সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে আলাদা হলো সাত কলেজ: কিসের দাবিতে এই সংঘাত
নানামুখী সংঘাত এবং অস্থিরতার মুখে প্রায় আট বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে আলাদা হয়ে গেল অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজ। শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে মুক্ত হচ্ছে ঢাকার এই সাত সরকারি কলেজ। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ।
সোমবার (২৭ জানুয়ারি) ঢাবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের সঙ্গে কলেজগুলোর অধ্যক্ষদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। ফলে ২০২৪-২৫ সেশন, অর্থাৎ চলতি বছর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সাত কলেজের শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছে। যে সমস্যার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্য সাতটি সরকারি কলেজের এই সংঘাত যার ফলে কর্তৃপক্ষকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হলো, তার পটভূমি কী? সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের সমস্যার সমাধানের দাবিতে কিছুদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দিচ্ছেন।
শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো কী?
শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো- ২০২৪-২৫ সেশন থেকেই সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতি বাতিল করা, শ্রেণিকক্ষের ধারণক্ষমতার বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তি না করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা, ভর্তি পরীক্ষায় ভুল উত্তরের জন্য নম্বর কাটতে হবে ও সাত কলেজের ভর্তি ফির স্বচ্ছতা নিশ্চিতে মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত নতুন অ্যাকাউন্টে ভর্তি ফি জমা রাখতে হবে।
তবে, প্রশাসনিক জটিলতা, পরীক্ষার সময়সূচি ও ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব এবং শিক্ষার্থীদের পরিচয় সংকটকে এই সংঘাতের মূল কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সাত কলেজে অধ্যয়নরত প্রায় ২ লাখের বিশাল শিক্ষার্থী সংখ্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে কলেজগুলোর পরীক্ষা এবং ফলাফল পরিচালনায় দীর্ঘসূত্রতা শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশার জন্ম দিয়েছে। সময়মতো প্রয়োজনীয় সমাধান না আসায় সমস্যাগুলো ক্রমেই জটিল হয়ে আজকে বিস্ফোরিত পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
অধিভুক্তির সিদ্ধান্তকে শুরুতে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা স্বাগত জানালেও পরবর্তীতে ঢাবির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক অদক্ষতা এবং সময়মতো সেবা দিতে না পারার অভিযোগ তুলতে থাকেন তারা। তারা মনে করেন, ঢাবিতে যুক্ত হলেও সেই সম্পর্কের সুবিধা সেভাবে পাচ্ছেন না। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তাদের পরীক্ষার তারিখের সঠিক সমন্বয় হচ্ছে না, ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘ সময় নেয়া হচ্ছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পর্যাপ্ত একাডেমিক সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। এতে তাদের একাডেমিক ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের সমপর্যায়ের শিক্ষা ও সেবা পাচ্ছেন না। শিক্ষক নিয়োগ, পাঠ্যক্রম এবং একাডেমিক সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা বৈষম্য।
অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাত কলেজের অধিভুক্তি নিয়ে প্রথম থেকেই অসন্তুষ্ট। তাদের দাবি, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থাপনা না করে তাদের একই শিক্ষাপদ্ধতির অধীনে রাখাসহ প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে মূল ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। কলেজগুলোর সমস্যা তাদের শিক্ষার মান, পরিচয়, মর্যাদা এবং সুনামকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্রশাসনিক অদক্ষতায় দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলোর সমাধান না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বারবার আন্দোলনে নামতে বাধ্য হন। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমেই তিক্ততায় রূপ নেয়।
সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তর টিমের ফোকাল পারসন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বৈরাচারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করে আসছি। আমাদের দাবি ছিল চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকেই স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার; কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেটি করেনি। উল্টো ধারণক্ষমতার অধিক শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।
নতুন সিদ্ধান্তে কী আছে?
অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা-সংক্রান্ত আগের সিদ্ধান্ত বদলে এক বছর এগিয়ে আনা হচ্ছে। চলতি বছর বা ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ভর্তি না নেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দাবি অনুসারে গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের কার্যক্রম পরিচালনা করতেও বৈঠকে জোর সুপারিশ করা হয়।
২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দাবি অনুসারে আসনসংখ্যা ও ভর্তি ফি নির্ধারণসহ যাবতীয় বিষয়ে মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে। যেসব শিক্ষার্থী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান শিক্ষা কার্যক্রমের অধীনে রয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়িত্বশীল থাকবেন বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে, যেন তাদের শিক্ষাজীবন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
কীভাবে চলবে সাত কলেজের কার্যক্রম?
ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ এ কে এম ইলিয়াস বলেছেন, অধিভুক্ত সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও থাকছে না, আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও থাকছে না। শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে এই সাত কলেজের জন্য আলাদা কাঠামো তৈরি করা হবে। তিনি বলেন, আলাদা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ঠিক করার পরই অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজে নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। 'কলেজগুলোর জন্য আলাদা নতুন যে কাঠামোর কথা সরকার চিন্তা করছে সেখানে ভর্তির বিষয়টি নির্ধারিত হবে। তাদের যদি কোনো সহায়তা লাগে সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিতে সম্মতি দিয়েছে।'
সংঘাতের পটভূমি
ঢাবি ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই উত্তেজনা ও সংঘাতময় পরিস্থিতি রাজধানীজুড়ে উত্তেজনা ও দুর্ভোগ তৈরি করে আসছিল বেশ কিছুদিন ধরে। ১৫ জানুয়ারি ঢাবি ক্যাম্পাসে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ এবং পাল্টা বিক্ষোভ নতুন করে উত্তেজনার সূচনা করে। সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাবির প্রশাসনিক ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন। তারা দাবি তোলেন, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ দ্রুততর করতে হবে এবং প্রশাসনিক জটিলতা সমাধান করতে হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে সাত কলেজের অধিভুক্তির বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন।
সর্বশেষ রোববার (২৬ জানুয়ারি) রাতভর দুপক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আহত হন অন্তত দশজন শিক্ষার্থী। এতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় নীলক্ষেত ও নিউমার্কেট এলাকা। মুহুর্মুহু সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপে মধ্যরাতে কেঁপে ওঠে আশপাশ। সারা রাত উভয় পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। থেমে থেমে চলছিল ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, রোববার বিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতি বাতিলসহ পাঁচ দফা দাবির অগ্রগতি জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদের সঙ্গে কথা বলতে যান সাত কলেজের এক দল শিক্ষার্থী। তারা সবাই একসঙ্গে হুড়মুড় করে অধ্যাপক মামুন আহমেদের অফিস কক্ষে ঢুকে যাওয়ায়, তিনি বিরক্ত হয়ে ওঠেন। এ সময়ের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, মামুন আহমেদ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলছেন, ‘আমি তোমাদের বলেছি দুজন আসতে; কেন বলেছি? আমি তোমাদের কথা শুনব। বাট তুমি দলবল নিয়ে আমার রুমে ঢুকেছো।’
অন্যপাশে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘দুজন তো সব কথা বলতে পারবে না।’ তখন অধ্যাপক মামুন বলেন, ‘কেন বলতে পারবে না? তোমার বক্তব্য প্রতিনিধি হিসেবে বলবা।’ শিক্ষার্থী বলেন, ‘ওরা মানবে না স্যার।’ তখন অধ্যাপক মামুন বলেন, ‘মানবে না, দ্যাটস নট মাই বিজনেস।’ তখন এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আপনি এত অ্যাগ্রেসিভ হয়ে যাচ্ছেন কেন?’ তখন অধ্যাপক মামুন বলেন, ‘অ্যাগ্রেসিভ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।’ তখন ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আপনি যেভাবে অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেলেন, এটা কিন্তু গ্রহণযোগ্য আচরণ নয়।’ তখন অধ্যাপক মামুন বলেন, ‘অবশ্যই এটা গ্রহণযোগ্য আচরণ। প্লিজ সরি, তোমার কথা শুনব না। তোমার কথা বারবার শোনার জন্য এখানে বসিনি।’
অধ্যাপক মামুনের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ হন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। প্রতিবাদে তারা সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঢাকা কলেজের সামনে জড়ো হন। রাত ১০টার পর সায়েন্স ল্যাব ছেড়ে মিছিল নিয়ে অধ্যাপক মামুনের বাসভবন ঘেরাওয়ের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে এগোতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। সাড়ে ১০টার দিকে তারা নীলক্ষেত মোড়-সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের সামনে পৌঁছান। এক পর্যায়ে তারা উপ-উপাচার্যের বাসভবন অভিমুখে রওনা হওয়ার ঘোষণা দেন। এ খবর পেয়ে স্যার এ এফ রহমান হলের সামনে লাঠিসোটা নিয়ে অবস্থান নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে পুলিশ তোরণের এক দিকের সড়কে ব্যারিকেড দেয়।
একপর্যায়ে উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া শুরু হলে রাত ১২টার পর পুলিশ মাঝে অবস্থান নিয়ে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়ে। এর পরও দুপক্ষের শিক্ষার্থীরা দুই দিকে অবস্থান নেন। দফায় দফায় চলতে থাকে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। গাউছিয়া থেকে ঢাকা কলেজ পর্যন্ত সড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহসহ সমন্বয়ক আবদুল কাদের, হাসিব আল ইসলাম, সহ-সমন্বয়ক মোবাশ্বিরুজ্জামান ছাত্রদের থামাতে গেলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাত সোয়া ১২টার দিকে ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে এসে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নেন।এরপর, সোমবার সকাল ৯টা থেকে ঢাকা শহর অবরোধের ঘোষণা দিয়ে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেন এবং দিনভর নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে আসে এই আলাদা হবার সিদ্ধান্ত।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে