জেলা প্রশাসক সম্মেলনে উন্নয়ন, ক্ষমতার পুনর্বণ্টন ও চ্যালেঞ্জ সমন্বয়ের অঙ্গীকার
তিন দিনের সম্মেলনে মাঠপর্যায়ের নানা প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং উন্নয়ন ও ক্ষমতার পুনর্বণ্টন সমন্বয়ের অঙ্গীকার করেছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও বিভাগীয় কমিশনাররা। সমস্যা-সংকট নিরসনে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচনে পেয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকদের দিকনির্দেশনাও।
১৬ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের এই সম্মেলনে ছিল ৩০টি কার্য-অধিবেশন এবং চারটি বিশেষ অধিবেশন। বিশেষ অধিবেশনগুলোর মধ্যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মুক্ত আলোচনা, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বৈঠকে অংশ নেন ডিসিরা।
তবে রেওয়াজ থাকলেও রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে এবার বঙ্গভবনে সাক্ষাতের সুযোগ পাননি মাঠ পর্যায়ের প্রশাসকরা, যা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মাঝে বিতর্ক তৈরি করেছে।
সংস্কার ও জনসেবায় জোর
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব শেখ আব্দুর রশীদ জানান, এবারের সম্মেলনে ৫৬টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা সম্পর্কিত ১ হাজার ২৪৫টি প্রস্তাবের মধ্যে কার্যপত্রে অন্তর্ভুক্ত ৩৫৪টি নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে, যেগুলো জনসেবা, আইনশৃঙ্খলা এবং অবকাঠামো উন্নয়নে মনোনিবেশ করেছে।
সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে ‘নির্ভয়ে ও স্বাধীনভাবে’ কাজ করার আহ্বান জানিয়ে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারদের প্রতি উন্নয়নমূলক কাজে স্থানীয় চাপ উপেক্ষার নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের সংস্কার, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং ই-গভর্ন্যান্স সেবার গতি বাড়াতেও বলেন তিনি।
রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টায় তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত ভিডিওচিত্রে জুলাই গণআন্দোলনের ইতিহাস ও তার ফলাফল তুলে ধরা হয়, যাকে বলা হচ্ছে, সরকারের প্রতিশ্রুতি ও আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নের প্রতীক।
আইনশৃঙ্খলা ও স্থানীয় সরকারের প্রশাসনিক ক্ষমতা
পুলিশের বার্ষিক প্রতিবেদন (এসিআর) প্রণয়ন, কনস্টেবল নিয়োগে প্রতিনিধিত্ব এবং অপরাধ ডেটাবেইসে প্রবেশাধিকারসহ প্রশাসনিক ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব দেন ডিসিরা। ফরিদপুর ও মাগুরার জেলা প্রশাসকের বক্তব্যে উঠে আসে উপজেলা পরিষদের কর্মচারী নিয়োগ ও বদলির ক্ষমতা নিজেদের অধীনে নেয়ার সুপারিশও।
শরীয়তপুর, রাঙামাটি ও পিরোজপুরের ডিসিরা পরিবার পরিকল্পনা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতৃত্ব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনওদের) হাতে দেয়ার প্রস্তাব দেন, যা বর্তমানে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের অধীনে রয়েছে।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো উন্নয়নে জোর
সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দ্বিতীয় দিনে সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ডিসিদের সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং বিভিন্ন কর্মঅধিবেশনে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতের প্রস্তাবগুলো প্রাধান্য পায়।
বান্দরবানে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালকে ৫০০ শয্যায় উন্নীতকরণ এবং সিসিইউ-আইসিইউ স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয় এদিন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের পদবি পরিবর্তন ও আনসার বাহিনীর মাধ্যমে হাসপাতাল নিরাপত্তা জোরদারের আহ্বান জানান জেলা প্রশাসকরা।
শিক্ষাখাতে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফি নির্ধারণ, আদায়কৃত অর্থের স্বচ্ছ ব্যবহার নিশ্চিত এবং মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নের প্রস্তাব উঠে আসে।
পাবনার ডিসি মোহাম্মদ মফিজুল ইসলামের প্রস্তাবে শিক্ষা খাতে দুর্নীতি রোধ ও আর্থিক জবাবদিহি নিশ্চিতে দেয়া হয় নীতিমালা প্রণয়নের তাগিদও।
সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়ককে জাতীয় মহাসড়কে উন্নীতকরণ, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, পরিবেশ দূষণ রোধে পৌরসভায় ইটিপি স্থাপন ও চরাঞ্চলে বজ্রপাত নিরোধক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ছাড়াও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বাজেটের আওতায় স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফি নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয় সম্মেলনে।
ক্ষমতার পুনর্বণ্টন ও সুবিধা বাড়ছে
মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সম্মেলনের সমাপনী দিনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, কৃষি, এবং পর্যটনসহ ২০টিরও বেশি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা শেষে স্থানীয় সরকারের তুলনায় জেলা প্রশাসনের ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। বিশেষ করে নিয়োগ ও বদলির ক্ষমতা ডিসিদের কাছে হস্তান্তর, মাঠ প্রশাসনের কর্মীদের রেশন সুবিধা ও ঝুঁকি ভাতা এবং পার্বত্য জেলাগুলোতে পাহাড়ি ভাতা বাড়ানো এবং মোবাইল-ইন্টারনেট ভাতা চালুর প্রস্তাব অনুমোদন করেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
নতুন প্রত্যাশা
প্রতি বছর হয়ে আসা ডিসি সম্মেলন প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত সমন্বয় সাধনের গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, দুর্নীতি দমন, জনসেবার উন্নয়নসহ নানা ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকদের ভূমিকা নির্ধারণে এবারের সম্মেলনটিও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম এই সম্মেলনে মাঠ প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকদের সমন্বয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। তবে প্রস্তাবিত সংস্কারগুলোর সফল বাস্তবায়নই নির্ধারণ করবে, এটি কতোটা ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে উঠবে। জনগণের প্রত্যাশা অনুসারে ডিসিরা দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ প্রশাসন গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন বলেও আশাবাদী তারা।
সমালোচনা ও চ্যালেঞ্জ
গত বছরের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে নেয়া ৩৮১টি সিদ্ধান্তের মধ্যে মাত্র ৪৬ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে, যা উন্নয়ন প্রক্রিয়ার গতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
অন্যদিকে ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের ঝুঁকি নিয়ে সতর্ক করছেন সুশীল সমাজ। স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব নিয়েও তাদের কাছ থেকে সমালোচনা আসছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে