তথ্য নির্ভুলতায় বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ ও পরিপ্রেক্ষিত
তথ্য যাচাই আর নীতি নির্ধারণে আইবিএম প্রোগ্রামার জর্জ ফুয়েশেলের কথাটা প্রণিধানযোগ্য- ‘গার্বেজ ইন, গার্বেজ আউট’। মানে যত আবর্জনা বা ভুল তথ্য অন্তর্জ্বালে ভরা হবে, তত ভুল তথ্যই সমাজে ছড়ানো হবে। তথ্য বিশ্লেষণে আর নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মিথ্যা ও অবিশ্বস্ত তথ্য বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায়। এতে যে খারাপ নীতিগুলো প্রবর্তিত হয়, তার প্রতিক্রিয়া হতে পারে মারাত্মক। সঠিক তথ্য প্রকাশ করার ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো কঠিন সিস্টেম তৈরি করেছে; কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। সঠিক তথ্য যাচাই-বাছাই না করেই এখানে তথ্য প্রকাশ করে দেয়ার প্রবণতা আছে। তথ্য সংগ্রহের একেবারে শুরু থেকেই এটা চলছে। ফলে এই গরমিল জাতীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণেও প্রভাব ফেলেছে। এই অসংগতির প্রভাব পড়েছে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা থেকে শিক্ষাগত নীতি পর্যন্ত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। আন্তর্জাতিক মানের পরিসংখ্যান তৈরি করার দায়িত্ব এই জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থার ওপর বর্তায়। অসংগতি নিয়ে যে সাম্প্রতিক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষ করে রপ্তানি পরিসংখ্যান নিয়ে, বিবিএস সত্যিই মানসম্পন্ন পরিসংখ্যান তৈরি করতে সক্ষম কি না, এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ সব অসংগতি পরিসংখ্যানের ওপর আস্থা কমিয়ে দেয়। অথচ জ্ঞাত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এবং সঠিক নীতি প্রণয়ের জন্য পরিসংখ্যানের ওপর আস্থা রাখা খুব জরুরি।
মূলেই যদি ভুল হয়ে থাকে, নীতি গ্রহণেও ভুল হবে স্বাভাবিক। এটা আরও দুর্দশা ডেকে আনবে। তাও আরও সময়োপযোগী, গুণমান ও নির্ভুলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে সরকার পরিসংখ্যান উন্নয়নের জন্য জাতীয় কৌশল (এনএসডিএস) জারি করে। তারপরও দীর্ঘস্থায়ী পদ্ধতিগত দুর্বলতা বিবিএসকে ব্যর্থ করে চলেছে। পদ্ধতিগত দুর্বলতার সঙ্গে আছে নীতিনির্ধারকদের ভয়ংকর অসচেতনতা। নির্ভুল তথ্যের জন্য পদ্ধতিগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদেরও ব্যাপক ভূমিকা দরকার। তা ছাড়া, তথ্য সংগ্রহের জন্য পুরোনো পদ্ধতি বাদ দিয়ে আধুনিক, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করা দরকার। এটারও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ কারণে বিবিএস আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে পারছে না, যার ফলে উন্নতি তো দূরের কথা, তথ্য গুণমান নির্ধারণে এর আরও অবনতি হয়, নির্ভরযোগ্যতা কমায়।
উপরোক্ত দুর্বলতাগুলো ছাড়াও আওয়ামী লীগ আমলে পরিসংখ্যান নানা কারসাজির শিকার হয়। বিশেষ করে ২০১৪ সালে আ হ ম মুস্তফা কামাল পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর। সমালোচকরা বলেছেন, মোস্তফা কামাল মৌলিক অর্থনৈতিক সূচকেই গোলমাল করেছেন। যেমন উন্নয়নের জোয়ার দেখাতে গিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেশি করে দেখিয়েছেন এবং মুদ্রাস্ফীতির হার কম করে দেখিয়েছেন। এ কারণে ২০১৫ এবং ২০২৯ সালে প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান ৩ দশমিক ৫ শতাংশ স্ফীত হয়েছিল। এই হেরফেরের ফলে বিশ্বব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে বিবিএস তথ্যের ব্যবধান দেখা দিয়েছে। তথ্যের ওপর মানুষের নির্ভরযোগ্যতা কেন কমে যাচ্ছে, এটা তা স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যানগত সক্ষমতা সূচক ২০১৪ সালে ছিল ৮০ ভাগ, ২০২০ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৬০ ভাগে। এর কারণটা বোঝা যায় ওই তথ্য কারসাজির অবস্থা দেখেই। বিবিএসের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের অপসারণের অভিযোগও রয়েছে মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে। এর কারণ আর কিছু নয়, ওইসব কর্মকর্তা সরকারি এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাননি। তথ্যের এই বিকৃতির ফলে যেমন বিভ্রান্তিমূলক নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন উদ্যোগকেও বাধাগ্রস্ত করেছে।
সুশাসন ও কার্যকর নীতিমালার জন্য সঠিক জাতীয় পরিসংখ্যান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক তথ্যের ওপর মানুষের আস্থা বাড়ানোর জন্য বড় কিছু সংস্কার প্রয়োজন। এর জন্য জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর সঙ্গে একযোগে কাজ করতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কিছু প্রস্তাবনা নিচে হাজির করা হলো:
১. জাতীয় পরিসংখ্যান ও সংস্কার কমিটি গঠন
প্রতিটি সরকারি মন্ত্রণালয়, ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে গঠিত একটি কমিশন গঠন করতে হবে। তথ্য ব্যবহারকারী এবং উৎপাদকদের মধ্যে সহযোগিতার সুবিধা দেবে এই কমিশন, যাতে তথ্যের সঠিকতা এবং অখণ্ডতার গুণগত ও উন্নত মান নিশ্চিত করা যায়।
২. সেক্টরভিত্তিক তথ্য মূল্যায়ন প্রয়োজন
তথ্য সংরক্ষণের জন্য প্রতিটি সেক্টরের আলাদা গুরুত্ব আছে। স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং শিক্ষা ভিন্ন ভিন্ন সেক্টর। এগুলোর মধ্যে মিল যেমন রয়েছে, রয়েছে প্রচুর অমিলও, বিশাল ব্যবধান। তাই সঠিক বিশ্লেষণের জন্য এই ফাঁকগুলো পূরণ করা জরুরি। প্রমাণভিত্তিক এবং প্রতিটি পৃথক সেক্টর মাথায় নিয়ে সংস্কার করতে হবে।
৩. জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর পর্যায়ক্রমিক আপডেট জরুরি
সময়ের সঙ্গে তথ্য বদলায় এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেইসঙ্গে পরিসংখ্যানের চাহিদাও বদলায়। তাই তথ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য করার জন্য এনএসডিএসকে অবশ্যই নিয়মিত আপডেট করতে হবে। এই কৌশলটি তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতিগুলো আধুনিকীকরণ করবে। নতুন তথ্য সংগ্রহকে অগ্রাধিকার দিবে। সময়ের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিবে। আরও দায়িত্বশীল নীতিনির্ধারণের জন্য তাৎক্ষণিক সময়কে সংহত করবে।
৪. কেন্দ্রীভূত জাতীয় ডাটাবেস স্থাপন
আমাদের দেশে দেখা যায়, তথ্যগুলো বিভিন্ন সেক্টরে বিভিক্ত; কিন্তু সময় এসেছে একটি একক, একীভূত জাতীয় তথ্যভান্ডার সংরক্ষণের। এতে বিভিন্ন সংস্থার সমস্ত তথ্য একসঙ্গে সংরক্ষিত থাকবে। এতে করে অসঙ্গতিগুলো দ্রুত চিহ্নিত করা যাবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তথ্যগুলোর সামঞ্জস্য রক্ষা করা যাবে। ত্রুটি কমানো যাবে। ফলে যেমন দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে, তেমনি তা নির্ভুলও হবে।
৫. তথ্য এজেন্সিগুলোর সক্ষমতা উন্নত করা
মানসম্পন্ন তথ্য পাওয়ার পূর্বশর্ত জাতীয় এবং আঞ্চলিক পরিসংখ্যান সংস্থাগুলোর মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ। এ জন্য ডিজিটাল সরঞ্জাম যেমন বাড়াতে হবে, সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করার জন্য দক্ষ জনশক্তিও বাড়াতে হবে। লোকবল ও সরঞ্জাম বাড়লে দ্রুত তথ্য সংগ্রহ ও সজ্জিত করা যাবে।
৬. সব সেক্টরে তথ্যের ঐকতান প্রতিষ্ঠা
একেক সেক্টরে তথ্যের সংজ্ঞা, শ্রেণিবিন্যাস একেকরকম । এই পদ্ধতি সব সেক্টরে নিশ্চিত হলে একটা ঐকতান প্রতিষ্ঠা হবে, যা তথ্যের সামঞ্জস্যেরও নিশ্চিয়তা দিবে। ফলে বিভিন্ন সেক্টরের তথ্যগুলো একে অপরের সঙ্গে তুলনা করতেও সক্ষম হবে। এটা হলে তথ্যগুলো যেমন সমন্বিত হবে তেমনি নীতিগত সিদ্ধান্তও সহজ হবে।
৭. বেসরকারি সংস্থা এবং সুশীল সমাজকে জড়িত করুন
জাতীয় তথ্য সংরক্ষণ কেবল সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতেই ন্যস্ত। এতে অনেক সময়ই গোলমাল ঘটে এবং জনগণের আস্থার অভাব হয়। তাই তথ্য সংরক্ষণ ও বৈধকরণে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে যুক্ত করা যেতে পারে। তা জাতীয় তথ্য সংরক্ষণ ও প্রবাহকে আরও বিস্তৃত করবে। বেসরকারি খাত এবং নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ শুধু যে তথ্যবিস্তৃতির পরিধি বাড়াবে তা না, এর ভেতরের ফাঁকগুলো শনাক্ত করতে ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যবস্থায় যে গভীর সমস্যা নিহিত, তার সমাধান করতে হলে প্রথমে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে, তারপর সঠিক নীতি-নির্ধারণ প্রণয়ন করতে হবে। তার জন্যও নির্ভরযোগ্য তথ্য অত্যাবশ্যক। ‘আবর্জনা ঢুকালে, আবর্জনাই বেরোবে’ এই নীতি দীর্ঘকাল ধরে তথ্যভান্ডারকে দূষিত করেছে, যার ফলে সম্পদের অপচয় হয়েছে। বিপথগামী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এবং উন্নয়নের সুযোগও হাত ছাড়া হয়েছে। একটি জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্কার কমিশন প্রতিষ্ঠা করে তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি আধুনিকীকরণ করতে হবে। বিভিন্ন সেক্টরের মধ্যে আন্তঃসহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে। বাংলাদেশ এখন তথ্যভান্ডারের গুণমাণ বৃদ্ধি করতে তৎপরত। বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে আগ্রহী। তাই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে শক্তিশালী করে এবং এটিকে আন্তর্জাতিক মানের স্তরে উন্নত করতে হবে। একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই জাতীয় পরিসংখ্যানের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে সুশাসন নিশ্চিত করে একমাত্র সঠিক তথ্য। সঠিক তথ্য ছাড়া টেকসই উন্নয়নও হয় না। ব্যাপক সংস্কার ও পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার পরিসংখ্যানগত সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারে।
ওবেদুর রশিদ বিন সাক্রাত কাদেরী: ব্যাংকার এবং ডেটা সায়েন্সে উৎসাহী
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে