দীপ্ত টিভির তামিম হত্যা: ধরাছোঁয়ার বাইরে মূল অভিযুক্তরা
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দীপ্ত টিভির সম্প্রচার কর্মকর্তা তানজিল জাহান ইসলাম তামিম হত্যা মামলার মূল আসামিদের কাউকেই এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তদন্তের ধীরগতিতে হতাশ ৩৪ বছর বয়সী তামিমের মৃত্যুতে ভেঙে পড়া তার পরিবার।
গত ১০ অক্টোবর রাজধানীর হাতিরঝিলে মহানগর প্রজেক্টের ডি ব্লকের ৪ নম্বর সড়কের ৭৯, ৮০, ৮১ নম্বর প্লটে নির্মিত বাড়ির ফ্ল্যাট ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধের জেরে পিটিয়ে ও গলাটিপে হত্যা করা হয় টিভি চ্যানেলটির এই কর্মকর্তাকে। এ ঘটনায় ১৬ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১১-১২ জনের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় হত্যা মামলাটি করেন নিহত তামিমের বাবা জমির মালিক প্রকৌশলী সুলতান আহমেদ।
পুলিশ জানায়, বাড়ি নির্মাণ ও ফ্ল্যাট ভাগাভাগি নিয়ে আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান প্লিজেন্ট প্রোপার্টির সঙ্গে বিরোধের জেরে খুন হন তামিম। ১৬ আসামির মধ্যে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ছয়জনকে। তারা হলেন, মো. আবদুল লতিফ, মো. কুরবান আলী, মাহিন, মোজাম্মেল হক কবির, বাঁধন ও রাসেল। তাদের মধ্যে আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন কুরবান আলী, মাহিন, বাঁধন ও রাসেল।
তবে নিহতের পরিবার বলছে, মামলাটির তিন প্রধান আসামি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মো. মামুন, বিএনপির সেসময়কার কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য প্লিজেন্ট প্রোপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ রবিউল আলম এবং কোম্পানিটির ইঞ্জিনিয়ার মীর্জা আব্দুল লতিফ গ্রেপ্তার না হওয়ায় ফের হামলার আতঙ্কে রয়েছেন তারা। তামিম হত্যার ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়েও সন্দিহান।
২৮ অক্টোবর থেকে হাইকোর্টের দেয়া আট সপ্তাহের আগাম জামিনে আছেন শেখ রবি। তিনিসহ অন্য দুজন পালিয়ে থেকেও মামলাটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ পরিবারটির। তদন্ত কর্মকর্তাদের দাবি, নানা প্রতিকূলতার মাঝেও এ মামলার তদন্তে ভালো অগ্রগতি হয়েছে। তারা আশাবাদী যে, খুব শিগগিরই তামিম হত্যার না জানা দিক উন্মোচিত হবে। এ ঘটনায় যুবদলের এক স্থানীয় নেতার নাম উঠে এসেছে বলেও জানান পুলিশ কর্মকর্তারা।
নিহত তামিমের বাবা প্রকৌশলী সুলতান আহমেদ জানান, ভবনটি নির্মাণে ব্যবহার করা জমির অংশীদার তিনজন। মালিকদের একজন তিনি নিজে, যে অংশটি তার স্ত্রী খুরশিদা আহমেদের নামে নিবন্ধিত। বাড়ি তৈরির চুক্তি অনুসারে তার পাওনা পাঁচটি ফ্ল্যাটের তিনটি বুঝিয়ে দিতে দীর্ঘদিন ধরে টালবাহনা করে আসছিল ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান প্লিজেন্ট প্রোপার্টিজ। এ বিষয়ে হাতিরঝিল থানায় জিডিও করেছিলেন তিনি।
তিনি জানান, ঘটনার দিন (১০ অক্টোবর) ভবনের অষ্টম তলার ফ্ল্যাটটিতে কিছু করছিলেন তামিম। এ সময় ১০-১২ জন অতর্কিতভাবে তার ওপর হামলা চালিয়ে গলাটিপে ধরেন। বুকে কিল-ঘুসি মারতে থাকেন। গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান তামিম।
মামলায় আরও অভিযোগ করা হয়েছে, তিনজন মালিকের জমি নিয়ে ৯তলা ভবনটি নির্মাণ করে প্লিজেন্ট প্রোপার্টিজ। মোট ২৭টি ফ্ল্যাটের মধ্যে প্রত্যেক জমির মালিককে পাঁচটি করে ফ্ল্যাট দেয়ার কথা ছিল; কিন্তু জমির মালিক নিহত তামিমের বাবাকে দুটি ফ্ল্যাট দেয়া হয়। বাকি তিনটির মধ্যে একটি ফ্ল্যাট মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মো. মামুনের শ্বশুরের কাছে বিক্রি করে দেন ডেভেলপার কোম্পানির মালিক। গত ১০ অক্টোবর তামিম অন্য দুটি ফ্ল্যাটের ভেতরের কাজ করতে গেলে ভবনের সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলেন ২০-২৫ জন। তামিম নিচে থেকে ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে গেলে তার ওপরও হামলা চালান দুর্বৃত্তরা।
হতাশা ব্যক্ত করে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তামিমের বড় ভাই শামভিল জাহান বলেন, দুমাস পার হয়ে গেলেও মামলায় তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। মূল আসামিরাও দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার অভিযোগ, ‘ডেভেলপার কোম্পানিটির মালিক বিএনপি নেতা শেখ রবিউল আলম তাদের পাওনা ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দিয়ে অবৈধভাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মো. মামুনের কাছে বিক্রি করে দেন, যা মামুনের শ্বশুর ফজলুর রহমানের নামে নিবন্ধিত হয়। রবিউল ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকলেও শুনেছি, তিনি বিএনপিরই অন্য অঙ্গ-সংগঠনের এক নেতাকে ভাড়া করেছিলেন।’
মামলার প্রধান আসামি মো. মামুনকে তামিম হত্যার এক সপ্তাহের মধ্যেই বরখাস্ত করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। মোবাইলে ফোনসহ নানাভাবে চেষ্টা করা হলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। ১৩ অক্টোবর মামলাটির তিন নম্বর আসামি শেখ রবি গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে দাবি করেন, ১০ অক্টোবর তার অজ্ঞাতেই কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার মীর্জা আব্দুল লতিফ (মামলার দুই নস্বর আসামি) দুজন সহকারীসহ ক্রেতা ফজলুর রহমানকে অর্ধেক ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে মহানগর প্রজেক্টে যান। সেখানে ফজলুর রহমান, তার দুই ছেলে এবং তাদের মেয়ে জামাইও ছিলেন। যোগাযোগ করা হলে মামলা তদন্তাধীন থাকায় এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান বিএনপির এই নেতা।
মামলাটির তদন্তে আগে জড়িত থাকা অন্তত তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এই মামলায় প্রচুর দাবি পাল্টা দাবি আছে। সেগুলো বিশ্লেষণে গিয়ে সময়ের অপচয় না করে প্রথমেই ভিডিওতে থাকা হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের সিদ্ধান্ত হয়। হামলাকারী সবাই গ্রেপ্তার হলেই কে তাদের এনেছেন, তা সহজেই জানা যাবে। মূল অভিযুক্ত বেশিরভাগ আসামি জামিনে এসেছেন বলেও জানতে পেরেছেন তারা। এই হামলায় মূল নেতৃত্ব দিয়েছেন ভবনটিতে ইট-সুরকি সরবরাহকারী স্থানীয় একজন যুবদল নেতা বলেও জানতে পেরেছেন তারা।
হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রাজু আহমেদ বলেন, ‘তামিম হত্যা মামলার তদন্ত গুরুত্বের সঙ্গে করছি। ইতোমধ্যে ছয়জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আগের তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর গোলাম আযম বদলি হয়ে যাওয়ায় তদন্ত কিছুটা ধীরগতির হয়ে গিয়েছিল। নতুন তদন্ত কর্মকর্তা দেয়া হয়েছে। আন্তঃবাহিনী যোগাযোগও বাড়ানো হয়েছে।’ মূল আসামিদের জামিনের বিষয়ে তিনি জানান, তারাও এমন তথ্য শুনেছেন। তবে কিছুদিন আগে এ থানায় যোগদান করায় এখনো তেমন কোনো কাগজপত্র পাননি তিনি।
বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেক্টর আরাফাত বিন ইউসুফও একই কথা জানিয়ে বলেন, যেহেতু এখনো জামিনের কাগজপত্র জমা দেননি, তাই এখনো পলাতকই গণ্য হবেন তারা। সমস্যা হলো মূল আসামিদের মোবাইল নম্বর এখনো বন্ধ। ‘তবে অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত মামলার অগ্রগতি নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। আশা করছি, খুব শিগগিরই আরো আসামি গ্রেপ্তার হতে পারেন।’
জড়িত বলে নাম পাওয়া যুবদল নেতার পরিচয় প্রকাশ না করে তদন্ত কর্মকর্তা জানান, ‘তিনিও পলাতক এবং ঘটনার পর থেকে তার মোবাইল কখনো খোলেইনি।’ তিনি বলেন, ‘আসামি মামুন ঢাকার বাইরে আছেন বলে জানতে পেরেছি। তবে শেখ রবি মাঝে মাঝেই ঢাকায় আসেন। তাদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলমান’। এদিকে ঘটনার দুদিন আগে নিরাপত্তা চেয়ে হাতিরঝিল থানায় জিডি করতে গেলেও তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম তা নেননি জানিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের (ডিএমপি) কাছে অভিযোগ করেছে নিহত তামিমের পরিবার।
ইন্সপেক্টর সাইফুলকে প্রত্যাহার করা হয়েছে জানিয়ে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) রুহুল কবির খান জানান, তদন্ত চলমান। তাই তার (ওসি সাইফুল) বিরুদ্ধে নতুন কোনো পদক্ষেপ এখনো নেয়া হয়নি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে