Views Bangladesh Logo

পালাটানা ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের দিনগুলো

বিলোনিয়ার প্রথম যুদ্ধের পর ২১ জুন, ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনী প্রচণ্ড গোলাগুলি, সন্ত্রাস, অবিশ্বাস্য রকমের ধ্বংসযজ্ঞ ও ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিলোনিয়ার ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত এসে অবস্থান গ্রহণ করে। তার আগেই অবশ্য সমগ্র এলাকার জনগণ জীবন ও সম্ভ্রম বাঁচানোর স্বাভাবিক তাগিদে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে, বিশেষত বিলোনিয়া শহরে এসে আশ্রয় নেয়। বিলোনিয়া শহর তখন পূর্ব বাংলার মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ জনগণ দ্বারা প্লাবিত। ভারতীয় জনগণ হাসিমুখে তাদের বরণ করে নেন এবং আশ্রয় দেন। পালাটানা ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগদানের উদ্দেশ্যে আমি আগেই বিলোনিয়া এসে পৌঁছেছিলাম। পথে আমার সঙ্গে যোগ দেয় বন্ধু ওয়ালী। বিলোনিয়ায় পরিচয় হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাহাঙ্গীর ও আনসারের সঙ্গে।

জাহাঙ্গীর ও আনসারসহ সদ্য ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী যুবকদের মধ্য হতে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী তাদের সংগঠিত করতে শুরু করলাম। সৌভাগ্যবশত বিলোনিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহের তৎপরতা ও মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে আমাদের ব্যাকুলতা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) মেজর প্রধানের নজরে আসে। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং আমাদের সৎ উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে তার অধীনস্থ দুটো “SHAKTIMAN” ব্র্যান্ডের সামরিক ট্রাকের ব্যবস্থা করে দিলেন। সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে হানাদার দস্যুদের মোকাবিলায় সংকল্পবদ্ধ দু-ট্রাক ভর্তি তরুণ ও যুবক নিয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা যাত্রা শুরু করলাম পালাটানার উদ্দেশ্যে।

আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। চারদিকে পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়গুলো গাঢ় সবুজ গাছ-গাছালি দ্বারা আবৃত। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। উপরে নীল আকাশ, মাঝে মাঝে শ্লথ গতির সাদা মেঘের নীরব আনাগোনা। নির্মল ও ভীষণ গতির বাতাস এলোমেলো করে দিচ্ছে চুল ও কাপড়-চোপড়। অজানার পথে আমরা। অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তার সঙ্গে এক ধরনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এগিয়ে চলেছে ভারী সামরিক ট্রাক। পাহাড়ের গা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে খাড়া রাস্তা বেয়ে উঠে যাচ্ছে একেবারে পাহাড়ের চূড়ায়। নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায়। ব্রেক ফেল করলে অথবা অন্য কোনো কারণে বিপজ্জনক এ রাস্তায় দুর্ঘটনায় পতিত হলে সোজা গিয়ে পড়তে হবে হাজার ফুট নিচের পাহাড়ি খাদে। এ ধরনের দুর্ঘটনার কবলে পতিত, নিচের গভীর খাদে চিরনিদ্রার শয়নে শায়িত একটি উল্টে যাওয়া ট্রাক দেখতে পেলাম। এত উঁচু থেকে ট্রাকটিকে লাগছিল একটি ক্ষুদ্র খেলনা ট্রাকের মতো।

আমাদের ট্রাক এবার ঘুরে ঘুরে নিচের দিকে নামা শুরু করল ঘোঁ ঘোঁ করে, ষাঁড়ের ন্যায়, গোঁয়ারের মতো। পাহাড়ি রাস্তায় এ ধরনের ভ্রমণে আমরা কেউই অভ্যস্ত ছিলাম না। ট্রাকে গাদাগাদি করে বসে থাকা ছেলেদের মধ্যে অনেকেই ভয়ানক রকম বমি শুরু করে দিল। এ ধরনের একটি বমির ধারা তীব্র গতিতে আমার বাম কাঁধের ওপর দিয়ে গিয়ে পড়ল আরেক সাথী ভাইয়ের পিঠে। রক্ষা পেলাম অল্পের জন্য; কিন্তু আত্মতৃপ্তির অবকাশ ছিল না। পরমুহূর্তেই দেখলাম কুলির চেয়েও তীব্র গতিতে ধেয়ে আসছে বমির আরেক ধারা। মুহূর্তের মধ্যেই সরিয়ে ফেললাম মাথা। ধাঁ করে সেই ‘বমি-কুলি’ সরাসরি গিয়ে আছড়ে পড়ল আরেক সাথী ভাইয়ের গলায় ও বুকের উপরের অংশে। সে এক কাণ্ড বটে। যাক, এভাবে বমির ছোটাছুটির ভেতর, হেলে-দুলে, ঝাঁকুনি খেতে খেতে এবং ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার ওহে, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার’ কোরাস গাইতে গাইতে শেষ পর্যন্ত আমরা এসে পৌঁছুলাম পালাটানা ট্রেনিং ক্যাম্পে। ক্যাম্প কমান্ডেন্ট ক্যাপ্টেন সুজাত আলী এমপি আমাদের স্বাগত জানালেন এবং ফিজিক্যাল ফিটনেস টেস্টসহ কিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে সামরিক ট্রেনিংয়ের জন্য নিবন্ধন প্রদান করলেন। আমরা সেদিনের মতো ব্যারাকে চলে গেলাম খাওয়া-দাওয়া ও বিশ্রামের জন্য।

‘পালাটানা’ এলাকাটির অবস্থান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুর শহরের ৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। ‘পালাটানা প্রাইমারি স্কুল’ নামে এখানে ছিল একটি স্কুল। স্কুলের সামনে বেশ বড় একটি মাঠ। চারদিকে ছোট ছোট টিলা ও পাহাড়। শান্ত, সবুজ ও মনোরম একটি পরিবেশ। লোকবসতি হালকা। বেশিরভাগ অধিবাসীই বাঙালি হিন্দু। পাহাড়ি এবং মুসলমানের সংখ্যাও অবশ্য একেবারে কম নয়। স্বচ্ছন্দে ও সহমর্মিতায় তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

ব্রিটিশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন সুজাত আলী আওয়ামী লীগ হতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কুমিল্লার দেবিদ্বার এলাকা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। পালাটানা ট্রেনিং ক্যাম্পের তিনিই প্রতিষ্ঠাতা-কমান্ডেন্ট। রাশভারী প্রকৃতির মানুষ। স্বল্পভাষী ও রাগি। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। কিন্তু রেগে গেলে টকটকে লাল। নাকের নিচে কাঁচা-পাকা এক গুচ্ছ গোঁফ। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের জন্য স্থানটি তার খুবই পছন্দ। সানন্দে তাতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন স্থানীয় পঞ্চায়েত (ইউনিয়ন পরিষদ) চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ। এগিয়ে আসেন স্থানীয় প্রভাবশালী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। স্কুলটি বন্ধ ঘোষিত হলো অনির্দিষ্টকালের জন্য। শুরু হলো প্রশিক্ষণ ক্যাম্পটি স্থাপনের কাজ।

স্কুল ঘরটি ছিল মাঠের পূর্ব অংশে। ক্যাপ্টেন সুজাত আলী সাহেবের থাকার ব্যবস্থা হলো এর একটি রুমে। সঙ্গে থাকতো ৮ ও ১০ বছর বয়সী তার ফুটফুটে দুই ছেলে। পাশের রুমটি নির্ধারিত হলো ‘কমান্ডেন্ট অফিস’ হিসেবে। অন্যান্য রুম ব্যবহৃত হতো চিকিৎসা কেন্দ্র, তথ্য কেন্দ্র, ইনস্ট্রাক্টরদের থাকা ও গুদাম হিসেবে।

মাঠের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে উপরে ছন ও চারদিকে বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি হলো ব্যারাক। উত্তর-পূর্ব কোণায় স্থাপিত হলো লঙ্গরখানা, মানে কিচেন। দক্ষিণ-পূর্ব পাশে শাল ও গজারী কাঠ দিয়ে নির্মিত হলো মেইন গেট। পশ্চিম দিকের ব্যারাকের মাঝামাঝি স্থানে বাঁশ দিয়ে নির্মিত হলো দ্বিতীয় গেটটি। সে গেট হতে ২০ গজ দূরেই দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে তৈরি করা হয়েছে ৩০টি কাঁচা টয়লেট। মাটি থেকে ২ ফুট উঁচুতে বাঁশ ও বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি হয়েছে সেগুলো। টয়লেটের কাছাকাছি স্থানে রাখা ৩০টি মাটির বদনা। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ক্ষীণ একটি পাহাড়ি পানির ধারা থেকে বদনায় পানি এনে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার পর শৌচকার্য সম্পন্ন করতে হতো।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আকুলতা নিয়ে পালাটানা ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রতিদিন পূর্ব বাংলা থেকে স্রোতের মতো তরুণ ও যুবকরা আসতে লাগল। এদের মধ্যে ছিল ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, ফেরিওয়ালা ও ছোট ব্যবসায়ী ধরনের মানুষ। গড় বয়স ১৫ থেকে ২৮ বছর। ছাত্রদের মধ্যে নবম-দশম শ্রেণি থেকে শুরু করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও ছিল। ট্রেনিংরত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছাত্রদের সংখ্যাই ছিল বেশি।

মেইন গেটের পাশে ছোট একটি রুমে আগ্রহী প্রশিক্ষণার্থীদের শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা নিয়ে ট্রেনিংয়ের জন্য বাছাই করা হতো। পাকিস্তানিদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য কেউ যাতে প্রশিক্ষণার্থীর ছদ্মবেশে ক্যাম্পে ঢুকতে না পারে, অথচ যুদ্ধে যোগদানে ইচ্ছুক প্রকৃত প্রশিক্ষণার্থীরাও যাতে বাদ না যায় সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ ছিলেন বিশেষ সজাগ। শারীরিক ও মানসিকসহ বয়সের কারণে যে সব প্রশিক্ষণার্থী ট্রেনিংয়ের জন্য তথা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অনেক আকুলী-বিকুলী করেও নির্বাচিত হতে পারত না তাদের মধ্যে অনেককেই অঝোর ধারায় কাঁদতে দেখেছি। স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করার এবং প্রয়োজনে জীবন দেয়ার সেকি আকুলতা।

প্রশিক্ষণার্থীদের সেকশন, প্লাটুন ও কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত করে শৃঙ্খলার সঙ্গে বিন্যাস করা হলো। কোম্পানিগুলোর নাম দেয়া হলো এভাবে আলফা, ব্রাভো, চার্লি, ডেল্টা, ইকো, ফাইটার, গামা, হীরো ইত্যাদি। প্রতিটি কোম্পানিকে তিনটি প্লাটুনে বিভক্ত করে তিনজন প্লাটুন কমান্ডার এবং একজন কোম্পানি কমান্ডার নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। কমান্ডার নিয়োগের পূর্বে শারীরিক, মানসিক ও শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ লিডারশিপ কোয়ালিটির বিষয়ে সাক্ষাৎকার ছাড়াও ব্যাপকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিল। আমাকে ফাইটার কোম্পানির কমান্ডার মনোনীত করা হলো। জাহাঙ্গীর ও ওয়ালী যথাক্রমে ইকো ও গামা কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত হলো। অন্য কোম্পানি কমান্ডারদের নাম আজ আর কিছুতেই মনে করতে পারছি না।

প্রত্যেক কোম্পানির জন্য আলাদা আলাদা ব্যারাক তৈরি করা হয়েছিল ব্যারাকের মাঝখানটায় হাঁটা-চলার জন্য একটুখানি পথ রেখে দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। প্রতিটি প্রশিক্ষণার্থীকেই দেয়া হলো দুটি করে চটের খালি বস্তা, দুটি করে ১০ ইঞ্চি ইট, একটি এলুমিনিয়ামের থালা ও একটি এলুমিনিয়ামের বড় মগ। আমাদের বলা হলো একটি চটের বস্তা দিয়ে দুটো ইট মুড়িয়ে বালিশ বানাতে এবং বাকি চটের বস্তাটি বিছানা হিসেবে ব্যবহার করতে। আমরা তাই করলাম। তবে কোমরসহ শরীরের নিচের অংশ মাটিতেই থাকত। বিছানার ‘পূর্ণতার জন্য’ অনেক চেষ্টা করেও তৃতীয় একটি বস্তার বরাদ্দ পাওয়া গেল না। অনেকেই আমরা পাশের বন থেকে গাছের পাতা সংগ্রহ করে বিছানাগুলোকে বিস্তৃত ও আরামদায়ক করার ব্যবস্থা নিলাম।

ক্যাম্পের লঙ্গরখানা তথা কিচেনে খাবার তৈরি হতো। সকালের পিটি প্যারেডের পরে নাস্তা হিসেবে আমাদের দেয়া হতো একটি আটার রুটি ও এক মগ চা। দুপুরে বরাদ্দ ছিল এক প্লেট ভাত ও এক চামচ ‘লাবড়া’ টাইপের তরকারি। রাতে দুটো আটার রুটি ও এক চামচ ডাল। অবশ্য সপ্তাহে এক বেলা এক টুকরো মাছ অথবা ঝোল সহ ২/৩ টুকরা ছাগলের মাংস অথবা ঝোলসহ এক টুকরা মুরগির মাংশ পরিবেশিত হতো। সেদিন সকলের চোখে-মুখে আনন্দের ঢেউ বয়ে যেত।

আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেনিং শুরু হওয়ার ৮/৯ দিন পরে প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্য হতে ওয়ালীসহ ১২ জন ছেলেকে আলাদা করা হলো। বলা হলো যে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এবং ভারতীয়/মুক্তি বাহিনীর পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির ট্রেনিং প্রদানের জন্য তাদের আসামের কোথাও নিয়ে যাওয়া হবে। তারা সকলেই সম্মত। গেটে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি গাড়িও প্রস্তুত। ক্যাম্পে আমার অন্যতম বাল্যবন্ধু ওয়ালী। অথচ সে চলে যাচ্ছে। মনটা বিষাদে ভরে গেল। অশ্রুসজল নয়নে ওয়ালীকে বিদায় দিলাম। ওয়ালীদের গাড়ি ছেড়ে দেয়ার মুহূর্তেই ভোজবাজির মতো ভাড়া করা একটা জিপে এসে হাজির হলো আমার দুই প্রিয় বাল্যবন্ধু শহীদ উল্লাহ ও মোশাররফ হোসেন (হারুন)। দুজনই ফেনী কলেজের ছাত্র। এক বন্ধুর প্রস্থানের প্রাক্কালে দুই বন্ধুর আগমন আমার মনের বিষণ্নতা দূর করে দিল। আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে সামনে পেয়ে ওরা খুশি ও আনন্দে একেবারে দিশেহারা। সে যাক, যোদ্ধা হিসেবে বাছাই ও দাপ্তরিক অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবার পর তাদের ওদের জন্য নির্দিষ্ট ব্যারাকে পৌঁছে দিলাম। দুজনকেই হিরো কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। শহীদ পরবর্তীতে হিরো কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত হয়েছিল।

শুরু হলো ট্রেনিং। ভোরবেলা বিউগলের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে প্রশিক্ষণার্থীদের সকলেই হাজির হলো মাঠে। ইংরেজি বর্ণমালার ক্রমানুসারে কোম্পানিগুলোকে সাজানো হলো। প্রতিটি কোম্পানির সামনে কোম্পানি কমান্ডারদের দাঁড় করানো হলো। তার পেছনে তিন সারিতে তিনটি প্লাটুন। প্রতিটি প্লাটুনের সামনে একেকজন প্লাটুন কমান্ডার দণ্ডায়মান। প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে কেউ পরে আছে লুঙ্গি, আবার কেউ পরে আছে প্যান্ট। নির্দেশানুযায়ী লুঙ্গিওয়ালাদের ‘গোঁচ’ (মালকোচা) দিয়ে দাঁড়াতে হলো। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন রেজিমেন্ট হতে ছুটিতে আসা, অবসরপ্রাপ্ত অথবা ইউনিট ছেড়ে বেরিয়ে আসা ১৫/১৬ জন হাবিলদার ও সুবেদার ছিলেন আমাদের প্রশিক্ষক। এদের মধ্যে একজনকে কিছুতেই ভোলা যায় না। তিনি হাবিলদার বারেক। বারেক ওস্তাদ ছিলেন সরল প্রকৃতির, কিন্তু গায়ে-গতরে এবং লম্বায়-চওড়ায় ছিলেন বিশাল। গলার আওয়াজ ছিল বজ্রের মতো। ট্রেনিং প্রদানের সময় সে গলা গমগম করতো, শোনা যেত বহুদূর পর্যন্ত।

প্রথম দিন ৭ কোম্পানির প্রশিক্ষণার্থীদের শারীরিক কসরত (Physical Training) এবং Parade করিয়ে Attention এর ভঙ্গিতে দাঁড় করানো হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজন প্রশিক্ষক Escort করে ক্যাম্প কমান্ডেন্ট ক্যাপ্টেন সুজাত আলী সাহেবকে নিয়ে এলেন। কমান্ডেন্ট আমাদের সকলকেই স্বাগত জানিয়ে অত্যন্ত আবেগোদ্দীপক ভাষায় এবং তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠে একটি ভাষণ দিলেন। দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ধর্মভিত্তিক উদ্ভট দেহের অবাস্তব রাষ্ট্র পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা কত নির্মমভাবে পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালিরা শাসিত ও শোষিত হয়েছে ভাষণে তিনি তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দেন। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসন, ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলন, আটষট্টির ছাত্রদের এগারো দফা আন্দোলন এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আইয়ুব খানের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের ছাত্র-গণ অভ্যুত্থান, সত্তরের উপকূলীয় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও নির্বাচন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ, বঙ্গবন্ধুর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ছল-চাতুরি, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং সবশেষে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ২৬ মার্চের আক্রমণ ও গণহত্যাসহ ছাব্বিশে মার্চের প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার মর্মস্পর্শী বর্ণনা তার ভাষণে উঠে এলো। মন-প্রাণ ঢেলে দিয়ে স্বল্পতম সময়ে নিখুঁতভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমাদের প্রতি তিনি উদাত্ত আহ্বান জানালেন। জবাবে গলা ফাটিয়ে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ এবং ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে এক হাজারেরও বেশি প্রশিক্ষণার্থী সেদিন তাদের আবেগ, অনুভূতি ও দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেছিল।
(সংক্ষিপ্ত)

গোলাম মোস্তফা: বীর মুক্তিযোদ্ধা, দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাইওনিয়র প্লাটুনের একাংশের কমান্ডার ও অধিনায়ক স্টাফ অফিসার।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ