের ধর্ম হচ্ছে, তা মাটিতে আঘাত হানার আগে সবচেয়ে উঁচু যে জায়গাটি পায় সেখানে গিয়ে পড়ে। বৃক্ষহীন হাওর এলাকায় কৃষকের শরীরই মাটির চেয়ে উঁচু থাকে। তাই বজ্রপাতের সময় মাঠে বা খোলা জায়গায় যেখানে উঁচু কোনো গাছ নেই বা বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা নেই সেখানে যারা থাকেন তারা শিকার হন। হাওর অঞ্চলের মাঠে আগেও তেমন গাছ ছিল না। এখন অন্যান্য এলাকার গাছও কেটে ফেলা হয়েছে। ফলে মাঠে বা খোলা জায়গায় যেসব মানুষ থাকেন, বজ্রপাতের এক কিলোমিটারের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিবাহী উঁচু জিনিস হিসেবে সেই মানুষকেই পায়। মানুষ না থাকলে মাঠের গবাদি পশু। ফলে মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশুও মারা যায়।
বজ্রপাত থেকে যেভাবে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে:
বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে বেশ কিছু করণীয় বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে, বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত সব যন্ত্রপাতি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতরে থাকলে গাড়ি নিয়ে কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। খোলা ও উঁচু জায়গায় থাকা যাবে না। বজ্রপাতের সময় পুকুর বা জলাবদ্ধ স্থানে থাকা খুবই বিপজ্জনক। কারণ পানি খুব ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহী। কয়েকজন মিলে খোলা কোনো স্থানে থাকলে প্রত্যেককে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে সরে যেতে হবে। বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা বড় মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে যেতে হবে। উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের খুঁটির কাছে আশ্রয় না নেওয়া। জানালা থেকে দূরে থাকা এবং জানালা বন্ধ রেখে ঘরের ভেতর থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় চামড়ার ভেজা জুতা বা খালি পায়ে থাকা খুবই বিপজ্জনক। এ সময় বিদ্যুৎ অপরিবাহী রাবারের জুতা সবচেয়ে নিরাপদ।
বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকতে হলে বাড়িতে আর্থিং সংযুক্ত রড স্থাপন করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ নিতে হবে। ভুলভাবে স্থাপিত রড বজ্রপাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিতে পারে। বজ্রপাতে আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মতো করেই চিকিৎসা করতে হবে। প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসককে ডাকতে হবে বা হাসপাতালে নিতে হবে। একই সঙ্গে এ সময় আহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃৎস্পন্দন ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এ বিষয়ে প্রাথমিক চিকিৎসায় সবারই প্রশিক্ষণ থাকা দরকার। ধাতব বস্তু, যেমন- ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা উচিত নয়। সবচেয়ে ভালো পাকা দালানের নিচে আশ্রয় নেওয়া। কোনো বাড়িতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে অবস্থান করতে হবে।
বজ্রপাতের উপক্রম হলে কানে আঙুল দিয়ে নিচু হয়ে বসে চোখ বন্ধ রাখতে হবে; কিন্তু মাটিতে শুয়ে পড়া যাবে না। তবে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে হলে জনসচেতনতা বাড়ানো। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে দেশের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ব্যাপকহারে তালগাছ লাগানো দরকার। কারণ অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, বজ্রপাত সরাসরি ভূমিতে আঘাত হানার আগেই উঁচু গাছ বিশেষ করে তালগাছ একে আটকে দিতে পারে। তবে তালগাছ লাগানো এবং গাছ উঁচু হওয়া পর্যন্ত কয়েক দশক লেগে যাবে। এ ছাড়া এ গাছটি সবরকম মাটিতে টিকে থাকতে পারে না। তাই জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে উন্মুক্ত স্থানগুলোতে বজ্রনিরোধক (ফ্রাঙ্কলিনস লাইটনিং রড) যুক্ত উঁচু টাওয়ার স্থাপন করা যেতে পারে। আর আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখলেই সতর্ক হওয়া।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে