অলিম্পিকে নারী নেতৃত্বের সূর্যোদয়
পঞ্চ বৃত্তের ইন্দ্রজাল অলিম্পিক। চার অক্ষরের আবেদনময়ী শব্দটি মানবসমাজকে চুম্বকের মতো টানে। অলিম্পিকও জীবনের উৎসব। গ্রিক সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার। আধুনিকতার ভেলায় ঐতিহ্যের সৌন্দর্য। আধুনিক অলিম্পিকের জন্মলগ্নে ঘোষিত হয়েছে এই সৌন্দর্যে স্থান হবে না নারী-পুরুষ ভেদাভেদ বৈষম্য, অসমতা এবং জাতিগত ভেদাভেদ। অলিম্পিকের দর্শন হলো মানুষের মর্যাদা এবং মানবতার পক্ষে জয়গান। বলা বাহুল্য খেলাধুলাই অলিম্পিকের মুখ্য বিষয়। তবে অলিম্পিকের উদ্দেশ্য লক্ষ্য শিক্ষা, আদর্শ ও নীতির গুরুত্বও অপরিসীম। অলিম্পিকে এক দিকে আছে নীতির মহিমা আর অন্যদিকে গতির কাব্য। শক্তিশৈলী বীরপনারও। আসল বিষয়টি হলো অলিম্পিক মানবজাতির কল্যাণ ও প্রগতির জন্য। অলিম্পিকের সবকিছু তো বিশ্ব ঘিরে। আধুনিক দুনিয়ায় অলিম্পিক সবচেয়ে প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক আন্দোলন।
অলিম্পিকের আবেদনময়ী লক্ষ্য হলো বিশ্বের সব নারী-পুরুষকে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে সম্পৃক্ত করে বৈষম্যহীন একতাবদ্ধ পৃথিবী প্রতিষ্ঠার বাস্তবায়ন। অলিম্পিক বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে বিশাল অপরিমেয় শক্তি। ক্রীড়াচর্চাকে ঘিরে মানুষের আবেগ, প্রাণের টান এটি অনেক বড় শক্তি। ক্রীড়াজগতের এই শক্তিকে সমাজ পরিবর্তনের কাজে লাগানো সম্ভব, এটি প্রথমে বলেছেন আধুনিক অলিম্পিকের জনক মানবদরদী, শিক্ষাব্রতী পিয়ের দ্য কুবারতিন। তিনি বলেছেন, এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সম্মিলিত অংশীদারত্বের কথা। মানবসমাজে সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন চাইলে শুধু পুরুষ নয় নারীদেরও অংশগ্রহণ জরুরি।
অলিম্পিক জনক এ উদ্দেশ্যে ‘রোড ম্যাপ’ও দিয়েছেন। ২৩ জুন কংগ্রেসে ব্যারন পিয়ের দ্য কুবারতিন তার ঐতিহাসিক ঘোষণায় বলেছেন ‘অন্য অপরাহ্নে বিদ্যুৎ শক্তির সাহায্যে বিশ্বে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে কয়েক যুগের পর গ্রিক অলিম্পিক আন্দোলন পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। ‘আপনাদের সবার প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক এই ক্রীড়ার মাধ্যমে বিশ্বের শান্তির আন্দোলন শক্তি লাভ করুক।’ কুবারতিন আরেক বার্তায় বলেছেন, ‘প্রাচীন যুগের অলিম্পিকের ধ্বংস্তূপের অন্তরালে এক মহান সমাধিস্থ হয়েছিল; কিন্তু আদর্শ অবিনশ্বর। তাই জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদের প্রচেষ্টায় অলিম্পিয়ার ধ্বংসস্তূপে আজ আশার আলোকবর্তিকা দেখা দিয়েছে।’
১৮৯৪ থেকে ২০২৫। ১৩১ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে অলিম্পিক আন্দোলনে যেমন সফলতা আছে, তেমনটি আছে বিতর্ক এবং ব্যর্থতা। অসমতা, বৈষম্য, নীতিহীনতা এবং আদর্শ ম্লান হওয়ার উদাহরণ। অলিম্পিক আন্দোলনের সেনানীরা সব সময় বলেছেন সময়ের চাহিদা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছোট-বড় পরিবর্তন সাধিত করা হয়েছে অলিম্পিকের স্বার্থেই। তবে দর্শনকে অবজ্ঞা করা হয়নি। ছোট-বড় দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। পাল্টে ফেলা হয়েছে অনেক রীতিনীতি, বলা হচ্ছে সবই অলিম্পিক আন্দোলনকে আরও বেশি সক্রিয় এবং আবেদনময়ী করার জন্য। মানবাধিকার বৈষম্য সমঅধিকার সমতা এসব বিষয়গুলোকে কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। অলিম্পিক আন্দোলনে ক্রীড়া প্রশাসনে বিভিন্ন ট্যাকনিক্যাল সাইডে নারীদের অধিকার কতটুকু নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে।
প্রতিটি দেশের এনওসিতে কি নারী সংগঠকদের যথাযথ অংশগ্রহণ আছে। [UNITED BY AND FOR SPORT] জীবনধর্মী স্লোগানটি কতটুকু কার্যকরী হয়েছে দেশে দেশে। অলিম্পিক আন্দোলন বলছে ঐক্য এবং সংহতির কথা, নারীদের দূরে সরিয়ে রেখে সত্যিকার অর্থে ক্রীড়াঙ্গনে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস কতটুকু কার্যকর হতে পেরেছে। নারী-পুরুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের অলিম্পিক আন্দোলন। পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের প্রতিটি ডিসিপ্লিনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করতে তো একশত বছরের বেশি সময় লেগেছে। ‘অলিম্পিইজম’ কোনো স্পোর্টস কম্পিটিশন নয়। এটি হলো স্টাইল এবং জীবন দর্শন। এ ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা কতটুকু!
১৮৯৬ সালে গ্রিসের এথেন্সে প্রথম অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়েছে। অলিম্পিকে নারীদের অংশগ্রহণে অনুমতি দেয়া হয়নি। এমনকি প্রথম গেমসে মেয়েদের প্রবেশ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, আদি যুগের অলিম্পিকের নিয়ম অনুযায়ী। পরের গেমসে (১৯০০) প্যারিসে। সেখানে নারীরা সরকারিভাবে প্রথম অংশগ্রহণের অধিকার পায় শুধু তিনটি বিষয়ে- টেনিস, গলফ ও তীরন্দাজি। অলিম্পিকে মহিলাদের প্রথম টেনিস প্রতিযোগিতায় সিঙ্গলসে চ্যাম্পিয়ন হন গ্রেট ব্রিটেনের সি কুপার, তিনি পরাজিত করেছেন ফরাসি প্রতিযোগী বি এইচ প্রেভোকে। আধুনিক অলিম্পিকে প্রথম মহিলা প্রতিযোগীনি হিসেবে অলিম্পিকের স্বর্ণ পদক লাভের অপূর্ব গৌরবের অধিকারী সি কুপার। এদিকে অলিম্পিকে অ্যাথলেটিকস ও জিমন্যাস্টিকস প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন মহিলারা ২৮ বছর পর ১৯২৮ সালে আমস্টারডাম অলিম্পিকে।
আইওসির এক্সিকিউটিভ বোর্ড গঠিত হয়েছে সেই ১৯২১ সালে। এর কত বছর পর এই বোর্ডে প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের [MS ANITA DFFRANTZ] নির্বাচিত হয়েছেন সিক্রেট ব্যালটে চার বছরের জন্য? পুরুষশাসিত আইওসিতে ১৩১ বছর পর এবারই প্রথম গত ২০ মার্চ আইওসির ১৪৪তম সভায় গোপন ব্যালটে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন আফ্রিকার জিম্বাবুয়ে ৪১ বছর বয়সী অলিম্পিক স্বর্ণপদক বিজয়ী ক্রিস্টি কভেন্ট্রি। আইওসির সদস্যদের ৯৭টি ভোটের মধ্যে প্রথম রাউন্ডেই ৪৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে ক্রিস্টি কভেন্ট্রি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। অলিম্পিক আন্দোলনে তিনি প্রথম নারী, যিনি মহিলা এবং পুরুষ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন।
এবারই প্রথম ইউরোপিয়ান আইওসিতে একচেটিয়া প্রাধান্য খর্ব করে একজন আফ্রিকান নারী আইওসির সবচেয়ে বড় পদে অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছেন। কভেন্ট্রি আগামী ২৩ জুন অলিম্পিক দিবসে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জার্মানির টমাস বাখের কাছ থেকে দায়িত্বভার বুঝে নেবেন। আফ্রিকান প্রাক্তন মহিলা সাঁতারু এই বিজয় অলিম্পিক আন্দোলন প্রথম সমতার জয়। প্রথম বৈষম্যের বিপক্ষের জয়। প্রথম অধিকার নিশ্চিতের জয়। ক্রিস্টি কভেন্ট্রির জন্ম জিম্বাবুয়ের হারারেতে। ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে একটি সোনাসহ তিনটি পদক জিতেছেন। ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে জিতেছেন একটি সোনাসহ চারটি পদক। ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকের পর অবসর গ্রহণ করে রাজনীতিতে নামেন ২০১৮ সাল থেকে ক্রিস্টি কভেন্ট্রি জিম্বাবুয়ের যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
আফ্রিকার প্রাক্তন মহিলা ক্রীড়াবিদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়া পুরো নারী জাতির জন্য অনেক বড় উদ্দীপনার জন্ম দিয়েছে। বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে এই বিজয় দারুণ সাড়া জাগিয়েছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ে নারী তার অধিকার নিশ্চিত করেছেন এটি পুরো নারী জাতির জন্য অনেক বড় সম্মান এবং গৌরবের বিষয়। বাঘা বাঘা প্রতিদ্বন্দ্বীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন কভেন্ট্রির বিপক্ষে; কিন্তু জয়ী হয়েছেন এমন একজন প্রতিদ্বন্দ্বী যিনি সব সময় ক্রীড়াঙ্গনে সমতাহীনতা এবং বৈষম্যের বিপক্ষে লড়েছেন। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে একটি বার্তা স্পষ্ট হলো যে নারী সমাজকে ক্রীড়াঙ্গন তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখার দিন শেষ হতে চলেছে। নারী-পুরুষের বৈষম্য সৃষ্টির বিপক্ষে সচেতনতা বাড়ছে।
আগেই উল্লেখ করেছি, এবারই প্রথম ইউরোপিয়ানদের প্রাধান্য খর্ব হয়েছে। অবাক হতে হয় ১৩১ বছর লাগল একটি উপলব্ধির জন্ম হতে যে অলিম্পিক আন্দোলন মানেই ইউরোপিয়ানরা নয়। ১৮৯৬ সালে ব্যারন পিয়ার দ্য কুবারতিন প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত (১৮৯৬-১৯২৫) হন। এরপর হেনরি দ্য ব্যালেত ল্যাতুঁর (১৯২৫ থেকে ১৯৪২), জোহানেস সিগফ্রিড এডস্ট্রোম (ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ১৯৪২-১৯৪৬) ১৯৪৬-১৯৫২, আভেরি ব্রান্ডেজ ১৯৫২-১৯৭২, মাইকেল মরিস ক্যালিলান ১৯৭২-১৯৮০, জুয়ান এন্টোনিও সামারাঞ্চ ১৯৮০-২০০১, জ্যাঁক রোগ ২০০১-২০১৩, টমাস বাখ ২০১৩-২০২৫ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত। আর বর্তমানে ইলেকটেড প্রেসিডেন্ট ক্রিষ্টি কভেন্ট্রি ২০২৫ এর ২৩ জুন দায়িত্ব নেবেন।
ইকরামউজ্জমান: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে