প্রিয় উমা, প্রিয় দুর্গা
দুর্গা মারা গেছে। হরিহরের পরিবার চলে যাচ্ছে নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম ছেড়ে। স্মৃতিবিজড়িত গ্রাম ছেড়ে অপু চলে যাবে অনেক দূরে, কলকাতায়। মালপত্র সব গরুর গাড়িতে তোলা হচ্ছে। মা-বাবা ব্যস্ত। অপু ভাবল, সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার গোপন জিনিস কী কী আছে দেখা যাক। উঁচু তাকের ওপর একটা মাটির কলসি সরাতে গিয়ে কী একটা জিনিস গড়িয়ে পড়ল নিচে। অপু দেখল একটা সোনার কৌটা, যেটা আর বছর দুর্গা সেজ ঠাকরুনের বাড়ি থেকে চুরি গিয়েছিল।
উপন্যাসে আছে সোনার কৌটা; কিন্তু সত্যজিৎ রায় ছবিতে দেখিয়েছেন একটি সোনার হার। উপন্যাসে আছে অপু সোনার কৌটাটা নিয়ে ফেলে দিয়েছে বাঁশঝাড়ের জঙ্গলে, আর ছবিতে আছে অপু সোনার হারটা নিয়ে ফেলেছে একটি কচুরিপানাভরা পুকুরে। ছবির দৃশ্যটি আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ- সোনার গয়না পড়ে কচুরিপানাভরা পুকুরের মাঝে একটু পানি সরে যায়, তারপর আস্তে আস্তে আবার বুঁজে যায়- তার মানে দুর্গার সব স্মৃতি ওখানেই রইল- এটি যেন দুর্গা সব জগতের দরজা বুঁজে আসার দৃশ্য।
গত ১৮ নভেম্বর দুর্গা চরিত্রে অভিনয়শিল্পী উমা দাশগুপ্ত মারা গেছেন। জীবনে তিনি ওই একটি ছবিতেই অভিনয় করেছিলেন। পথের পাঁচালী ছাড়া আর কোনো ছবিতে অভিনয় করেননি, হয়তো দুর্গা হিসেবেই তিনি অমরত্ব চেয়েছিলেন। ছিলেন যাদবপুর বিদ্যাপীঠের শিক্ষিকা। অঙ্ক ও ইংরেজি পড়াতেন। ১৯৮৪ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। শেষ দিকে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বাড়ি ছেড়ে খুব একটা বেরোতেন না।
২০২১ সালে ছিল সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ। সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে ‘পথের পাঁচালী’র সঙ্গে জড়িত সবাইকে নন্দনে সংবর্ধনা দেয়া হয়। অপু চরিত্রে অভিনয়শিল্পী সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় আশা করেছিলেন, এ দিন দিদির সঙ্গে দেখা হবে। পথের পাঁচালীতে কাজ করতে করতে উমা দাশগুপ্ত সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সত্যিকারের দিদি হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে নন্দনের অনুষ্ঠানে পারেননি উমা দাশগুপ্ত। আগেও অনেক দিন দিদির সঙ্গে দেখা হয়নি সুবীরের, পরেও আর হলো না।
উমার মৃত্যুর পর সেই দুঃখই প্রকাশ করলেন গণমাধ্যমের কাছে, আমার তখন মাত্র ৯ বছর বয়স। আর উমাদির ১৪ বছর। আমি তো শুটিংয়ের কিছুই বুঝতাম না। একসঙ্গে দুজনে শুটিং করছি। গড়িয়ার বোড়ালে শুটিং। ট্রেন দেখতে যাওয়ার দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল শক্তিগড়ের কাছে পালসিটে। আমাকে শুরু থেকে আগলে রাখতেন দিদি। একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, খুনসুটি করতাম। আনন্দ করতাম। একেবারেই যেন ভাইবোন।’
২.
উমা দাশগুপ্তের মৃত্যুতে বাংলার সাহিত্যপ্রেমী, সিনেমাপ্রেমী মানুষের বারবার মনে পড়েছে দুর্গার মৃত্যুর কথাই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে লিখেছেন, দুর্গা মারা গেল তিনবার। একবার উপন্যাসে, একবার চলচ্চিত্রে আরেকবার উমা দাশগুপ্তের মৃত্যুতে। বাংলাসাহিত্যের আর কোনো চরিত্রের মৃত্যুতে মানুষ সম্ভবত এতটা কাঁদে নাই, যতটা কেঁদেছিল দুর্গার মৃত্যুতে। দেবদাসও মারা গিয়েছিল, দেবদাসের জন্যও অনেকে কেঁদেছিল; কিন্তু দেবদাসের মৃত্যু আর দুর্গার মৃত্যু একরকম নয়; পাঠকের মনে দাগও ফেলেছিল ভিন্নরকম।
আবহমান বাংলা এক সরলা কিশোরীর প্রতীক হিসেবে দুর্গা চরিত্রটি তৈরি করেছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তার সার্থক চলচ্চিত্র রূপায়ন করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। পথের পাঁচালীর অন্য সব চরিত্রের মতোই তিনি উমাকে নিয়েছিলেন অপেশাদারী শিল্পী হিসেবে। শৈশব থেকেই থিয়েটার করতেন উমা দাশগুপ্ত। যে স্কুলে পড়তেন, সেখানকার প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের পরিচয় ছিল। আর সেই শিক্ষকের সুবাদেই দুর্গা চরিত্রের জন্য তাকে খুঁজে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। উমার বাবা প্রথমে চাননি মেয়ে অভিনয়ে আসুক। শেষ পর্যন্ত বাবাকে রাজি করিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।
দুর্গা চরিত্রে উমার বিশেষ কী ছিল পথের পাঁচালী ছবিতে? প্রথমেই বলতে হয় তার মায়াকারা চেহারার কথা। তার মধ্যেই দরিদ্র-পরিবারের এক দস্যিমেয়ের চরিত্র, বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে যে ভালোবাসে, প্রয়োজনে শখের জিনিশ চুরি করতেও দ্বিধা করে না। সরল হলেও দুর্গার চোখেমুখে এক ধরনের ধারালো ব্যাপার ছিল। বুদ্ধিমত্তার ছাপ ছিল। পথের পাঁচালী ছবিতে দুটি চরিত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একটি ইন্দির ঠাকুরণ আরেকটি দুর্গা। ইন্দির ঠাকুরণ চরিত্রটি না পেলে পথের পাঁচালী তৈরি করাই কঠিন হতো, জানিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। তেমনি অপু-দুর্গাকেও নিয়েও তিনি খুব চিন্তিত ছিলেন। অনেক ছেলেমেয়ে দেখেছেন চরিত্র দুটির জন্য।
ইন্দির ঠাকুরণ করেছিলেন চুনিবালা দেবী। নিঃসন্দেহে অসামান্য কাজ করেছেন। ইন্দির ঠাকুরণ আর দুর্গা মূলত একই চরিত্রের ভিন্নবয়সী দুটি রূপ। ইন্দির ঠাকুরণ অবহেলিত, মানুষের কাছে চেয়েচিন্তে খান, হরিহরের পরিবারে আশ্রিতা হিসেবে থাকেন। ছবিতে এই দুটি মৃত্যুই করুণ। ইন্দিরা ঠাকুরণ মারা যান জঙ্গলে একলা বসে থেকে, আর তার মৃত্যুটি প্রথম চিহ্নিত করে দুর্গাই। বসে থাকা ইন্দির ঠাকুরণকে যখন দুর্গা নাড়া দেয় তখন ইন্দির ঠাকুরণ মাটিতে পড়ে যান, আর তার হাতের ঘটিটিও গড়িয়ে পড়ে যেতে থাকে ঢালুতে, দুর্গারই হাতের স্পর্শ লেগে। প্রতীকী দৃ্শ্যটির ব্যাখ্যা অনেকটা এরকম হতে পারে- একদিন, আর কিছুদিন পরেই দুর্গাও এভাবে গড়িয়ে পড়ে যাবে।
৩.
দুর্গার মৃত্যুটি দুর্গার অনুপস্থিতির কারণে যতটা কষ্টের, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি কষ্টের অপুর জন্য। এমন কি, হরিহর বা সর্বজয়াও মেয়ের মৃত্যুতে ততটা একলা হয়তো হয়ে যান নাই। তারা তো পরস্পরের অবলম্বন হিসেবে আছে। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে। অপুরই আর কিছু রইল না। পরবর্তীতে ‘অপরাজিতা’ ও ‘অপুর সংসার’-এও আমরা দেখেছি অপুকে একের পর এক মৃত্যু সহ্য করে যেতে হবে। বাবা মরেছে, মা মরেছে, প্রিয় স্ত্রী মরেছে, জীবনে সে যত বড় হয়েছে তত শুধু একা হয়েছে। এক সময় তো পাগলদশায় সে গৃহত্যাগ করে। পরবর্তীতে ফিরে আসে ছেলের টানে। অপুর সংসার ছবির শেষ দৃশ্য- অপু ছেলেকে কাঁধে করে ফিরে যাচ্ছে অনন্তের পথে, তাও তাকে কেমন নিঃসঙ্গই লাগে। অপুর জীবনের প্রতিটি প্রিয়জনের মৃত্যু আমাদের আসলে স্মরণ করিয়ে দেয় দুর্গার কথাই। দুর্গা শুধু তার দিদির মতোই ছিল না, ছিল মায়ের মতোই। ছবিতে আমরা দেখেছি একেবারে ছোট থেকেই অপুকে দুর্গা মায়ের মতোই আগলে রাখত।
দুর্গার মৃত্যুতে আমাদের বুকের ভেতর যে হাহাকারটা শুরু হয় তার কারণ কী? এমন তো নয় এমন মৃত্যু আমরা দেখি নাই। হরহামেশাই তো আমাদের চোখের সামনে অসংখ্য মৃত্যু ঘটছে। রাস্তাঘাটে অনেক উলঙ্গ-অভুক্ত বালক-বালিকাকেই আমরা দেখি; কিন্তু তাদের জীবন আমাদের মনে খুব বেশি দাগ কাটে না; কিন্তু ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে যখন পড়ি কুড়িয়ে পাওয়া কিছু আমের জন্য দুর্গা কী নোলামি করছে, তা দেখে আমাদের হৃদয় হু হু করে ওঠে। অপু-দুর্গার জন্য আমাদের বেশি দুঃখ হয় কারণ তাদের পুরো জীবনের গল্পটি আমরা জানি। অভাবের একটা পরিবার। বাবা-মা তাদের ভালোমন্দ খাবারও কিনে দিতে পারেন না। তাদের হাসিখেলা সমস্ত কিছু আমাদের বুকে দাগ কাটে। তাদের আপন বলে হয়। কখনো মনে হয় আমরাই যেন অপু-দুর্গা।
আমরা জানি দুর্গার আরেক নাম উমা। সনাতন ধর্মে দেবী দুর্গা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। তিনি আবির্ভূত হন মাতৃরূপে। পথের পাঁচালী উপন্যাসে এবং চলচ্চিত্রে দুর্গা কন্যারূপে, দিদিরূপে আবির্ভূত হলেও তার মধ্যে এক মাতৃরূপ ছিল, যেটা অপুর প্রতি অপরিসীম ভালোবাসার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। পথের পাঁচালী উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে দুর্গা আমাদের মনে চিরকালের জন্য গাঁথা হয়ে গেছে। তেমনি গাঁথা হয়ে গেছেন উমা দাশগুপ্ত। শিল্প যে জীবনের চেয়ে বড় এটা উমা দাশগুপ্ত আবারও প্রমাণ করলেন পথের পাঁচালী ছাড়া আর কোনো ছবিতে অভিনয় না করে।
তাহলে হয়তো দুর্গারূপী উমাকে দর্শক এতটা গভীরভাবে মনে রাখত না। উমা নিজেও হয়তো নিজেকে ভুলে দুর্গার মধ্যেই আত্মসমর্পণ করতে চেয়েছিলেন, তাই আর কোনো ছবিতেও যেমন অভিনয় করেননি, বয়সকালে নিজেকে অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালও করে ফেলেছিলেন। এখন চিরকালের জন্য আড়ালে চলে গেলেও উমা আমাদের স্মৃতিতে দুর্গারূপে রয়ে যাবেন আজীবন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে