অধিকার আদায়ের দিবস
এখন নানারকম দিবসের সমারোহ। ডিম দিবস, বিয়ার দিবস, সাবানের বুদবুদ দিবস, টয়লেট দিবস, প্রেমের প্রস্তাব (প্রপোজ) দিবস, ঘুম দিবস, আলিঙ্গন দিবস౼এমনই সব বিচিত্র দিবসের ভিড়ে নারী দিবস এখন যেন কিছুটা ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। অনেকে আবার নারীর জন্য কেন আলাদা দিবস, এই তর্কে এখনো মশগুল।
মার্চ মাসের ৮ তারিখ নারীর জন্য আলাদা একটি দিন হিসেবে পালন করা নিয়ে তর্ক নতুন কিছু নয়। অনেকে নারী দিবস পালনকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। আবার কেউ কেউ এমন কথাও বলেন যে, ঘর হোক বা বাইরে, যে কোনো ক্ষেত্রে সমমর্যাদার জন্য লড়াই তো বছর ভরই চালিয়ে যেতে হয় মেয়েদের। তবে আলাদা একটা দিনের গুরুত্ব কী? সেই লড়াইয়ের গুরুত্ব বোঝার জন্য বছরের সব দিনই হোক নারী দিবস। একটি বিশেষ দিন বরাদ্দ করে নারীর লড়াই মাপা যায় না। সমাজে সমানাধিকারের দাবিতে মেয়েদের কতখানি লড়াই চালাতে হয়, এক দিনের আলোচনায় সেটা ধরা যাবে না। বৈষম্যের রূপ কতখানি প্রকট, তা সবার টের পাওয়া প্রয়োজন। প্রতিদিনই হোক নারী দিবস।
তবে নারীর জন্য একটা আলাদা দিন উদযাপনের জন্য থাকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিশেষভাবে সময় বরাদ্দ করা না থাকলে, বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজেও ভুল হয়ে যায়। ফলে নারীদের জন্য বিশেষ একটা দিন নির্ধারণ করাই ভালো। এ কথা ঠিক যে, আধুনিক সমাজে বদলেছে নারীর ভূমিকা; কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও কি বদলেছে নারীর মর্যাদা? পেয়েছে কি প্রাপ্য অধিকার? সেটা ভাবার জন্যও ব্যস্তজীবনে একটা নির্দিষ্ট দিন দরকার।
খাতায়-কলমের অধিকারগুলো বাস্তবে কতখানি ভোগ করতে পারছে, নারী দিবস সেটা খতিয়ে দেখার দিন। নারীদের কাজের পরিধি, আর্থিক ব্যবস্থায় অনেক বদল এসেছে ঠিকই। পরিবর্তিত সেই পরিস্থিতিতে অধিকারের লড়াই মাপার দিনও তো নারী দিবস।
এ দিবসের বুনিয়াদি তাৎপর্যটা উপলব্ধি করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। নারীকে সমানাধিকার পাওয়ার জন্য যে সুদীর্ঘ লড়াই করতে হয়েছে, সেই ইতিহাস ভুলে গেলে চলে না। কখনো কাজের অধিকার, কখনো সমকাজে সমমজুরির অধিকার, কখনো সম্পত্তির অধিকার, কখনো ভোটাধিকার- একের পর এক অধিকার নারীকে অর্জন করতে হয়েছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। ৮ মার্চ তারিখটি সংগ্রামের সেই সুদীর্ঘ ইতিহাসে একটা উল্লেখযোগ্য মাইলফলক তো বটেই। নানা সামাজিক নিগড়ের বিরুদ্ধে নারীর সংগ্রাম যে আজও চলছে, তাও অস্বীকার করা চলে না। অতএব, বছরে একটা দিন সংগ্রামের যাত্রাপথটাকে স্মরণ করার আন্তর্জাতিক আয়োজনটির প্রয়োজন নেই, এমন কথা বলা যায় না। নারী দিবস আসলে যুগ যুগ ধরে চলে আসা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য অবমাননাকর প্রথা-পদ্ধতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার দিন, পুরুষের বিরুদ্ধে নয়। নারী দিবস শুধু নারীর দিন নয়, সমস্ত পিতৃতন্ত্রবিরোধী মানুষের উদযাপনের দিন।
সমাজ এগোচ্ছে। নারীর-অধিকার ও মর্যাদাও সমাজে বাড়ছে। নারীবাদীদের মিছিল থেকে ‘৮ মার্চ দিচ্ছে ডাক, পিতৃতন্ত্র নিপাত যাক’ ধ্বনিও বাড়ছে; কিন্তু কিছু লোকের নারী-বিদ্বেষও পাশাপাশি বাড়ছে। একদল তো ৮ মার্চ সমানুভূতির সর্ব দর্প চূর্ণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন সোশ্যাল মিডিয়ায়, ‘মেয়েদের জন্য আস্ত একটা দিন কেন শুনি, অ্যাঁ? ছেলেরা কি কম খেটে মরে? ছেলেরাও অত্যাচারিত, বঞ্চিত! সংসারে ছেলেদের অবদান কি কম? তাহলে পুরুষের জন্য কোনো দিবস নেই কেন? আমাদেরও দিবস চাই’ ইত্যাদি বলে মাঠ গরম করে ফেলেন; কিন্তু একটা কথা তাদের বুঝতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে নারী এবং পুরুষের অনেক সমস্যা এক মনে হলেও তার ফল মেয়েদের জীবনে সব সময় বহুমাত্রিক। মেয়েদের এবং ছেলেদের অবস্থানে আজও অনেক ফারাক। অনেক মেয়েও ইদানীং গর্ব করে বলেন, 'আমার নারীজন্ম ভীষণ সুখের। বাবা-মা আমায় ছেলের মতো পুত্রস্নেহে বড় করেছেন'; কিন্তু এই সোহাগীরা ভুলে যায় ব্যতিক্রম নিয়ম নয়। খুব মনোযোগ দিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, গোটা প্রাণজগতে মেয়েরা প্রকৃতপক্ষে মেয়ে মাকড়সার মতো নিজের শরীর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে খাইয়ে মৃতদেহ হয়ে ঝুলের সঙ্গে ঝুলে থাকে। তারপরে কখনো কালবৈশাখী ঝড় এলে, সে মৃতদেহ উড়ে যায় নিরুদ্দেশে; কিন্তু এটা উপলব্ধি করতে পারে কয়জন?
আসলে এসব ছেলে-মেয়ের দোষ নেই। তাদের অনেকেই সম্ভবত দিনটির ইতিহাস ও প্রাসঙ্গিকতা জানেন না। আর পোশাকি উদযাপনের ঘটায় সে ইতিহাস গিয়েছে হারিয়ে। নারী দিবস এখন অনেক পোশাকের দোকানে ছাড়ের উৎসব! বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির গালভরা বিজ্ঞাপন!
নারী দিবস যখন মূলধারার 'উৎসবে' পরিণত হলো, রাষ্ট্র থেকে করপোরেট, সবাই যখন নারী দিবস নিয়ে মাতামাতি শুরু করল, তখন অধিকার আদায়ের ইতিহাস, নারীর বঞ্চনা, বৈষম্যের মতো 'অস্বস্তিকর' প্রশ্নকে সরিয়ে রাখা হলো। নারী দিবসের পেছনে যে মেয়েদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অধিকারের প্রশ্নটি আছে, সেটি সুচতুরভাবে সবাইকে ভুলিয়ে দেয়া হলো। কারণ, মেয়েদের সামাজিক, অর্থনৈতিক বঞ্চনা আজও কমেনি। আইন যা-ই বলুক, আজও নারী-পুরুষ সমান কাজে সমান মজুরি পায় না, মেয়েরা সম্পত্তির ভাগ চাইতে আজও কুণ্ঠাবোধ করে, সম্প্রতি আমাদের দেশে অর্থকরী কাজে মেয়েদের অংশগ্রহণ পর্যন্ত কমতির দিকে। যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন কোনো কিছুই স্বস্তিকর পর্যায়ে আসেনি। ৩০ বছর আগে মেয়েদের জীবনের যে সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়েছে, দেখা যাচ্ছে ৩০ পর আজও তা প্রাসঙ্গিক। মেয়েদের জন্য অদৃশ্য খাঁচা আজও ভীষণ ভাবে বিদ্যমান। এত নারীশিক্ষা, সচেতনতার অনুষ্ঠান- তবু নারী নিঃশঙ্ক নয়। মেয়েরা নির্যাতিত হবে, এটা ধ্রুবতারার মতো সত্য।
শ্রম আর বেতনের সমতা নিয়ে রাস্তায় নেমে দেড়শ বছর আগে যে মেয়েরা নারী-পুরুষের সাম্যের কথা বলেছিল, অনেক ক্ষেত্রে তার সামান্য অংশও বাস্তবায়িত হয়নি। উল্টে যে মেয়েটি ভোরের আগে উঠে কোনও এক প্রত্যন্ত গ্রামে ছাত্র পড়িয়ে অসুস্থ বাবা-মা আর ৩ বোনের খরচ চালিয়ে একবেলা শাক আর ভাত খেয়ে বাঁচে, তার কাছে নারী দিবস অর্থহীন। সে তো স্নাতক স্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। তাকে নারী দিবস কী দিতে পেরেছে? অনাহার, অন্ধকার, কখনো বা বাড়ি বয়ে আসা বাইকধারী পুরুষের ধর্ষণের হুমকি! প্রেমিক হতে চাওয়া পুরুষ যে মেয়ের গায়ে অ্যাসিড ছুঁড়ে তার মুখ পোড়ায়, তাকে নারী দিবস কী দিয়েছে? থানার সামান্য নিরাপত্তাটুকু দিতে পারেনি তাকে। উল্টে বেইল পাওয়া সেই পুরুষ রোজ তার বাড়িতে হুমকি দিচ্ছে। মুখ তো পুড়েছে, এবার শরীরের পালা। ধর্ষণ!
তবুও নারী দিবস হয়। শাড়ি আর গয়নার ছটায় মঞ্চ আলো হয়। 'উইমেন ইন লিডারশিপ' করপোরেটের বড় মুখ, সমাজকর্মীরা, সমাজের গণমান্য নারীরা সম্মানিত হন। নিঃসন্দেহে তারা নিজেদের জায়গায় কৃতী। লড়াই তাদেরও আছে। তবে শুধু তাদেরই আছে। তারা 'করে দেখাতে' পেরেছেন। আর যারা দেখাতে পারছে না? কিন্তু নিয়ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের গায়ে মাটির গন্ধ, শ্রমের লড়াইকে থামিয়ে দেয়ার জন্য কি তবে অন্য কোনো দিবসের অপেক্ষায় আরও অনেক শতাব্দী পার হয়ে যাবে?
নারী দিবসের বিপরীতে পুরুষ দিবস পালনের দাবি তোলার মধ্যেই পুরুষদের কর্তব্য শেষ হতে পারে না। হওয়া উচিত নয়। সোচ্চার হতে হবে পুরুষদেরও। নারীর দাবি তো আসলে মানুষ হিসেবে জীবনযাপন করারই দাবি। নারীর এই দাবি পুরুষের দাবিই বা হবে না কেন? পুরুষদেরও তো নিছক পুরুষ হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেই বাঁচতে হবে। তারা যদি নারীর বাঁচার দাবির অংশ থেকে বেশিটা কেড়ে নেয়, তাহলে যে মনুষ্যত্বের মধ্যেই টান পড়বে- এটা উপলব্ধি করতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে