ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের ছাড় নয়
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ দিন দিন কমছে। এর অন্যতম কারণ বাণিজ্য কারসাজি। এর মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে। এসব নিয়ে আলোচনা এখন সর্বত্র। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির তথ্যমতে, দেশ স্বাধীন হওয়া থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে।
দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার অনেকভাবে হয়ে থাকে। তার একটি বড় উপায় হচ্ছে বাণিজ্য কারসাজি, আরেকটি হচ্ছে হুন্ডি। বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে যখন কোনো পণ্য আমদানি করা হয়, তখন কম দামের পণ্যকে বেশি দাম দেখানো হয়ে থাকে। ফলে অতিরিক্ত অর্থ দেশের বাইরে চলে যায়। এ বিষয়টিকে ওভার ইনভয়েসিং বলা হয়। আবার কখনো বেশি দামের পণ্যকে কম দাম দেখিয়ে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয়। এভাবে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকার একদিকে তার শুল্ক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের অর্থ বিদেশে চলে যায়।
আবার অনেক সময় পণ্য আমদানি-রপ্তানির ঘোষণা থাকলেও বাস্তবে খালি কনটেইনার আসা-যাওয়া করে। এসব টাকা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার বিভিন্ন সময় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে; কিন্তু খুব একটা সুফল আসেনি।
দেশে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয় দিন দিন বেড়েই চলছে। এর পেছনের কারণ হিসেবে পুরোনো ঋণপত্রের (এলসি) বিলম্বিত অর্থ পরিশোধ ও যন্ত্রপাতির মূল্য বৃদ্ধিকে দায়ী করা হচ্ছে; কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুধু এ দুটি বিষয় দিয়ে মূলধনি যন্ত্রের আমদানি ব্যয়ে এত বড় উল্লম্ফনকে কোনোভাবেই যৌক্তিকতা দেয়া যায় না। ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে বলে সন্দেহ করছেন তারা। একই সঙ্গে এ বিষয়ে বাণিজ্যিক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছেন।
খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকই জানিয়েছে, আমদানি ঋণপত্রে ব্যাপক ওভার ইনভয়েসিং হয়েছে। গত বছরের ঋণপত্রে কমপক্ষে ২০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ইনভয়েসিং হয়েছে বলে সন্দেহ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমন ধারা এখনো চলমান।
তাই অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের খুব সতর্কতার সঙ্গে খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ মূলধনি যন্ত্রের বেশির ভাগই শূন্য শুল্কে আমদানি হয়। সুতরাং এখানে ওভার ইনভয়েসিংয়ের বিরাট একটা সুযোগ আছে। কোথায় আমদানি হলো, কত দামে হলো-এর একটা অনুসন্ধান কর্মসূচি সম্পন্ন করে বিষয়গুলো নিয়ে পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।
আবার দেখা গেছে, কিছু বড় শিল্প গ্রুপের মুনাফা অর্জনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান থাকলেও তারা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে ঋণখেলাপি হয়ে যায়। এর একটা কারণ অবৈধভাবে বিদেশে মুনাফা পাচার।
দেশের অর্থনীতির সংকটের জন্য বিদেশে অর্থ পাচার ও খেলাপি ঋণকে বেশি করে দায়ী করা হয়। তবু কেন সরকার ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে নমনীয় নীতি অনুসরণ করছে তা বোধগম্য নয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যারা অর্থ পাচারকারী ও ঋণখেলাপি তারা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী। ফলে এই খেলাপি ঋণ আদায় ও বিদেশ থেকে অর্থ ফেরত আনতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
অর্থনীতির প্রতিটি উদ্দীপক একে-অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। যে কারণে দেশে খেলাপি ঋণের অর্থ পাচার বেড়েছে। সে কারণে বৈধপথে প্রবাসী আয়ও কমছে। সেই সঙ্গে খোলাবাজারে ডলারের চাহিদা বাড়ছে। যার জন্য রিজার্ভ দ্রুত কমে যাচ্ছে। তাই খেলাপি ঋণ, দুর্নীতি ও হুন্ডি-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এখনই কার্যকর ও কঠোর ব্যবস্থা না নিলে দেশে চরম অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কা আছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে