Views Bangladesh Logo

খেলাপি ঋণ সাড়ে ৩ লাখ কোটি ছাড়ানোর শঙ্কা

Rasel Mahmud

রাসেল মাহমুদ

০২৪ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এক লাফে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা বেড়ে ঠেকেছে পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকায়। ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষ হলেও এখনো খেলাপি ঋণের হিসাব প্রাক্কলন করা হয়নি। এই প্রান্তিকের হিসাব প্রাক্কলন হলে খেলাপি ঋণ সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

তাদের দাবি, শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা লুটপাট করা হলেও অনেক ঋণের তথ্য গোপন রাখা হয়েছিল। সেই তথ্যগুলো এখন বের হচ্ছে। এতে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা খেলাপি বৃদ্ধির তথ্য উঠে এসেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেলেও তা অস্বাভাবিক হবে না।

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০২৪ সালের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। সেখান থেকে বেড়ে সেপ্টেম্বরে হয়েছে পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা। যে ধারাবাহিকতায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে তাতে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হবো না।

খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশে কার্যরত ৬১ ব্যাংকের মধ্যে ৪৮টিতেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এ সময় খেলাপি কমেছে ৭টি ব্যাংকের।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা যা মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। এ সময় ৮টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় দ্বিগুণ থেকে কয়েকগুণ হয়েছে। এ ছাড়া ৭টি ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেকের বেশি খেলাপি হয়ে গেছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে ব্যাংক খাতের লুটপাটের খবর বের হতে থাকে। উঠে আসে হাসিনা সরকার ঘনিষ্ঠ শিল্প গ্রুপ এস আলম, সালমান এফ রহমানসহ রাখববোয়ালদের নাম। লুটপাটের দায়ে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলোসহ মোট ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে জরিমানা, সতর্কতাসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আবার কোনো কোনো পরিচালক বা ব্যাংক এমডি নিজেরাই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তারপর থেকেই নতুন নতুন খেলাপির নাম বের হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর দেশের অন্তত ৪৮টি ব্যাংকে ৮৭ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তবে এ সময় ৭টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে। এতে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা। ব্যাংক খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিতরণ করা ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশই খেলাপি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, সেপ্টেম্বরে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ বেড়েছে এতে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। ডিসেম্বর প্রান্তিকের প্রাক্কলন হলে খেলাপি ঋণ সাড়ে ৩ লাখ কোটি ছাড়াবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, তবে বড় আকারে যে বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। কারণ খেলাপি ঋণ ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে।

নতুন করে কেউ খেলাপি হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, আগে যেগুলো খেলাপি হয়ে গেছে সেগুলোর ওপর ক্রমবর্ধমান হারে সুদ বাড়ছে। এতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক বাড়ছেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সবচেয়ে বেশি খেলাপি বেড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের। ব্যাংকটির খেলাপি বেড়েছে ১২ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। এর পরের শীর্ষ ৫-এর মধ্যে ৩টির অবস্থানই ধরে রেখেছে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউনিয়ন ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ।

এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছে ১১ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। আর ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ১০ হাজার ২৫৮ কোটি এবং ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছে ১০ হাজার ২৮ কোটি টাকা। খেলাপি বৃদ্ধির দিক থেকে তালিকার পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকটির খেলাপি বেড়েছে ৫ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। আর ষষ্ঠ অবস্থানে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। খেলাপি বৃদ্ধির দিক থেকে তালিকায় সপ্তম অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। ব্যাংকটির খেলাপি বেড়েছে ৩ হাজার ৭০ কোটি টাকা। এ ছাড়া অষ্টমে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের ২ হাজার ৭৯৩ কোটি, নবমে থাকা রূপালী ব্যাংকের ২ হাজার ২৭২ কোটি এবং দশমে থাকা ব্যাংক এশিয়ার খেলাপি বেড়েছে ২ হাজার ১৮০ কোটি টাকা।

তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২৬ হাজার ১১১ কোটি ৫২ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৪০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮০৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা যা বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। একই সময়ে বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ২৪৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা যা বিতরণকৃত ঋণের ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৮১৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা যা বিতরণকৃত ঋণের ১৩ দশমিক ২১ শতাংশ।

আলোচ্য প্রান্তিকে ৮টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দ্বিগুণ থেকে কয়েকগুণ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে তিনটি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ভয়াবহভাবে। ২০২৪ সালের জুন মাসে বেসরকারি খাতের ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশে। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ থেকে ২৬ দশমিক ৯২ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৩ দশমিক ৯২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ তিন মাসে এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ, ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ দশমিক ৪২ শতাংশ থেকে ১০ দশমিক ৮৩ শতাংশ, মধুমতি ব্যাংকের ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ, আল-আরাফাহ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০ দশমিক ১৭ শতাংশ হয়েছে।

খেলাপি ঋণের বড় লাফ দেখা গেছে বেসরকারি খাতের সবল ব্যাংকগুলোতেও। ভালো ব্যাংক হিসেবে খ্যাত ব্যাংক এশিয়ার খেলাপি ঋণ ২০২৪ সালের জুন মাসে ছিল ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশে। প্রিমিয়ার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এনআরবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, এনসিসি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং সিটি ব্যাংকের খেলাপি ২ দশমিক ৯১ থেকে বেড়ে ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া টাকার অঙ্কে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ৩৯১ কোটি টাকা এবং ইস্টার্ন ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছে ১৪১ কোটি টাকা।

বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেক বা তারও বেশি খেলাপি হয়ে গেছে এমন ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাতে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকারি খাতের বেসিক ও জনতা ব্যাংক, বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক এবং বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। কারণ অনেক ঋণ পুনঃতফশিল করা হয়েছে, আদালতের স্থগিতাদেশের মধ্যেও খেলাপি ঋণের বড় একটি অংশ আছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এখন ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা যা বিতরণকৃত মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয়বার ক্ষমতা নেয়ার সময়ও খেলাপি ঋণ ছিল ৫০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ বেড়ে ৫১ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা হয়। তৃতীয় দফায় ক্ষমতা নেয়ার সময় ২০১৮ সালের শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। গত বছর জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। ওই সময় মোট বিতরণকৃত ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ খেলাপি ছিল। গত বছর মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণ থেকে উত্তরণ কীভাবে সম্ভব জানতে চাইলে ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা তো টাকা পাচার করে দিয়েছে। তাদের বিষয়ে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ দরকার। রাষ্ট্র কঠোর হলে খেলাপি থেকে বের হওয়ার পথ তৈরি হতে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, খেলাপি বেড়ে যাওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৭৯৫ কোটি, এক্সিম ব্যাংকের ১ হাজার ৭১৩ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১ হাজার ২৫৪ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকের ৬৩৩ কোটি এবং ঢাকা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫৫২ কোটি টাকা।

এ ছাড়া খেলাপি বেড়েছে বিডিবিএল, বেসিক, এবি, কমিউনিটি, যমুনা, মেঘনা, মার্কেন্টাইল, মিডল্যান্ড, মধুমতি, এনআরবি, এনআরবিসি, ওয়ান, প্রাইম, ইউসিবি, উত্তরা, পূবালী, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ